বাংলা যখন আফ্রিকার একটি দেশের সরকারি ভাষা.......
সিয়েরা লিওন।
সে দেশের পশ্চিমে অতলান্তিক সাগর। এক দিকে লাইবিরিয়া। অন্য দিকে গিনি। পূর্ণচাঁদের মায়ায় সমুদ্র তীরে আফ্রিকান ড্রাম বাজে। আফ্রিকানরা নাচে নিজস্ব ছন্দে।
প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরের সে দেশটা একবার দেখার সাধ হয়। অদ্ভুত রোমান্টিক নামের জন্য নয়।
সেখানে যাওয়ার সাধ জাগে, ওই আফ্রিকান দেশে একদা 'বাংলা অন্যতম সরকারি ভাষা' ঘোষণা দেওয়ার খবর পড়ে। বাংলাদেশের সকল মিডিয়ার খবরে আমরা পাঠক-দর্শক-শ্রোতারাও আবেগে উদ্ববেলিত হয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাস বলে আমারও মাতৃভাষা চেতনা নতুন করে জাগ্রত হয়েছে- কাজেই স্যোশাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট না দিলে ইজ্জৎ থাকেনা!
ভাবলাম সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় রাস্ট্র ভাষা সম্পর্কে কিছু লিখবো। তাই সিয়েরা লিওনের রাস্ট্রীয়/সরকারি ওয়েবসাইটে অনেক ঘাটাঘাটি করে দেখলাম- কাগজে কলমে সেই তথ্য আর পাওয়া যায় না, বাংলার প্রসঙ্গ আর নেই। তবে তা ঘোষণা হয়েছিল একবার।
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই দেশের সর্বস্তরের সর্বেসর্বারা সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের জন্য বক্তৃতা বিবৃতিতে ছয়লাব করে ফেলে। অনেকেই আবার মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের জন্য ইংরেজিতে বক্তৃতা দেন। একুশের বইমেলা আয়োজন উজ্জাপণ সে এক এলাহী কাণ্ড!অজস্র মানুষ উৎসব আনন্দে মাতোয়ারা হয়। বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সরওয়ার্দি উদ্যান পেরিয়ে শাহাবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী এলাকায় ফুচকা চটপটি বিক্রেতাদের রমরমা ব্যবসায় পোয়াবারো। ভাষা দিবসের উৎসবের রাতে জ্বলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি, বাংলা একাডেমি আর বিভিন্ন অডিটোরিয়াম। তাঁদের আবেগী বক্তব্য, গলার স্বরে উঁচু-নিচু প্রেক্ষাপণ দেখে শুনে এবং খবর পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যায়। তখন মিথ্যা সান্ত্বনা পেতে সিয়েরা লিওনের বাংলা কানেকশনে চোখ ফেলি। বাংলাদেশ থেকে এত দূরের ওই পশ্চিম আফ্রিকান দেশে কী করে বাংলা সরকারি ভাষা হয়েই যাচ্ছিল!

সিয়েরা লিওন হল নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশের সেনাদের গৌরবের গল্প। আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের বাঙালি সেনাদের গৌরব। সেই তথ্য চরম আকর্ষক। কেন বেশি করে প্রচার হয় না, জানা নেই।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সেখানে গৃহযুদ্ধের অর্ধ লক্ষাধিক লোক মারা গিয়েছিল। সিয়েরা লিওন তখন গৃহযুদ্ধে জ্বলছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অংশ হতে আমাদের দেশ থেকে প্রথমে গিয়েছিলেন ৭৭৫ জন সেনা সদস্য। পরবর্তীতে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ জন সেনা সদস্য পাঠানো হয়। ৩১ দেশের ১৭০০০ সেনার সেই বাহিনীর বিরাট অংশই বাংলাদেশি।
প্রথমে যে জায়গাটায় বাংলাদেশের সেনারা দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে সেই যায়গার নাম- লুঙ্গি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সেনারা সিয়েরা লিওনের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের ডেরা দখল করে। বিদ্রোহীদের দমন করায় বাংলাদেশি সেনাদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
শান্তি রক্ষার সাথে একইসাথে বাংলাদেশের সেনারা ক্ষুধার্তদের খাবার, আর্ত পীড়িতদের বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে সিয়েরা লিওনের সর্বস্তরের জনগণ এবং সরকার বাংলাদেশের সেনাদের আপনজন স্বজন হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি।
সিয়েরা লিওন সরকারও বাংলাদেশিদের অবদান ভোলেনি। সেই দেশে শান্তি ফেরার পর, ২০০২ সালে তখনকার প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাবাহ শান্তিচুক্তির পর ঘোষণা করেন, "বাংলা হবে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা।" বাংলাদেশের সেনাদের লড়াইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল বাংলা দেশের সেই স্বীকৃতি। সেটা হয়তো কথার কথা ছিল। স্রেফ আবেগে। কিন্তু সেটা ছড়াতে ছড়াতেই পল্লবিত হয়ে ডালপালা মেলেছে।
সিয়েরা লিয়নের সরকারি রেকর্ড, দস্তাবেজে আজ আর বাংলার নাম নেই। বাংলার বদলে সেখানে ক্রিও, মেন্দে, তেমনে, লিম্বার মতো ভাষার কথা শোনা যায়। সবচেয়ে বেশি লোকে কথা বলে ইংরেজিতে। কিন্তু এটা সত্যি, ওই বাংলাদেশি সেনারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষা, গানবাজনা দিয়ে মিশে গিয়েছিলেন সে দেশের মানুষের সঙ্গে।
ওই সময় বাংলাদেশি সেনারা ৫৪ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছিলেন- যা সিয়েরা লিওনের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চিকিৎসা সেবা এবং স্কুল পরিচালনা করায় সিয়েরা লিওনের নাগরিকদের বাংলা ভাষা শিক্ষায় উতসাহ দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেকেই বিশেষ করে শিশুরা বাংলায় কথা বলতে, লিখতে শিখে। প্রমাণিত হয়েছে- বাঙালিরা যেমন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে। বুদ্ধি ও পরিশ্রম দিয়ে রাস্তা বানাতে পারে ভিনদেশে। চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করতে পারে সুদূর সিয়েরা লিওনের আর্ত পীড়িতদেরও। ভালো ব্যবহার দিয়ে মন জয় করতে পারে ভিনদেশের মানুষের। বাংলাদেশি সেনারা ওখান থেকে ফিরে এসেছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। বাংলা সরকারি ভাষা না হোক, বাঙালি অতলান্তিক পারের দেশে মন জয় করেছিল।
সিয়েরা লিয়ন নামটা বাঙালির ভাষা দিবসে হৃদয়ে গেঁথে যায় আরও। তাঁরা হয়তো ভুলে যেতে পারেন। আমরা ভুলব না সিয়েরা লিয়ন ও বাংলাদেশের বাঙালির সংযোগ। রাজধানী ফ্রি টাউনে এক বিশাল শিমুল গাছ। সেখানে আফ্রো-আমেরিকান জনতা প্রথম জনসভা করেছিল ক্রীতদাস প্রথা থেকে মুক্তির পর। মুক্তির গান গেয়েছিল। ধন্যবাদ জানিয়েছিল ঈশ্বরকে। এ গাছ সিয়েরা লিওনের নাগরিকদের ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তির প্রতীক। অন্যদিকে বাংলাদেশ বর্তমান সিয়েরা লিওনের শান্তি ও সমৃদ্ধির অন্যতম অংশীদার।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




