somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ রোমন্থন (শততম পোস্ট) :)

২০ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাথার উপরে চিঁ চিঁ করে শব্দ করে ধীর গতিতে পনের বছরের পুরনো ফ্যানটা ঘুরছে। পাঁচ বছরের মেয়ে লীনাকে নিয়ে ভরদুপুরে শুয়ে আছেন সানজিদা হোসেন। চাকুরীর ব্যস্ততায় মেয়েকে খুব একটা সময় দিতে পারেন না তিনি। তাই ছুটির দিনগুলোতে সে ঘাটতি খানিকটা পুষিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না এ ভদ্রমহিলা। মেয়েকে নিয়ে এটা করেন, সেটা করেন, পড়তে বসান, নাচ শেখান আর দুপুর হলে পাশে নিয়ে শুয়ে থাকেন। মেয়ে শুতে চায় না। ধমক দিয়ে মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দেন সানজিদা হোসেন। ‘এই দুপুর বেলা কেউ খেলতে যায়? ঘুমাও!’ মেয়ে রাগ করে সানজিদা হোসেনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে। একসময় ক্লান্ত সানজিদা হোসেনের চোখে ঘুম চলে আসে। তারপর সুযোগ বুঝে বিড়ালের বাচ্চার মত নিঃশব্দে পালিয়ে যায় মেয়েটা।

সানজিদা হোসেনের চোখ বন্ধ। পাশে মুখ ঘুরিয়ে মিটিমিটি চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে লীনা। অনেক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে থাকলেও ঘুমোননি সানজিদা হোসেন। মেয়েটার কথা ভেবে ঘুম আসছে না তার। বদের হাড্ডি হয়েছে মেয়েটা। হুবহু তার মত!

বাবা মার একমাত্র মেয়ে ছিলেন সানজিদা হোসেন। একমাত্র মেয়ে হওয়াতে সানজিদার প্রতি বাবা মার আদরের পরিমাণটাও ছিল আকাশ চুম্বী। মা সর্বদাই চোখে চোখে রাখতেন। তিন অক্ষরের সুন্দর একটা ডাকনাম ছিল সানজিদার। আনফা। ভদ্রতা আর দুষ্টুমির দূর্লভ সমন্বয় ছিল আনফার মাঝে। দুপুরে ঘুমোতে বললে চুপচাপ মায়ের সাথে শুয়ে পড়ত আনফা। মা ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে বারান্দা দিয়ে পালিয়ে খেলতে যেত সে। এভাবে মাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে যেতে আনফা খুব মজা পেত। হঠাৎ কোন কারণে ঘুম ভেঙে গেলে মিসেস আনাম যখন বিছানায় মেয়েকে খুঁজে পেতেন না তখন সোজা চলে যেতেন সৃষ্টিদের বাসায়। সৃষ্টিদের বাসার সামনের ফাঁকা যায়গাটায় খেলত ওরা। মায়ের আগমন টেরপেয়ে লেজ গুটিয়ে ভদ্র মেয়ের মত বাসায় ফিরে আসত আনফা। মা বকতেন আর ভদ্র মেয়ে আনফা খুব মনযোগের সাথে মায়ের বকুনী শুনত। ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা পাঁচের ঘরে পোঁছতেই মহাসমারহে আবার খেলত যেত সে। মা বাঁধা দিতেন না। তবে বারান্দা দিয়ে একটু পর পরই লক্ষ্য করতেন তার কলিজার টুকরোটা অক্ষত আছে কিনা!

বউছি, কানামাছি, বরফপানি, ব্যাডমিন্টন আর স্কাইপিং(দড়ি খেলা নামে সমাধিক পরিচিত) এ পারদর্শী ছিল ছোট্ট আনফা। হাতে যেদিন কাজ থাকত না সেদিন মিসেস আনামও চলে যেতেন মেয়ের সাথে। মেয়ের খেলা দেখতে দেখতে গাল ভরিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন সৃষ্টির মার সাথে। সৃষ্টি আনফার ছোট, প্লে তে পড়ে। আনফা ওয়ানে।

অ্যানুয়াল স্পোর্টসের আর কয়েকদিন বাকী। স্কুলে মহড়া হচ্ছে নিয়মিত। ফাঁকা নেই সৃষ্টিদের বাসার সামনের মাঠটাও। স্কাইপিং খেলছে আনফা। প্রতিযোগীদের মধ্যে আনফাই সবার থেকে ছোট। দড়ি হাতে ছোট্ট আনফা ব্যাঙের মত লাফাচ্ছে আর মিসেস আনাম তন্ময় হয়ে সে অপূর্ব দৃশ্য স্নেহাতুর দৃষ্টিতে উপভোগ করছেন। থেকে থেকে মেয়েকে উৎসাহও দিচ্ছেন তিনি! ‘ধীরে ধীরে খেল মামনি। ধীরে খেললে অনেক্ষণ দম থাকবে আর তুমি জিততেও পারবে’। ধীরে ধীরে খেলছিল আনফা। সবাই আউট হয়ে গেছে। খেলা চলছে টুকটুকি আর আনফার মধ্যে। টুকটুকি আনফার বড়, ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে টুকটুকিকেও হারিয়ে দিল আনফা। মিসেস আনাম মেয়ের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। পাড়া পড়শিরা বলাবলি করতে লাগল, ‘ভাবী দেখিয়েন, আপনার মেয়েই অ্যানুয়াল স্পোর্টসে ফার্স্ট হবে!’

অ্যানুয়াল স্পোর্টস এর আর মাত্র দু’দিন বাকী। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু দড়ি নিয়েই পড়ে থাকে আনফা। মা বলেছে আনফা ফার্স্ট হবে। এজন্য আনফাকে ফার্স্ট হতেই হবে। মিসেস আনাম মাঝে মাঝে নরম সুরে মেয়েকে বকাবকি করেন। ‘শুধু দড়ি খেললেই পেট ভরবে? খেতে হবে না?’ মুচকি হাসি দিয়ে খেতে আসে আনফা। খেয়ে আবার দড়ি হাতে লাফানো শুরু করে। মিসেস আনাম মেয়েকে উৎসাহ দেন। মেয়ের মনোবল বেড়ে যায়।

অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন আসে। মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলেন মিসেস আনাম। খেলা শুরু হল দৌড় দিয়ে। সবার পেছনে গুটি গুটি পা নিয়ে দৌড়ে লাস্ট হল আনফা! তারপর হল বিস্কুট দৌড়। আনফা এখানেও ফ্লপ! আনফার লাস্ট হওয়ার পেছনে অবশ্য একটা কারণ ছিল। কারণটা আনফা ছাড়া এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। দৌড়ে শক্তি নষ্ট না করে স্কাইপিং এর জন্য শক্তি জমিয়ে রেখেছিল আনফা। যাহোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েদের স্কাইপিং শুরু হবে। প্লে থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত সবাই খেলতে পারবে স্কাইপিং। দড়ি হাতে প্রস্তুত সবাই। ঠিক এইমুহুর্তে একটা কান্ড বাধিয়ে ফেলল টুকটুকি। সে সাফ সাফ জানিয়ে দিল আনফা খেললে সে খেলবে না! টুকটুকির সাথে সুর মেলালো ক্লাস থ্রি ফোরের সবাই। প্রথমটাতে আনফা কিছু বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারল তখন ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়ে দিল। শিক্ষকরা পড়লেন মহাবিপদে! ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল বলে আনফার প্রতি স্যারদের একটা সফট কর্ণার বরাবরই ছিল। কিন্তু তাই বলে শুধু আনফার জন্য একটা ইভেন্ট তো আর বাদ দেয়া যায় না! অবশেষে আনফাকে ছাড়াই খেলা শুরু হল। মিসেস আনাম এটা সেটা বলে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। মেয়ের চোখের পানি বন্ধ হয়না। ‘প্লে এর অর্শা খেলতে পারলে আমি পারব না কেন?’ মিসেস আনাম চুপ করে থাকেন। খেলা শেষ হল। কিন্তু টুকটুকি ফার্স্ট তো দূরের কথা, থার্ডও হতে পারল না। কান্না বন্ধ হল আনফার। পরের ইভেন্ট বুদ্ধির খেলায় আনফা ফার্স্ট হল। প্রতিপক্ষের এমন করুন পরাজয় আর ফার্স্ট হওয়ার আনন্দ কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিল আনফার মনে।

বিকেলের ইভেন্ট শুরু হল যেমন খুশি তেমন সাঁজো দিয়ে। আনফা জুটি বাঁধল সৃষ্টির সাথে। আনফা বর, সৃষ্টি কণে। এ ইভেন্টেও ফার্স্ট হলো আনফা। আনফার আড়াই ইঞ্চ ব্যাসার্ধের ছোট মুখ খানায় খুশি যেন আর ধরে না! সেবার মোট আটটি প্রাইজ জিতেছিল আনফা। আর টুকটুকি? একটিও না!

অ্যানুয়াল স্পোর্টস শেষ হয়ে গেল। সৃষ্টিদের বাড়ির সামনের ফাঁকা যায়গাটায় আবার পুরোদমে খেলা শুরু হল। টুকটুকিও আসে খেলতে। এখন আর সে আনফাকে হিংসে করে না। ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে ওদের মাঝে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়। আনফা ওয়ান ছেড়ে ক্লাস টুতে ওঠে। অনেকগুলো নতুন বন্ধু হয় ওর। তারপর একদিন আনফার বাবার ট্রান্সফার লেটার আসে। টুকটুকি, সৃষ্টি, অর্শা সবাইকে ছেড়ে বাবার সাথে অনেক দূরে চলে যায় আনফা।

তারপর আর কোন দিন দেখা হয়নি ওদের।

মাথার উপর বিয়ারিং ভাঙা ফ্যানটা বিকট শব্দে চেঁচাতে থাকে। কল্পনার জালটা ছিঁড়ে যায় আনফার। ছয় বছরের আনফা নিমিষেই পয়ত্রিশ বছরের সানজিদা হোসেন হয়ে যান। দুষ্টু মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সানজিদা হোসেনের। কিন্তু ইচ্ছেটা পূরণ হয়না তার।

মার চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক আগেই বিড়ালের বাচ্চাটা পালিয়ে গেছে! :)




সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৫০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×