somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

মছলি মুসল্লম ও পাঁচ সের ঘিয়ের রান্না....

০৪ ঠা মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মছলি মুসল্লম ও পাঁচ সের ঘিয়ের রান্না....

'ঢাকাইয়া খাবার' ভারতের হায়দারাবাদ অথা উত্তর প্রদেশ, পাকিস্তানের পেশওয়ার, পাঞ্জাব অঞ্চলের অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবারের উৎস হচ্ছে মোঘল খাবারের অপভ্রংশ। বাংলাদেশে কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ মুসল্লম, রেজালা, চট্টগ্রামের মেজবানি, লাচ্ছা, ফালুদা, বোরহানি, বাকরখানি, কাবাব ছাড়াও ইফতারের অনেক আইটেমই মোঘল খাবারের অপভ্রংশ বললে ভুল বলা হবে না।

আওধের নবাবদের খাবার প্রতি দুর্বলতার কথা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে। আর তাই সেখানের বাবুর্চিদের কদরই ছিল অন্য রকম। কেউ পাঁচ সের ঘিয়ে একটা পরোটা ভাজতেন, তো কেউ শর্ত মানা হয়নি বলে বানানো ডাল মাটিতে ফেলে চাকরি ছেড়ে চলে যেতেন! এমনই সব আজব কিসসা আওধের নবাবদের ঘরে ঘরে। তারই কয়েকটা বর্ননাঃ

আপনি ভোজন প্রিয় বাঙালি হলে নিশ্চয়ই আওধি কাবাবের ভক্ত। আওধি কাবাব কোথাও কোথাও 'তুণ্ডে কাবাব' নামে পরিচিত। অমন নরম-তুলতুলে কাবাবের জন্য খাদ্যরসিকদের জান পেহসান। লখনৌয়ের বাবুর্চি মহলে তুলতুলে কাবাব-রহস্য সম্পর্কে দু’-চারটি কথা। প্রথম দিকে সেই শক্ত কাবাব খেয়ে নাকি আওধের বাদশাদের দাঁত নষ্ট হয়ে যেত। শক্ত খাবার খেয়ে এক বাদসা দাঁতের যন্ত্রণাবিদ্ধ হলেন। খাওয়ার সুখই যদি না থাকল, তাহলে বাদশা হয়ে লাভটা কি! আর বাদশাদের যদি খানার শখ না থাকে, তাহলে বাবুর্চিদের হাতযশের তোয়াজই বা করবে কে!

অতএব, নিত্য-নতুন এক্সপেরিমেন্ট। বাদশা-পসন্দ খানা তৈরির চেষ্টা। সেই চেষ্টা থেকেই আওধি ডিশ অমন নরম তুলতুলে। কাবাব থেকে পোলাও, কিংবা পরোটা-খামির-মোরব্বা, যাই মুখে দাও- নিমেষে মিলিয়ে যাবে তা। চিবোনোর প্রয়োজনই পড়বে না।

বিশ্বাস হচ্ছে না! ক্যাপ্টেন মেডান লিখিত এক সরকারি রিপোর্টের ইঙ্গিতও কিন্তু সেরকমই। নবাব আসফউদ্দৌলার কথা লেখা ছিল সেই রিপোর্টে-- যে আসফউদ্দৌলা তাঁর হাজারটি হাতির খাবারের পেছনে যত না খরচ করতেন, তার চেয়ে বেশি খরচ করতেন নিজের খাবারের পেছনে।

আর এই খাবারের প্রতি দুর্বলতা ছিল বলেই আওধের বাদশাদের মাথার ওপর রাজ করেছে বাবুর্চিরা। দু’-দু’জন বাবুর্চিকে তো তাঁরা বসিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের প্রধান উজিরের পদেও! আবার বাবুর্চিদের মান রাখতে উজিরদের হেনস্থা করতেও ছাড়েননি।

বাদশা গাজিউদ্দিন যেমন। তাঁর খাস বাবুর্চি রোজ ছ’টি পরোটা তৈরি করত ত্রিশ সের ঘি দিয়ে। পরোটা পিছু পাঁচ সের। উজির জানতে চেয়েছিলেন, রোজ ত্রিশ সের ঘি কোন কাজে লাগে!

‘পরোটা তৈরি করতে’-- বাবুর্চি বেশ রোয়াবের সঙ্গেই জবাব দিয়েছিল। উজির তখন নিজে দাঁড়িয়ে পরোটা তৈরি করিয়ে দেখলেন প্রচুর ঘি বেঁচে গেছে। স্মার্ট বাবুর্চি তখন উজিরের চোখের সামনেই সমস্ত ঘি ফেলে দেয়। তার যুক্তি, ‘একবার ঘি আঁচে চড়ালে, তা তেল হয়ে যায়। সেই ঘিতে আর অন্য খাবার তৈরি করা যায় না।’ সেদিন থেকে উজিরের হুকুমে বাদশার পরোটার জন্য বরাদ্দ হয় ছয় সের ঘি। পরোটা পিছু এক সের।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বাদশার কানে কথাটা উঠতে খেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কেন, তুমি লুটে নিচ্ছ না! একটা গোটা রাজ্য লুটেপুটে খাচ্ছ তুমি! আর বেচারা বাবুর্চি আমার খানা তৈরির জন্য সামান্য ঘি বেশি নেয় বলে তোমার চোখ টাটায়!’

আওধে বাবুর্চিদের দাপট ছিল ওমনই। নবাব আসফউদ্দৌলার এক মেজাজি বাবুর্চি তো তার শর্ত মানা হয়নি বলে কাজ ছেড়ে চলে যায়। সেই বাবুর্চি আবার গোটা মাষকলাই ছাড়া অন্য কিছু রাঁধত না। এদিকে আকাশছোঁয়া মাইনে। সেই আমলে পাঁচশো। তা তার শর্ত ছিল বাদশার ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হলে সেকথা জানাতে হবে একদিন আগে। আর তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নেওয়া চাই।

তা যেদিন বাদশার ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হল সেদিন ঠিক সময়ে দস্তরখানে হাজির হওয়ার নওতা পাঠিয়েছিল সে হুজুরকে। বাদশা তখন গল্পে মত্ত। বাবুর্চি অপেক্ষা করেনি। সমস্ত ডাল এক মরা গাছের গোড়ায় ঢেলে চলে যায়। শোনা যায়, যে গাছের গোড়ায় ডাল ফেলা হয়েছিল, কিছুদিনের মধ্যেই সেই মৃত গাছ নাকি ফুলে-ফলে ভর্তি!

আওধের বাবুর্চিদের নিয়ে এমনি কত গল্প! এই বাবুর্চিদের মধ্যে আবার রকমফেরও ছিল। দেগশোর, বাবুর্চি আর রকাবদার-- ছিল এই তিন দল। রান্নার পাত্র থেকে ডেকচি সাফাই আর বাবুর্চির ফাইফরমাশ খাটত যারা, তারা দেগশোর। আর বাবুর্চি যে, সে রান্না করত বড় বড় ডেকচিতে।

আর রাজ বাবুর্চি রকাবদার! সে বড় নাক উঁচু। বড় ডেকচিতে হাতই দেবে না। তার কাজ-কারবার সব ছোট হাঁড়িতে। মোরব্বা আর আচার বানাতেও সে ওস্তাদ। ওস্তাদ গার্নিশেও। আর তাদের নেশা? নেশা, রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা। নতুন নতুন সব ডিশ নিয়ে তারা হাজির হত বাদশা আর লখনৌয়ের খানদানি রইসদের সামনে।

কেমন সে খাবার! নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দরের এক বাবুর্চি বাদাম-পেস্তার খিচুড়ি তৈরি করে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। বাদাম কেটে চাল আর পেস্তার ডাল দিয়ে তৈরি হয়েছিল তা। দেখে বোঝার সাধ্য কি যে এ সত্যিকারের ডালচালের খিচুড়ি নয়!

শিরমালঃ বাখরখানির স্বগোত্রীয়। তবে এমনই লজ্জতদার যে লখনৌভিরা বলত, এ হল রুটির সরতাজ। মেহমুদ বলে এক রকাবদার নাকি এর আবিষ্কর্তা! জুড়ি ছিল না মলিদারও। রুটি ভেঙে তার ভেতর ঘি আর চিনির পুর ভরে তৈরি এই মলিদা। মুখে দিলে আর চিবোনোর প্রয়োজন পড়ত না, সেই চিনির পুর তখন গলে শরবত।

নান জলেবিঃ একমাত্র অভিজ্ঞ রকাবদারের হাতেই এর আসলি স্বাদ খুলত। দুধ কি গ্যিলেরিয়াঁও তাই। গ্যিলেরি, অর্থাৎ খিলি। আর খামিরি রুটির সঙ্গে যে খাওয়া হয় ‘নহারি’-- সেও এই লখনৌয়ের রকাবদারদেরই আবিষ্কার।

আওধের এক শাহজাদা ইয়াহিয়া আলির বাবুর্চি আলম আলির খ্যাতি ছিল ‘মছলি মুসল্লম’ তৈরিতে। খানদানিরা ছিলেন আলমের এই মছলি মুসল্লমের দিওয়ানা। তাদের বাবুর্চিরা আলমের মতো মুসল্লম তৈরি করার জন্য কম কসরত করেনি। তবে আলমের এলেম তাদের ছিল না।

সত্যিই আওধের রকাবদাররা ছিল এক একজন ম্যাজিশিয়ান। অতিথিদের ধোঁকা দিতে ফল বা মিষ্টির সাজে দারুণ দারুণ সব মাংসের প্রিপারেশন তৈরি করত তারা। ওয়াজিদ আলি একবার তাঁর দস্তরখানে ওমন ছদ্ম মিঠাই সাজিয়ে অপ্রস্তুত করেছিলেন এক মুঘল শাহজাদাকে। নাম তাঁর মির্জা আসমান কদ্র। শাহজাদা অবশ্য এর বদলা নিয়েছিলেন। আর সে ওই দস্তরখানেই।

সেসব কাহানি রূপকথার গল্পের মতো। সবই আজ ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তবে লখনৌয়ের শান তুণ্ডে কাবাব এখনও আছে। আছে কাবাবের আরও শ’খানেক ভ্যারাইটি। সেসবের স্বাদ চাখার পর লখনৌয়ের বাবুর্চিদের পায়ে যে আপনি হাজারটা পেন্নাম ঠুকতে রাজি, সে বাজি ধরে বলতে পারি।

তথ্যসূত্রঃ History of Mughal cuisine through ancient cookbooks by- Naer al Deen Sha. (এই লেখায় কলকাতার ভাষারিতী প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছি)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:২২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের টাকা দিয়ে ইসলামি ব্যাংকগুলো কি জুয়া খেলে?

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:০৫



ইসলামি শরিয়া ভিত্তিক দেশের পাঁচ পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকের আজ বেহাল দশা, তারা গ্রাহকের টাকা ফেরৎ দিতে পারছে না। সবগুলো ব্যাংকই এখন দেউলিয়ার পথে, বাধ্য হয়ে সরকার এই পাঁচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বি ডি আর বিদ্রোহ ও পিলখান হত্যাকান্ডের কিছু অপ্রাকাশিত সত্যঃ (পর্ব ০২)

লিখেছেন মেহেদী আনোয়ার, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

বিডিআর এর ডিজি নিহত হয় সকাল সাড়ে দশটায়। ভারতীয় টিভি চ্যানেল 'চব্বিশ ঘন্টা' বিস্ময়করভাবে অতি অল্পসময়ের মধ্যে বিডিআর ডিজি ও তার স্ত্রী নিহত হবার সংবাদপ্রচার করে সকাল এগারটায়। ভারতের আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ কি শিখিয়েছে?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৬






অপমান, অপদস্থ থেকে বাঁচার উপায় শিখাইনি? ওস্তাদ মগা শ্যামী পাহাড়ে বসেও এসবের সমাধান করতে পারে, আপনি সামান্য অসুস্থতার জন্যও ব্লগে মিলাদ দেননি, দোয়া করেছেন কার জন্য? খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×