কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এর বর্তমান চিত্র......
আমাদের এক সহপাঠী বন্ধু অসুস্থ্য হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতে ভর্তি। বন্ধু রোগীকে দেখতে আমরা চার বন্ধু গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তিনি হাসপাতালের ভি আই পি কেবিনে চিকিতসা নিচ্ছেন- ভি আই পি কেবিনের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা থাকালে শতশত সাধারণ রোগী এবং তাদের সাথে থাকা আত্মীয় স্বজনরা বারান্দায় কতোটা মানবেতর অবস্থায় আছে- যা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না! হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমরা শহীদ মিনার চত্তরে যাই......
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি"-অবিস্মরণীয় এই গান গাইতে গাইতে একুশের ভোরে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়নি এমন বাঙ্গালি খুঁজে পাওয়া ভার। একুশে ভোরের এই অনুভূতিটাই ভিন্ন। একাধারে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সীমাহীন গর্ব, অন্যদিকে ভাই হারানোর গভীর বেদনা। বাঙ্গালী মনের এই অনুভূতি আর ভাষা আন্দোলন তাৎপর্যকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে মানুষের ঢল নামে এখানে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গোটা চত্বর কিন্তু সারাবছর কেমন থাকে এই মিনার?
শহীদ মিনারের বর্তমান অবস্থা নিজের চোখে দেখার পরও বিশ্বাস হতে চায় না। তবু এক অপ্রিয় সত্যকে বিশ্বাস করতে হয়। ভাষা আন্দোলনের গৌরব গাঁথার প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবসে ভাষাবীরদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে ফুলের মালা হাতে আসেন দেশের দিন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত-সব ধরনের মানুষ। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কী ভুলিতে পারি গাইতে গাইতে প্রভাত ফেরীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় শিশু থেকে বৃদ্ধ। দেখলে গর্বে বুক ভরে যায়। শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসেন বিদেশী কূটনীতিকরাও। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গোটা আঙিনা। ভাই হারানোর গভীর বেদনায় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সীমাহীন গর্বে প্রতিবছর দিনটিকে স্মরণ করে প্রতিটি বাঙ্গালী। অবশ্য এখন শহীদ মিনার হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, উপর শ্রেনীর কেউ মারা গেলে "সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন" এর মঞ্চ।
একুশের চেতনাকে ঘিরে বিকশিত হয়েছে দেশের শিল্প সাহিত্য। বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং তার আগে প্রস্তুতির দু'দিন ও পরের দু'দিন এই পাঁচদিন বাদ দিলে বছরের অবশিষ্ট ৩৬০ দিন কেমন থাকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার! ঝরাপাতা, চীনাবাদামের খোসা, পোড়া বিড়ি সিগারেট, পলিথিনের ছেঁড়া ব্যাগ, চানাচুর-চিপ্সের খালি প্যাকেট, ছেঁড়া ঠোঙ্গা, কাকের পায়খানা, ব্যবরুত কন্ডম, ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয় মিনার চত্বর। পরিচর্যাহীন বিবর্ণ পোলিও রোগীর মত শহীদ মিনার।
একুশের বই মেলা উপলক্ষে এখন শহীদ মিনারের মূল বেদীতেও লোকে লোকারণ্য। দেখা গেল, শহীদ মিনারের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করে জুতা পায়ে মিনারের মূল বেদীতে উঠে অসংখ্য নারী-পুরুষের আনন্দ আশ্রম! অত ভীরের মধ্যেও এক লোক তার ছেলেকে সাইকেল চালনা শেখাচ্ছে। বেদীর উপর এখানে ওখানে ঘুমিয়ে আছে বেশ কয়েকজন ছিন্নমুল মানুষ। মূলবেদীর দেয়ালে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছে কেউ কেউ। মুড়ি ছিটিয়ে কাক জড়ো করছে এক সুবেশী মেয়ে আর তার ছেলে বন্ধু। একদিকে জোড়ায় জোড়ায় আপত্তিকর ভঙ্গিতে বসা প্রেমিক যুগল। সকাল-দুপুর ও বিকাল যখনই শহীদ মিনার এলাকা অতিক্রম করেছি- এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে। একজন পাহাড়াদার ছাড়া শহীদ মিনার পরিচ্ছন্ন রাখা ও পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত গণপূর্ত অধিদপ্তরের কোন লোককে একদিনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদ মিনার সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে হযরত তেলশাহর মাজার। আগে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মাজার থেকে শহীদ মিনারে আসার পথ বিচ্ছিন্ন ছিল। সেই কাঁটাতারের বেড়া কবে যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। ভবঘুরেদের কাছে শুনি- নৈশ প্রহরী ও আলোর ব্যবস্থা না থাকায় রাতের শহীদ মিনার চত্বর আরো নোংরা, আরো কদর্য এমনকি ভীতিপ্রদ হয়ে ওঠে।
তেলশাহ মাজারের সাথে পথ উন্মুক্ত থাকায় শহীদ মিনার চত্বরে রাতের আঁধারে গাঁজার আসর বসে, বাবা ও ফেনসিডিল সেবীদের আড্ডা জমে, ভাসমান পতিতারা খদ্দের নিয়ে মূল বেদীতে উঠে আসে, আশপাশের ফুটপাথের বাসিন্দারা এবং নিশাচর মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করে। একজন ঝালমুড়ি ওয়ালা জানান, দিনের চাইতে সন্ধ্যার পর বেচা-কেনা ভাল হয়। তবে রাতে এখানে যে সব কু-কাণ্ড ঘটে তা বলতে রুচিতে বাধে। মাঝে মাঝে টহল পুলিশ এসে বখরা নিয়ে চলে যায়।
একুশে ফেব্রুয়ারির একটি দিনকে কেন্দ্র করে পাঁচটি দিন পরিবেশ ভাল থাকলেও বছরের বাকি ৩৬০ দিন শহীদ মিনার চত্বরের পবিত্রতা বলতে কিছু থাকে না।
আমাদের উপস্থিতিতেই একুশে বই মেলা উপলক্ষে কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসা একটি ভারতীয় পরিবার শহীদ মিনার দেখতে এসেছিলেন। নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ঘুমন্ত মানুষ, দুরন্ত প্রেমিক প্রেমিকার নিলাজ চিত্র দেখে ভারতীয় পরিবারটি নীরবে দ্রুত শহীদ মিনার চত্বর ত্যাগ করে চলে যান।
অযত্ন-অবহেলার শিকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে যা দেখা গেছে, পীড়াদায়ক অনেক কথা বলা যায় না, লেখা যায় না। এক ফুচকা- চটপটি বিক্রেতা জানালেন- ১৭/১৮ তারিখ থেকে শহীদ মিনার চত্তর পরিস্কার করার কাজ শুরু হবে এবং তখন "আট কলেজের পোলা-মাইয়ারা রাইত-দিন রাস্তায় আর আস্পাশ সব যায়গায় ছবি আকবো- তহন এই যায়গা চিন্তেই পারবেন্না।!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১১:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




