এলোমেলো ভাবনা.......
ইচক দুয়েন্দের ‘লালঘর’ পড়ে নিজের অনুভূতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে!
বইয়ে ১১ জন আসামিকে ঘিরে, তাদের হাজতে নিয়ে আসা হয়। উদ্বেগ হলো তারা মুক্তি পাবে কখন, বা আদৌ মুক্তি পাবে তো? ইচক দুয়েন্দের লালঘরে বন্দী ছিলেন ১১ জন। সেই সব বন্দীদের ভাবনা চিন্তা তুলে ধরেছেন লেখক। অন্যদিকে আমি বইটি পড়ে হারিয়ে গিয়েছি টুকরো টুকরো স্মৃতিতে.......
জেমস জয়েসের যেমন 'এপিফ্যানি'। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন না মেনে গির্জার বাইরে শব্দটিকে এনে ব্যবহার করেছেন। এটি এমন এক বিদ্যুৎ-মুহূর্ত বা ক্ষণপ্রভা যখন তুচ্ছ কোনও বিষয় সত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে ওঠে। তুচ্ছের মধ্যে মহৎকে সহসা দেখতে পায়। 'ইউলিসিস' এই সত্যে উদ্ভাসিত।
লোরকার যেমন 'দুয়েন্দে'!
দুয়েন্দে কী?
লোরকায় ভাষায়, 'উকার, গুয়াদদলেতে, সীল বা পিথুয়েরগা নদীর মধ্যবর্তী বিস্তৃত পশুচারণ-ক্ষেত্রে যদি কেউ ঘুরে বেড়ায় তাহলে কখনও কখনও তার কানে আসবে, 'এখানে প্রচুর দুয়েন্দে ছড়ানো।' মানুয়েল তোরেস, এক মহান আন্দালুসীয় গায়ক, একবার আরেকজন গাইয়েকে বলেছিলেন, 'তোমার গলা আছে, সৌকর্য আছে, কিন্তু তুমি কখনও সাফল্য পাবে না, কারণ তোমার কোনও দুয়েন্দে নেই।'
দুয়েন্দের সংজ্ঞা এইভাবে নির্দেশ করা যায়, 'এমন এক রহস্যময় এষণাশক্তি যা সকলেই অনুভব করে, কিন্তু কোনও দার্শনিকই যা ব্যাখ্যা করেননি।'
ওরহান পামুকের যেমন 'হুজুন'! মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা ফেরিওয়ালার হ্যাজাকের আলোকে হুজুন বলেছেন পামুক। এক বিষণ্ন একাকী পাগল পাগল আলো। এই আলোয় পামুক তাঁর শহরের আত্মাকে খুঁজেছেন। তাঁর চরিত্রেরা বড্ড অশরীরী- ছায়া ছায়া।
গার্সিয়া মার্কেজ পরিবারের সঙ্গে প্রথম তুষারপাত দেখতে যাচ্ছিলেন। কীভাবে তাঁর উপন্যাস শুরু করবেন কিছুদিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। দিশা পাচ্ছিলেন না। পথে যেতে যেতে তাঁর দাদীর গল্প বলবার স্টাইলের কথা মনে এল। তিনি লাফিয়ে উঠে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির পথে চললেন। শুরু হল এক কিংবদন্তি উপন্যাস- এটিই মার্কেজের প্রস্থানভূমি।
ইসাবেল আইয়েন্দে তাঁর 'দ্য হাউজ অব দি স্পিরিট' উপন্যাসটি হয়তো কোনওদিনই লিখতেন না- যদি না হঠাৎ আলোর ঝলাকানি হিসেবে তাঁর দাদা দাদীর লেখা চিঠি হাতে পৌঁছত। সারা ঘরময় যেন চিঠিগুলো উড়ে বেড়াতে শুরু করল।
রাইনার মারিয়া রিলকে একটি দোকানের শোকেসে অর্ফিয়ুসরূপী পুতুল দেখে 'সনেটস টু অর্ফিয়ুস' লিখতে শুরু করেছিলেন বা দুয়নো দুর্গে বসে 'দুইনো এলিজি' লিখেছিলেন। এখানে স্থান(দুইনো) ও পাত্র (অর্ফিয়ুস) নেহাত তুচ্ছ নয়- যেন সৃষ্টির স্ফুলিঙ্গ।
এরিখ আওয়েরবাখের প্রবাদপ্রতিম বই 'মাইমেসিস'- এর শুরুতে লিখছেন, হোমারের 'ওডিসি'-তে ওডিসিয়াস বহুদিন পর দেশে ফিরছেন আর তার পায়ের জন্মদাগ দেখে পুরনো দাসী ইউরিক্লিয়া তাকে চিনে ফেলছেন। এই 'জন্মদাগ' আওয়েরবাখের মতে 'an independent and exclusive present'- পূর্ণ আলো।
সুফি সাধকরা বলেন 'ফনা'! ফনা হল জীবন্ত অবস্থায় মরণ অথবা অহমকে লোপ করে দেওয়া। হুজরীরী বলেন 'গরীবী'! জগতের সব বস্তু থেকে বিমুখ হয়ে সম্পূর্ণ অহম বিলোপ করে সেই পূর্ণ এককে দেখা। ফনা ব্যক্তিত্বের নাশ নয় বরং পূর্ণ হয়ে ওঠা।
প্রেমে ফনার পথের অবস্থা হল 'হাল' আর বাউল বৈষ্ণবদের তাই 'দশা'! তখন:
"ভাব দিয়ে খোল ভাবের তালা
দেখবি সেই অতলের খেলা,
ঘুচে যাবে মনের ঘোলা
থাক গে সে রূপ নিহারে"।
এটা একটা ম্যাজিক। কখন কোথায় কবে কীভাবে একটা ভাবনার বীজ রোপন হবে কেউ আগাম বলতে পারেন না। পরিত্রাণহীনভাবে শুধুমাত্র হয়ে ওঠা।
'একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়'!
জীবনানন্দ দাশের কাছে তা 'মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা' অথবা 'অপরিহার্য দূরদর্শিতা ও ধীশক্তি'।
একজন জেলবন্দীর ভাবনা এমনই- ‘আমাদের এই প্রিয় গ্রহ পৃথিবীটাই তো শূন্যে ভাসমান এক বিশাল কারাগার।’
('দুয়েন্দে' নিয়ে কোনো এক ব্লগে একজন ব্লগারের লেখা পড়েছিলাম, নাম ভুলে যাওয়া সেই ব্লগার বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা। কয়েক বছর আগে 'হাবিজাবি' শিরোনামে আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম- সেটারই পূণঃলিখন এই পোস্ট।)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



