ইদানীংকালের মেয়েদের রূপ নিয়ে বিশিষ্টজনের মনে বিস্তর সন্দেহ আছে। মেকআপ নামক চেরাগের যাদুকরী ছোয়ায় বাঁশবাগানের প্রেতাত্নারাও যেন নিমেষেই স্বর্গের অপ্সরী হয়ে যায়! ইমিটেশন আর খাঁটি সোনার মাঝের ফারাকটা সহজেই বোঝা যায় না। তাই এমন দুঃসাধ্য সাধন করার দুঃসাহস আমার কখনো হয়নি। কিন্তু মেয়েটাকে দেখার পর সেই ভীরু আমিই যেন খুব দুঃসাহসী হয়ে উঠলাম। লোকলজ্জ্বা উপেক্ষা করে বাসের খোলা জানালা দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটার দিকে। টিকেটের জন্য মেয়েটা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তিরা মহাসমারোহে ফুটবল খেলছে। কোনরকমে বাসের একটা সিট দখল করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারলেই সে বেঁচে যায়। মেয়েটাকে বিরক্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে গেলাম। আগ বাড়িয়ে বললাম,-
‘এক্সিউজ মি! আমার কাছে এক্সট্রা একটা টিকেট আছে। সঙ্কোচ না করলে নিতে পারেন।’
করুণ চোখে তাকালো মেয়েটা। আমিও বিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকলাম। এতো করুণ করে কখনো কেউ তাকিয়েছে কিনা আমি জানি না। বুকের বাম পাশটা ধকধক করে উঠলো। দীর্ঘদিন অচল পরে থাকা হৃদয় নামক যন্ত্রটা বুঝি এবার স্টার্ট নিয়েই নিলো! আমি তাকিয়ে থাকলাম। অপলক!
মুগ্ধতা শব্দটির মর্মার্থ নতুন করে উপলব্ধি করলাম। মনে হলো ডাগর কালো চোখের মায়াবী ফাঁদ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সমূহ বিপদ জেনেও আমার সেই ফাঁদটায় আটকে যেতে ইচ্ছে করছে। ঐ মায়ার সাগরে গা এলিয়ে চুমচুম করে ডুবে যাওয়ার জন্যই যে আমার জন্ম! আমি চোখ বুজলাম।
অতঃপর ম্লান হাসলো মেয়েটা। বিনয়ের সাথে মাথাটা ডানে বামে ঘুরালো। হালকা অপমান বোধে আক্রান্ত হলাম। মেয়েটাকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে এক পা সামনে অগ্রসর হলাম। বা হাতে টিকেটটা পেছন দিকে এগিয়ে দিয়ে যথাসম্ভব গম্ভীর মুখে বললাম, -
‘টিকেট টা নিলে আমার বড়ই উপকার হয়। বন্ধুর জন্য কেটেছিলাম। ও যাবেনা...’
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম। টিকেট স্বস্থানেই রইলো। হাত ফিরিয়ে নিতে যাব এমন সময় টিকেটে মৃদু টান অনুভব করলাম। আলতো করে ছেড়ে দিলাম টিকেট টা। কোমল স্বরে বললাম, আসুন...
(২)
কুয়াশাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এগিয়ে চলছে বাস। আমার পেছনের সিটে বসেছে মেয়েটা। দুই ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। একটা টু কথা হয়নি মেয়েটার সাথে। কয়েকবার কথা সাজিয়ে নিয়ে বলতে গিয়েও স্বরতন্ত্র বিকল হয়ে গেছে।
- আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো আপনি কে?
- অদ্ভুত তো!
- অদ্ভুত হোক বা তেঁতুল গাছের ভূত যেই হোক না কেন এখানে তাদের কেউ নেই! আপনি প্রশ্নের উত্তর দিন।
- বাধ্য নই...
- তাহলে অবাধ্য হয়েই উত্তর দিন!
- উত্তর উত্তর উত্তর! খুশি?
__________
- আপনার চোখগুলো অনেক সুন্দর! জলপাই চেরা চোখ!
- মানে?
- অতি সহজ! একটা স্বাস্থ্যবান জলপাইকে লম্বভাবে দ্বিখন্ডিত করলেই আপনার চোখ পাওয়া যাবে।
- আর কিছু?
- হ্যাঁ। জলপাই এর মাঝে অবশ্য দুইটা কালো রঙয়ের মার্বেল বসিয়ে দিতে হবে!
- আপনি কি ছোটবেলায় খুব মার্বেল খেলতেন নাকি?
- হুম। খুউউব! খেলবেন?
________________
- কোথায় যাচ্ছেন?
- বাসায়
- বাসাটা কোথায়?
- আপনি কি টিকেটের টাকা খোয়া যাওয়ার ভয় করছেন?
- মোটেই না!
- মোটেই হা! আপনার মন এতো ছোট কেন? দিন আপনার বিকাশ নাম্বার দিন!
- বিকাশ করবেন? (খুশিতে আটখানা হয়ে)
তো?
- ০১৭... আমার বিকাশ একাউন্ট নেই!
____________
(৩)
গন্তব্যের আর বেশী দেরী নেই। একটু পরেই সুরসুর করে সব যাত্রী নেমে যাবে। তার আগেই যা করার করতে হবে। বুকে সাহস সঞ্চয় করে মাথাটা যথাসম্ভব পেছন সিটের কাছাকাছি নিয়ে বলে ফেললাম-
‘কোথায় নামবেন আপনি?’
ভরাট কন্ঠে উত্তর এলো - ‘মাসকান্দা!’
তড়িৎ বেগে দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরে তাকালাম। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দাঁত কেলিয়ে বসে আছেন! ভদ্রলোক তার পানখাওয়া লালচে দন্তগোষ্ঠী প্রদর্শন করে বললেন-
‘খুচরো টাকা নেই বাবা! বাস থেকে নেমে টাকাটা দেই?’
বুকের বাম দিকটায় খট করে একটা শব্দ হলো। ম্লান হেসে বললাম, ‘আপনার যা মর্জী!’