একজন আদর্শ শিক্ষকের কথা----
"আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব বিষয়ে কোনো পক্ষেই প্রচার করিনি। কিন্তু এ বিষয়ে মুক্ত- যুক্তির আলোচনাকে আমি সর্বদাই উৎসাহ দিয়েছি। কোনো গূঢ় সত্যভিত্তিক মৌল তত্ত্বকে আমি পূর্বাভিমান- নির্ভর বলে মনে করিনি এবং আমার ছাত্রদের মনে করাতে চাইনি। যুক্তির পথ বেয়ে যে যেমন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছে, আমি তাকে সেই পথেই এগিয়ে দিয়েছি। এতে কেউ হয়েছে নাস্তিক, কেউ- বা আস্তিক। আমার নিজস্ব অভিমত কারোর উপলব্ধির ওপরে আরোপ করিনি। এই মুক্ত- বুদ্ধির উন্মেষই আমার মূল অভীষ্ট।"
- হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও

কবি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও(Henry Louis Vivian Derozio) পর্তুগীজ বংশদ্ভূত হলেও জন্ম, কর্ম জীবন এবং মৃত্যু কোলকাতায়। হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮২৬ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে কলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস পড়াতেন। তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল তাঁর ধ্যান-ধারণার মতোই গতানুগতিকতামুক্ত। শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মকান্ড শ্রেণীকক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্রদের আগ্রহ সৃষ্টিকারী যে-কোনো বিষয়ে তিনি তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে কলেজ প্রাঙ্গণের বাইরেও আলোচনা করতেন। বাস্তবে, তাঁর আলোচনার বিষয়বস্ত্তর পরিসীমা ছিল বহুবিস্তৃত - সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং বিজ্ঞান।
হিন্দু ধর্মের সারবস্তু নিয়ে ডিরোজিওর শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং তারা বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে হিন্দু ধর্মকে খোলাখুলিভাবে নিন্দা করতেও তারা ইতস্তত করেনি, যা হিন্দু সমাজে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ডিরোজিওর বিরুদ্ধে গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে আগত ছাত্রদের অধিকাংশের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ বিশ্বাস সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়।
'হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার' এর অভিযোগে ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তাঁর পদচ্যুতি অবশ্য প্রগতিবাদী আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে ডিরোজিও এ ঘটনার পর নিজের মতামত প্রকাশে আগের চেয়ে বেশি স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন।
ইউরেশীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনের কাজেও ডিরোজিও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন। সে সময় তিনি তার কিছু তরুণ হিন্দু শিষ্যকে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের প্রগতিবাদী ধারণাগুলি প্রচার করতে উৎসাহিত করেন। এভাবে ১৮৩১ সালের মে মাসে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দি ইনকোয়ারার’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং পরের মাসে দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক জ্ঞানান্বেষণ নামে বাংলায় (পরে ইংরেজিতেও) একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন। দৃশ্যত ডিরোজিওর নির্দেশনায় এসব পত্রিকার মাধ্যমে তরুণ প্রগতিবাদীরা হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালায়।

১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ডিরোজিওর আকস্মিক মৃত্যু প্রগতিবাদীদের উদ্দেশ্য সাধনের পথে গুরুতর আঘাত হানে। তবুও এ অসামান্য শিক্ষক তাঁর তরুণ হিন্দু ছাত্রদের মনে সংস্কারমুক্তির যে চেতনা উদ্দীপ্ত করেছিলেন তা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল।
২০০৯ সনে ভারত সরকার হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে স্বারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে।
তথ্যসূত্রঃ Henry Louis Vivian Derozio Biography in Bengali
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




