হারিয়ে গেছে কতো কী....
কত রকমের হারিয়ে যাওয়া যে আছে জীবনে। আমার হারানোর শুরুটা হয়েছিল জন্ম থেকেই.... তারপর কতো কিছু যে হারালাম! একমাত্র বুবুকে হারালাম, বাবা হারালাম, ভাই হারালাম- প্রথম প্রেম হারালাম.... এখনো কতকিছু যে হারাই- চাবি হারাই, চোখে চশমা পরে চশমা হাতড়ে বেড়াই.... ঘড়ি, কলম থেকে বইপত্র, চিঠি থেকে সেলফোন। হারাবার বস্তুর কমতি নেই জীবনে। জিনিস হারাই পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে, বাড়ীতে-অফিসে। ঠিকানা হারাই- বন্ধু বলে গেছেন বাড়ীর নম্বর, হারিয়ে ফেলেছি। বলেছেন আমন্ত্রন শুক্রবারে, হারিয়ে ফেলেছি ফোন নম্বর। কেমন করে জানা যাবে কখোন ক'টায় যেতে হবে? তারপরও যাই- রাস্তা হারাই- যাব কলাবাগান প্রথম লেনে, গিয়ে উপস্হিত লেক সার্কাস। এমনকি নিজের ফ্ল্যাটে না ঢুকে অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকে জুতা শার্ট খুলে সম্বিত ফিরে পাই.....আমি লজ্জিত হই, বারবার স্যরি বলি- যদিও ভুল ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা অত্যন্ত সম্মান আর দরদী ভাবেই গ্রহণ করেন।
আজকের পৃথিবীতে শিশুরা তাদের শৈশব হারায়, কিশোররা হারায় তাদের কৈশোর। যে হাতে বই ধরার কথা, সে হাত যখন হাতুড়ি ধরে, তখন তারা তাদের শৈশব হারায়। তেমনিভাবে যে কিশোর পড়ার ভারে নুয়ে পড়ে, পরিবারের চাপের কাছে সময় হারায়, তারাও তো তাদের কৈশোর হারায়। তবে যে জিনিসটা আমাকে খুব কষ্ট দেয় তাহচ্ছে- প্রতিদিন চোখের সামনে দেখা একটা নামকরা স্কুল/কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্ছন্নে যাওয়া।
আমার অফিস সংলগ্ন একটা ‘এন্ড রোড়’ আছে....বেশ নিরিবিলি প্রাকৃতিক ছায়াঘেরা যায়গা। অভিজাত আবাসিক এলাকা.....আমার অফিসের কাছাকাছি শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ। এই কলেজের একশ্রেণীর স্টুডেন্ট সকাল থেকে গ্রুপ করে রাত ৯/১০ টা পর্যন্ত মহা উল্লাসে গাঁজার আসর বসায়....গাঁজার গন্ধ আর ধূম্র জালে গোটা এলাকা দুষণীয় হয়ে ওঠে। এরা প্রায় সবাই বড়ো লোক/অভিজাত পরিবারের সন্তান। সবারই দামী গাড়ি কিম্বা মোটরবাইক আছে.....এই সংঘবদ্ধ গাঁজারুদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। আবার আমার বাড়ির কাছেই একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে সকাল থেকে রাত দেড়টা দুইটা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের চলে দৃষ্টিকটু বেলেল্লাপণা! কারোর সাধ্যনেই প্রতিবাদ কিম্বা ভালোউপদেশ দেওয়ার। আসলে সাহসের চাইতেও বড়ো বিষয়- "কার গরু, কে দেয় ধোঁয়া!"
স্মৃতিও তো হারাই আমরা। ভুলে যাই প্রিয়জনের নাম। ছেলেবেলার বন্ধুরা যখন পড়ন্ত বেলায় সামনে এসে দাঁড়ায়, হাতড়ে বেড়াই কি যে ছিল নাম টা- এটা কি কামাল, না কি রমেন, জোসেফও তো হতে পারে। ভুলে যাই দিনক্ষন- জন্মদিন ভুলি, বার্ষিকী বিস্মৃত হই। কত ঘটনার স্মৃতি হারিয়ে যায়। প্রেশারের ঔষধ সহ বেশ কয়েকটা ঔষধ আমাকে খেতে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে। এর মধ্যে দুটো ঔষধ খাই টানা চার পাঁচ বছর ধরে ব্রান্ড/পাওয়ার অদলবদল করে। গতকাল ঔষধ কিনতে গেলাম....অনেক চেষ্টা করেও ঔষধের নাম মনে করতে পারলাম না। প্রায় ঘন্টা খানিক লাজ ফার্মা ঔষধের দোকানে বসে থেকে ঔষধ না কিনেই বাসায় ফিরে এলাম! বাজার করতে যেয়ে একই পণ্য একাধিকবার কিনেছি কিন্তু প্রয়োজনীয় পণ্যটি কেনাই হয়নি!
নিজেকে তো হারিয়ে ফেলি নানান সময়ে- চিন্তায় ডুবে যাই পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে গিয়ে। হারিয়ে ফেলি সত্যিকারের আমিকে। মাঝে মাঝে ভাবি- এই আমিটি কে? আমার নিজের মাঝে শত শত আমিকে দেখি- মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, 'আমার মাঝের সত্যিকার আমি কি উঠে দাঁড়াবে'? নিজেকে খুঁজে বেড়াই নিজের মাঝে- ‘আপনাকে জানা আমার ফুরোয় না’!
অন্যের মাঝেও তো হারায় মানুষ- প্রেমে, মায়ায়, মমতায়। এ হারানোর সুখ আর আনন্দের কি তুলনা চলে? এ হারানো মানুষকে রিক্ত করে না, সিক্ত করে, শূন্য করে না, পূর্ণ করে। এ হারানো মানুষ অনেক সময়ে টের পায় না- হঠাৎই তা হয়ে যায়, অনেকটা সেই 'হারিয়ে ফেলেছি মন, জানি না কোথায়, কখন' এর মতন। ভালবাসায় কি নিজেকে হারিয়ে ফেলে নি 'নেতাই কবিয়াল' 'ঠাকুরঝির' মাঝে? কিংবা 'বিজয়া' কি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে নি যে 'নরেন' এর প্রতি প্রেমে সে হারিয়ে গেছে?
যখন প্রিয়জনেরা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখন আমরা বলি, 'আমরা বন্ধু হারিয়েছি, স্বজনেরা চলে গেছে, অথবা প্রিয়জনেরা আর ফিরবে না।' এ হারানো আর ফিরে আসে না। মাঝে মাঝে তখন মনে হয় -'লুকিয়ে আছ, আঁধার রাতে, তুমি আমারও বন্ধু হে'। তবে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের বামির তুলনা নেই। 'হারিয়ে যাওয়া' কবিতায় মাঝের ক' লাইনে এক অদ্ভুত হারানোর কথা আছে:
“সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতে,
শুধাই তারে, 'কি হয়েছে বামি?'
সে কেঁদে কয় নীচে থেকে, 'হারিয়ে গেছি আমি”।
কখনে কখনো বিশ্বাস হারাই মানুষের ওপরে। কখনো হয়তো কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে- অর্থের ব্যাপারে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে, প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে। আর বিশ্বাস ফিরে আসে না- হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। আস্থা হারাই প্রতিষ্ঠানের ওপর, নিয়মের ব্যাপারে, মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। আস্থা হারাই রাষ্ট্রের ওপরে, নেতৃত্বের ওপরে। ভাবি রাষ্ট্রে সমতার প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, ন্যায় লঙ্ঘিত হবে না, মানবিকতা রক্ষিত হবে। যখন এর কিছুই হয় না, আমাদের আস্থার জায়গাটি থাকে কোথায়?
আবার অন্যদিকে মানুষ অন্যভাবেও তো হারিয়েছি. বহু মানুষকে যে ভাবে দেখেছি, পরে তাঁরা সেখান থেকে হারিয়ে গেছে। লোভ-যশ-খ্যাতির বশবর্তী হয়ে বহু সম্মানিত মানুষের পদস্খলন দেখেছি- তাঁরা আমাদের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। বহু বান্ধব তাঁদের মত ও পথ বদলেছেন, নানান মোহের কাছে পরাজিত হয়েছেন। যা তাঁরা হতে পারতেন, তা তাঁরা হন নি, যা তাঁরা করতে পারতেন, তা তাঁরা করেন নি। সুতরাং তাঁদেরও তো আমরা হারিয়েছি- সর্ব অর্থেই। জাতি পথ হারায়, দেশ লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে।
অনেক সময় হারিয়ে ফেলি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মূল্যবোধ। পরিবর্তনের নাম করে বদলে ফেলি সনাতন মূল্যবোধ। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অস্বীকার করি ঐতিহ্য। নানান স্বার্থ প্রনোদিত হয়ে বদলে ফেলতে চাই ইতিহাস। আমাদের দেশের সংস্কৃতি, স্বকীয়তা আর মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এ হারানো বড় প্রকট। আমরা বিস্মৃত হই যে, এগুলো হারালে আমাদের আর কিছুই থাকে না।
আমরা তো মানবতাও হারাই। আমাদের নিত্যদিনের কর্মকান্ডে আমরা মানবতাকে নিধন করি। সম্মানিত মানুষকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেই না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। অন্য ধর্মের মানুষদের ধর্মচর্চ্চায় বাধা দেই, অন্যের কণঠস্বরের টুঁটি চেপে ধরি। এর প্রতিটি মাত্রিকতাতেই আমরা মানবতা হারিয়েছি।
চুড়ান্ত বিচারে মানুষ হিসেবে মানবতাকে যখন আমরা হারাই, তখন আর আমাদের থাকে কি? যাই থাকুক না কেন, আমরা যে আর তখন মানুষ থাকি না, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




