স্মৃতিতে মেহেদী আরজান ইভান......
২০০৯ সালে ব্লগে 'কান্ডারী অথর্ব' নামে একজন কবির আবির্ভাব হয়। অসম্ভব সুন্দর কবিতা লিখেন। একজন সমাজ সেবক হিসাবেও পরিচিত। সমমনা ব্লগার বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারি- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং বিএনপি কর্মী সমর্থক, জিয়া পরিবার অন্তঃ প্রাণ। পেশায় ব্যাংকার। সংগত কারণেই লেখালেখিতে যথেষ্ট সক্রিয় থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে ছিলো না।

সমমনা বন্ধুদের নিয়ে আমরা প্রায়শই গেটটুগেদার আয়োজন করতাম- যার ব্যবস্থাপণায় থাকতেন Hafiz M Ullah স্যার। সম্ভবত ২০১১ সাল নাগাদ সংসদ ভবন দক্ষিন প্লাজায় তেমন একটা গেটটুগেদারে আরজান ইভান যোগ দেয়। প্রথম দৃষ্টিতে বয়সের তুলনায় বেশী গাম্ভীর্যতা লক্ষণীয়। আলাপ পরিচয়ে জানলাম- উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা প্রবাসী হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎই বাবার অসুস্থতা এবং মৃত্যুতে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসে। সংসারের হাল ধরতে প্রাইভেট ব্যাংকের আইটি বিভাগে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। তারপর নিয়মিতই আমাদের যোগাযোগ ছিলো। ২০১২ সালে ফেসবুক ভিত্তিক জেড ফোর্স সাইবার ট্রুপস গঠিত হলে বিষয় ভিত্তিক লেখালেখিতে সম্পর্ক গভীর হয়।
ম্যাডাম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মিথ্যা মামলায় ম্যাডাম জিয়া আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন সেই জবানবন্দি ভিত্তিক সংকলিত বই 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রকাশের উদ্যোক্তা Rajon Bapari, ব্লগার শের শায়েরী ( Shovan Rezwanul Haque) Wasim Iftekharul Haque ব্লগার ঘুড্ডির পাইলট ( MD Rafat Nur) দের অন্যতম ছিলেন আরজান ইভান। ২০১৮ সালে যখন বিএনপির নাম নেওয়াও ছিলো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনীর কাছে মৃত্যুদণ্ড তুল্য অপরাধ, সেই কঠিন সময়ে ওরা প্রকাশ করে 'রাজবন্দীর জবানবন্দি'!
বই নিয়ে বিমানবন্দর স্টেশনে র্যাব- ১০ এর হাতে প্রথম গ্রেফতার এবং গুম হয় রাজন। সেই রাতেই ইভানকে তুলে নেওয়া হয় ওদের বাড়ি থেকে। তখন ইভানের ছোট সন্তানের বয়স মাত্র ছয় দিন! তারপর গ্রেফতার এবং গুম হয় ওয়াসীম এবং শোভন।

আমি যখন গুম হই তখন অনেক দিন গুম নির্যাতনের পর ওদেরকে আইসিটি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। গুম নির্যাতনের পর আমাকে ছেড়ে দেওয়ার নাটক করে যে রাতে সেদিন সন্ধ্যায় ওদের চারজনকেই র্যাব-১০ রিমান্ডে নেয় এবং আমার সাথে দেখা হয়। একই রাতে দেখা হয় জাহিদ হাসানের সাথে। জাহিদকেও কয়েকদিন আগে ওর বাসা থেকে তুলে এনেছিল এবং নির্মম শারীরিক নির্যাতন করে। ব্লগার S M Sagor রাজন, ইভান, ওয়াসীম, শোভন, আমাকে, Zahid Hassan Muhammad Wahid Un Nabi ভাই, Z Babu, Tarunno Tamadi Enamul Haque Mony- সবাইকে গুম নির্যাতন করেছিলো র্যাব-১০/ র্যাব-২ এর ততকালীন কোম্পানি কমান্ডার এডিশনাল এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী।
কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের মেডিক্যাল ওয়ার্ডে আমার আর জাহিদদের আগেই অবস্থান করছিল শোভন আর ফসিউল আলম। ওয়াসীম ছিলো সূর্যমুখী সেলে, ইভানকে পাঠিয়ে দেয় কাশিমপুর কারাগারে। ওদের কোর্টে হাজিরার দিন তারিখ থাকায় দুইদিন আগে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। কোর্টে হাজিরার পর আবারও নিয়ে যাবে কাশিমপুর কারাগারে। আমাদের ওয়ার্ড রাইটারকে জানিয়ে ইভানকে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে জাহিদ এবং আমার যৌথ আতিথিয়েতায় লাঞ্চের জন্য দাওয়াত দেয়। ইভান খুব শুকিয়ে গিয়েছে। মুখটা মলিন। পারিবারিক আর্থিক দুশ্চিন্তায় আগের চাইতেইও নির্বাক নিশ্চুপ ইভান। খাবারের সময় শুধু বলেছিল- "এতো দিনে এই প্রথম জেলখানায় চৌখার ভাত খেলাম না (আমরা মেডিক্যাল ওয়ার্ডে কিছুটা উন্নত মানের খাবার কিনে খেতাম) আর একটি বারও কারোর দিকে তাকায়নি, কথা বলেনি। মাথা নিচু করে খাবার সময় চোখ বেয়ে পানি পারছিল। আমাদের ওয়ার্ডে এক দেড় ঘন্টা অবস্থান কালে ১০ টা শব্দও বলেছিল কিনা সন্দেহ।
২০১৯ সালের মে-জুন মাসে আমরা সবাই যখন একে একে জামিনে জেল থেকে বের হই তখন আমরা সবাই চরম আর্থিক সংকটে। ইভান দশ বছরের ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের চাকরি হারায় কোনো প্রকার বেনিফিট প্রাপ্তি ছাড়াই। বিরাট অংকের বেতন পাওয়া শোভন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি হারায়। ফসিউল নিজের বিজনেস হারায়। আমি আমার ইন্ডাস্ট্রি হারানোর সাথে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণে জর্জরিত। জাহিদ আগের মতোই আছে। ওয়াসীম শিল্পপতির ছেলে- ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ।
ইভান আর ফসিউল আলম যে কোনো একটা চাকরির জন্য আমাকে বলে.....আমার নিজেরও তখন কোনো আয় রোজগার নাই। আমি নিজেও বেকার! তবুও ইভান আর ফসিউল এর জন্য হাফিজ স্যারের সাথে কথা বলি। হাফিজ স্যার আর আমার এক বন্ধু যশোর জেলা শহরের শিল্পপতি। তিনি ঢাকা এলে আমরা একত্রে হাফিজ স্যারের অফিসে বসলাম। হাফিজ স্যার তাকে অনুরোধ করেন আমাদের কর্মসংস্থান করতে। তিনি 'একজনকে চাকরি দিতে পারবেন' জানালে- পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি আর ফসিউল অনুরোধ করি- ইভানকে চাকুরিটা দিতে। যদিও সেই চাকুরিটা ইভানের এডুকেশনাল ডিসিপ্লিন এবং এক্সপেরিয়েন্স রিলেটেড নয়, তবু্ও নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ইভান যশোরে গিয়ে চাকুরিতে জয়েন করে। ওখানে তিনমাস জব করে ঢাকা ফিরে এসে পেশা হিসেবে টিউশনি বেছে নেয়..... চাকরির বেতনের চাইতে বেশী ইনকাম করে, তাতেও সংসারের আর্থিক সংকুলান হচ্ছিল না। কিন্তু কাউকে নিজের জীবন সংগ্রামের কথা বলে না।
ওর স্ট্রোক করার ১৫/২০ দিন আগে আমরা যারা গুমের শিকার হয়েছি তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মামলা করার বিষয়ে রাজনের উদ্যোগে একটা গেটটুগেদার আয়োজন করি। তখন ইভান আমাকে বলে- "ভাই, টিউশনির পাশাপাশি সন্ধ্যায় একটা বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার এক বন্ধু মিরপুর এলাকায় ফুটপাতে চৌকি পেতে কাট পিস, রেডিমেড গার্মেন্টস বিক্রি করে। আমিও ওর পাশে একটা চৌকি পেতে রেডিমেড গার্মেন্টস বিক্রি করবো। আমার পুঁজি নাই, আমার বন্ধুই বাকীতে কাট পিস, রেডিমেড গার্মেন্টস দিবে। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ইতোমধ্যেই বন্ধুর সাথে সন্ধ্যায় দোকানে দাঁড়িয়ে কাপড় বিক্রি করছি।" আগামী মাস থেকে নিজেই এই কাজটা করতে পারবে- সেজন্য ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। ওর বিজনেস করার কথায় খুশী হয়ে আমি ওকে কেক খাইয়ে দেই...

কয়েকদিন পরই ইভানের স্ট্রোক করে.... দুইদিন হাসপাতালে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম....
মস্তিষ্ক রক্তক্ষরণের পর প্রায় চারমাস হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় থেকে আজ ইভান চলে গেলো না ফেরার দেশে। এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। এই হত্যার দায় র্যাব-১০ এর ততকালীন কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকী। এই হত্যার দায় শেখ হাসিনার।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


