নিষিদ্ধ গল্প.....
প্রায়ই ভাবি- একটা ভাল কিছু লিখবো, একটা বই লিখবো। খুব উন্নত মানের একটা লেখা। আমার লেখা পড়ে কেউ হাসবে, কেউ কাঁদবে। খুব সাধারণ একটা ঘটনা নিয়ে লিখতে চাই, কয়েকটি মানুষকে নিয়ে লিখতে চাই, কিছু সুখ-দুঃখের গল্প বুনতে চাই- আমার সেই বই শেষ না করে পাঠক ঘুমোতে যেতে পারবে না। কিন্তু শেষমেশ আর কিছুই লেখা হয়ে ওঠে না। এত ঘটনার ভিড়ে কোন একটা ঘটনাও মুখ্য হয়ে ওঠে না আমার।
একটা সময় টুকরো টুকরো লিখতাম, সেই লেখা দেখলে আজ নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয়, হাসিও পায়। কিসব ছাতামাথা লিখে নিজেকে লেখক ভাবতাম! কিন্তু এখন সেই ধ্রুব সত্যটাকে আর এড়াতে পাচ্ছি না। নিজের অজান্তেই আমি মেনে নিয়েছি, আমি আসলেই কিছু লিখতে পারি না।
আমাদের বৃহত্তর পরিবারের প্রায় সবাই, এমনকি আমার বন্ধুরা, শিক্ষকদেরও কেউ কেউ আমাকে প্রায়শই বলতেন, “এত যে বই পড়িস কিছু লিখলেও তো পারিস। পাঠকদের কেউ সম্মান করেনা, লেখকদেরই মানুষ সম্মান করে।”
বুবুও আমাকে লিখতে বলতেন.....বুবুর কথা শুনে আমি হাসতাম। আমার বুবুর ছোট্ট দুনিয়াটার কথা ভেবে কেন যেন পরম মমতায় চোখটা ভিজে উঠত আমার। আমার সামান্য ভালোতেই, কত অল্পতেই না খুশি হতো আমার বুবু! বুবুও পড়তে ভালবাসতেন। তার কাছে লেখক মানে অন্যকিছু! আব্বার পোস্টিং পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাট এয়ার বেইসে। মনে আছে, ছোট চাচার অনেক বন্ধু ছিলেন তখন নামি-দামি কবি সাহিত্যিক। তাদের কেউ যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন বুবু তাদের সাথে যেচে কথা বলে কিরকম অভিভূত হয়ে পড়তেন। যেকোনো লেখককে সামনাসামনি দেখা বুবুর অনেক স্বপ্ন! বুবুর স্বপ্ন, সে-ও একদিন ভালো সাহিত্যিক হবে.....
আমি তো কোনো কবি সাহিত্যিক হতে পারলাম না। যদিও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে, সাময়িকীতে টুকটাক লিখতাম কিন্তু সেই লেখায় কাউকে মুগ্ধ করতে পারতাম না।
আচ্ছা এই ইচ্ছেটার শুরু কোথায়? আমার শব্দ নিয়ে, বাক্য নিয়ে খেলা করার সুপ্ত বাসনাটা কবে জাগলো? কবে ইচ্ছে হল নিজের কোন লেখার কোন চরিত্রের জন্য কাঁদব? কবে ইচ্ছে হল আমার প্রিয় সন্ধ্যাবেলার বাড়ি ফেরার অনুভূতিটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে?
কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি নিজেকে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে। আমার লেখালেখি কিছু হলেও সেটা একান্তই আমার নিজের জন্য। আমার গোপন লেখার গোপন পাঠক আমি একাই।
যখন আমি এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন আমার গোপন লেখালেখির মতো একতরফা গোপন প্রেম এবং প্রেমিকা ছিলো অনেক জন.....তারা সবাই আমার চেনা পরিচিত আত্মীয়া স্বজন, তাদের বান্ধবী কিম্বা তাদের ছোট বড়ো বোনেরা। আমি যখন কলেজ ভ্যাকেশনে বাড়ি ফিরতাম তখন আমার প্রেম মারাত্মক বেড়ে যেতো.....
যাযাবর লিখেছিলেন, 'মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় অনেক দুর্ভেদ্য দৃষ্টি ভেদ করে পুরুষের জৈবিক তাড়না উপলব্ধি করতে পারে'! আমার জৈবিক তাড়নাও বুঝতে পেরেছিল আমার চাইতে ৫ বছরের বড়ো মৃদুলা বিশ্বাস।
আমি মৃদুলাকে দিদি ডাকতাম। কিন্তু সেই দিদি সম্বোধনে বড় বোনের অনুভূতি ছিলো না। বরং প্রচন্ড শারীরিক আকর্ষণ ছিলো। আমার দিদি সম্বোধনের আড়ালে মৃদুলা বুঝতে পেরেছিল আমি ওর কাছে আসতে চাচ্ছি.....
খৃষ্টান ধর্মালম্বীরা মুসলমান হিন্দুদের মতো রক্ষণশীল পরিবার নয়। ওদের বাড়িতে যৎসামান্য চেনাজানার সূত্রেও যেকারোরই অবাধ যাতায়াত ছিলো। সেই সুযোগে আমি প্রায় সারাদিন নানাবিধ অজুহাতে মৃদুলার কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করি। জানি তাতে প্রেম ছিলো সামান্যই, শারীরিক আকর্ষণই মূখ্য ছিলো। মনে হতো- মৃদুলাও আমাকে চাইতো....। বিকেলগুলো ওর জন্য আমার প্রিয় হতে লাগল। কি প্রচন্ড আবেগ কাজ করত! ওকে নিয়ে কবিতা, গল্প কিম্বা ছোট ছোট চিরকুট লিখতে শুরু করলাম। যা লিখতাম তা আবার মৃদুলাদের বাড়িতেই রেখে আসতাম...মনে মনে চাইতাম -আমার লেখাগুলো শুধু মৃদুলা দেখুক, পড়ুক।
মৃদুলাদের বাড়িতে আমার যাতায়াত, বিশেষ করে মৃদুলার সাথে মেলামেশা আমাদের বাড়ির কেউ পছন্দ করে না। বুবু সরাসরি আমার উপর অসন্তুষ্ট। বুবুর চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি মৃদুলাদের বাড়ি যাই- কী এক নিষিদ্ধ আকর্ষণে। মৃদুলা কীর্তি এথলেট। কলেজের ইনডোর-আউটডোর চ্যাম্পিয়ন। মৃদুলার সাথে আমিও ক্যারম, ব্যাডমিন্টন খেলি।
একদিন লিখলাম-
'স্বপ্নে তোমায় চুমু দিলাম রাতের তারার মত,
বিশাল আকাশ থাকুক পাহারায় অবিরত।
ঠান্ডা হাওয়া নীরব আজি দুজনের উত্তাপে
কাছাকাছি বসে আঁধার দেখি আলোর পরিমাপে।
তোমার নরম গালের রংটা গাঢ় হয়ে গেল একি!
আমাদের দেখে হাসছে দেখো অন্ধকারে জোনাকি।
সাগর দেখেছি পাহাড় দেখেছি দেখেছি গভীর বন,
কোথাও পাইনি তোমার মত উত্তাপ শিহরণ।
সুন্দর দেখে লাগেনি আপন দেয়নি কিছুই সুখ
চাঁদের আলোয় দেখেছি যেনো স্বপনচারিনীর মুখ।
তুমিই আমার জীবন যাপনে সাত রাজার ধন
তুমি থাকতে নাই আর কোন সুখের প্রয়োজন।
ফিসফিস করে তোমায় বলছি শুনছো এই যে নারী?
আঁধার হারাক ভোরের আলোতে তুমি শুধু আমারই।'
কিসব কবিতা লিখতাম তখন!
আজকাল সেসব ভাবলে প্রচন্ড লজ্জা লাগে। অথচ ওর পাসে বসে যখন এসব ছন্দ মেলানো লেখা শোনাতাম, ও আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরত। ওকে কখনও আমায় “আমি তোমায় ভালবাসি” বলতে হয়নি। কিন্তু ও ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। আমায় যে বড় লেখক হতে হবে সেই বাসনা আরও তীব্রভাবে হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিল মৃদুলা। নিজে লিখত না, কিন্তু খুব পড়ত। আমার লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়ে উঠল সে। একদিন ফোন করে ওদের ভাগনির জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করল আমায়। চকোলেট আর ফুল নিয়ে যেয়ে দেখি কেউ নেই! মৃদুলা আস্তে আস্তে বলল, “বাসায় কেউ নেই, তোমার সাথে একান্তভাবে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল- তাই আসতে বলেছি....।”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এরকম একটা ফাঁকা বাসায় একটা মেয়ের সাথে সময় কাটানো কতটা বিপদজনক বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু চলে আসতে পারছিলাম না। আমি আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। মৃদুলা এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেল। আমি ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলাম।..... কবিতা-গল্পে প্রচুর চুমুর কথা লিখলেও এরকম অভিজ্ঞতা একেবারেই আমার জন্য নতুন। সেদিন কতক্ষণ ওখানে ছিলাম আমি জানি না। সময় থমকে গিয়েছিল। যতবার ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখছিলাম মনে হচ্ছিল এর থেকে বড় তৃপ্তি কিম্বা অতৃপ্তি আর কিছুই হতে পারে না। ওর ঠোঁট ছুঁয়েই মনে হচ্ছিল এই প্রথম কোন নিষিদ্ধ সুখ আমি স্পর্শ করছি।
সেদিন বাসায় ফিরেই লিখে ফেলেছিলাম এক দীর্ঘ প্রেমের কবিতা। আগে যা লিখতে ভীষণ সংকোচ হত সেসবেই আস্তে আস্তে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করলাম। মৃদুলাকে এখন আমার খুব কাছের মানুষ মনে হয়। মৃদুলাকে আমার একান্তই নিজস্ব সম্পদ মনে হয়, আমার অধিকার মনে হয়।
আমি যখন তখন মৃদুলাকে ফোন করে দেখা করতে চাই....আবারও একান্তে পেতে চাই....মৃদুলা কখনো সময় দেয়- আমি সবকিছু ফেলে মৃদুলাদের বাড়ি যাই....
কিন্তু সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়......
ভ্যাকেশন শেষ। আমাকে ফিরে যেতে হবে কলেজ হোস্টেলে....
কলেজে ফিরে যাওয়া খুব কষ্টের....মৃদুলাকে ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা। তবুও যেতে হবে। আর মাত্র একটা বছর। তারপর আমি হবো সেনা অফিসার.....বাড়ির সবার অমতেও মৃদুলাকে জয় করার সেকেন্ড স্টেপে পৌঁছানোর অপেক্ষা......
দুপুর বেলা।
আমার বুক শুকিয়ে গিয়েছে। বারবার পানি খাচ্ছি, আমার পিপাসা মেটেনা। আসলে আমার বুকটা শুকনো লাগছে মৃদুলাকে দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায়। মৃদুলাকে দেখলেই আমার তৃষ্ণা মেটবে.....
মৃদুলাকে একাধিক বার ফোন করি, নো রিপ্লাই!
আমি মৃদুলাদের বাড়ি যাই। ওদের কাজের বুয়ার কাছে নিশ্চিত হলাম - মৃদুলা বাড়িতেই আছে। চুপিসারে ওদের বাড়িতে ঢুকে দোতলায় মৃদুলার বেড রুমের দড়জায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। দড়জায় আলতো ধাক্কা দিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ পেলাম কিন্তু কারোর সাথে মৃদুস্বরে কথোপকথন শুনে থমকে যাই। কৌতূহল মেটাতে রুমের লাগোয়া বারান্দা সংলগ্ন জানালার পর্দা সামান্য সরিয়ে দেখি- একজন মধ্য বয়স্ক লোক(যাকে আমি আগেও দুএকবার মোটরসাইকেল চালিয়ে এই বাড়িতে আসতে/যেতে দেখেছি) ফ্লোরে ফেলে রাখা প্যান্ট শার্ট তুলে পরার জন্য হাতে নিয়ে মৃদুলার হাতে অনেকগুলো টাকা গুজে দিচ্ছে.... আর মৃদুলা খাটের পাশে বসে শালওয়ার কামিজ ঠিক করে নিচ্ছে আর বলছে- "পাঁচশো টাকায় হবে না, আরও পাঁচশো দাও...."- আমি আমার চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা....
আমি গোপনে গিয়েছিলাম, গোপনেই চলে এলাম। শুরু হল লেখক না হতে পারার আরেকটা গল্প......
(ক্যাডেট কলেজ ক্লাব আর্কাইভ থেকে সংগৃহিত ১৯৭৫ সালে কলেজ ম্যাগাজিনে লেখা আমার গল্প, পুনঃপ্রকাশ)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


