জানালার পর্দাটা একটু আগেই সরিয়ে দিয়ে গেছে হিয়া। দিনরাত শুয়ে শুয়ে ঘরের সিলিং ফ্যানের গতি মাপার চেয়ে বাহিরের খোলা আকাশ দেখা ঢের ভালো। পশ্চিমের দেয়ালে বত্রিশ ইঞ্চ এর একটি বড় এলইডি টিভি সাঁটানো আছে। গত দু’দিনে এক মুহুর্তের জন্যও অন হয়নি ওটা। ইদানীং ঘরের জানালাতেই টিভি দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন আনাম সাহেব। জানালার পর্দাটা টেনে দিলেই টিভি অন হয়। কোন অনুষ্ঠান সূচি নেই, কোন নামীদামী মডেল নেই, বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের বিরক্তিকর প্যানপ্যানানি নেই। জগতের যাবতীয় কৃত্রিমতা বিবর্জিত ঝক্ঝকে রঙিন টেলিভিশন! রিমোট কন্ট্রোলারের বাটনের চাপে নয়, সৃষ্টিকর্তার খেয়ালে টিভিস্ক্রিনে পরিবর্তন আসে। একটা ক্ষুধার্ত শহুরে কাক তার কর্কশ কণ্ঠকে পুঁজি করে খাবারের খোঁজে দিগ্বিদিক ছুটছে। আনাম সাহেব তাকিয়ে আছেন টিভির উন্মুক্ত স্ক্রিনে। বিমুগ্ধ চোখে কাকের ওড়াউড়ি দেখছেন তিনি। কাক আর মানুষের ছুটে চলায় পার্থক্য কোথায়? জীবনের প্রয়োজনে কাকের মতই তো দিগ্বিদিক ছুটছে সবাই।
নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই অসুস্থ্য মানুষ মৃত্যু নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন। আনাম সাহেবের মতো সাধারণ মানুষ এর ব্যতিক্রম হবেন কেনো? তিনিও ভাবছেন। যদি এই মুহুর্তে আনাম সাহেব হুট করে মরে যান তবে কি তার খুব কষ্ট হবে? ডান হাতের ধারালো নখ দিয়ে বাম হাতের নরম চামড়ায় সজোরে চিমটি কাটলেন আনাম সাহেব। মৃদু আর্তনাদের সুর স্বয়ংক্রিয় ভাবে বেজে উঠলো তার ভোতা স্বরতন্ত্রে! চিমটির দাগ বসে গেছে। লাল হয়ে গেছে যায়গাটা। আরেকটু সুযোগ পেলেই খয়েরী-লাল রঙয়ের বিদ্রোহী রক্তকণিকার দল ফিনকি দিয়ে হয়তো বেড়িয়ে আসতো। একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললেন তিনি। ব্যাথা! ব্যাথার অনুভূতিতে কোন ভাগ চলে না। সেটা তুচ্ছ চিমিটির ব্যাথাই হোক আর ভয়ঙ্কর মৃত্যু যন্ত্রণাই হোক! নিজের চোখ বুজে, নিজের দাঁতে দাঁত চেপে, সব নিজেকেই সইতে হবে!
শিমুল তুলার তোশকে শুয়ে মৃত্যুর জন্য মানুষিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন আনাম সাহেব। আচ্ছা ধরা গেলো আনাম সাহেব মরে গেছেন। তারপর কি হবে? সবাই কি হাউমাউ করে কাঁদবে? নাকি আবেগের প্রাচুর্যতায় প্রথমে হাউমাউ, আবেগে ঘাটতি পড়লে ফুপিয়ে ফুপিয়ে তারপর আবেগ শেষ হয়ে গেলে মায়াকান্না কাঁদবে? মানুষের শোক বরাবরই ক্ষণস্থায়ী। যারা বলে শোক আজীবনের, তারা একপ্রকার জোর করেই শোক জিইয়ে রাখার মিথ্যে অভিনয় করে। আনাম সাহেবের এ ব্যাপারে বিস্তর ব্যবহারিক জ্ঞান আছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইমরান দু'বছর আগেই রোড এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে। ইমরানের ছিন্ন ভিন্ন লাশ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন আনাম সাহেব। অনেক দিন রাতে ঘুমের সাথে ঠিকভাবে সাক্ষাৎ হয়নি তার। তারপর সময়ের লমে ক্ষত শুকিয়ে গেছে। তবে দাগটা রয়ে গেছে এখনো। ইমরানের ছিন্নভিন্ন মুখটা মাঝে মাঝেই মানসপটে ভেসে ওঠে আনাম সাহেবের। অস্ফুট শব্দে একটা দীর্ঘঃশ্বাস বেড়িয়ে যায় নাকের ফুটো দিয়ে। হয়তো একদিন আনামের সাহেবের মৃত্যুটাও এমন হাউমাউ কান্না থেকে প্রায় শব্দহীন দীর্ঘঃশ্বাসে বদলে যাবে।
আদৌ কি কেউ কাঁদবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশ খানিকটা সময় নেন আনাম সাহেব। মানুষের তো কাঁদার জন্য মা, বাবা, ভাই, বোন, বউ, বাচ্চা কত লোকেই না থাকে। আনাম সাহেবের কে আছে? রিতা! রিতা কি কাঁদবে? রিতার সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো শিশু পার্কে। দুবছর আগে। ওর সাথে ছিলো চার-পাঁচ বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। মেয়েটা নাকি রিতারই। মন খারাপের দিন গুলিতে আনাম সাহেব মাঝে মাঝেই শিশুপার্কে যেতেন। তন্ময় হয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কী সারল্য ওদের চেহারায়, কী নিষ্পাপ চাহনি ওদের! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়, অনভ্যস্ত ঠোঁটও অলৌকিকভাবে দুদিকে প্রসারিত হয়। আনাম সাহেবের মন ভালো হয়ে যেতো।
রিতা দাঁড়িয়ে ছিলো ট্রেনের লাইনে। শক্ত করে চেপে রেখেছিলো অবাধ্য মেয়েটার হাত। আনাম সাহেব ছিলো রিতার ঠিক সামনে!
- আনাম তুমি! তুমি এখানে কি করছো?
- লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।
- দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে কেন?
- ট্রেনে উঠবো। “রেল গাড়ি ঝমাঝম্! পা পিছলে আলুর দম!”
- বুড়ো বয়সেও বাচ্চামি গেলো না!
- কয়লা ধুইলে কি আর ময়লা যায়?
... ... ...
সেদিন আর ট্রেনে ওঠা হয়নি আনাম সাহেবের। লাইন ছেড়ে দিয়ে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে বেশ খানিকটা ভালো সময় কেটেছিলো আনাম সাহেবের। কালের বিবর্তনে ভালোবাসার বৃক্ষে ফুল আসে, ফল আসে, সেই ফলও একসময় টুপ করে ঝরে পরে কিন্তু গাছটা নাকি গাছই থেকে যায়। ‘কে রান্না করে? কখন ঘুমাও? কখন ওঠো? এতো শুকাইছো কেনো? মরার ইচ্ছা আছে নাকি? মাইর চিনো মাইর??’ ছলছল চোখে করা প্রশ্নকর্ত্রীর এসব জটিল প্রশ্নের উত্তর আনাম সাহেব এখনো খুঁজে বেড়ান। সেই প্রশ্নকর্ত্রী রিতা বেগমের চোখ কি আনাম সাহেবের মৃত্যু সংবাদে প্লাবিত হবে?
সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আনাম সাহেবের। রিতার বিয়ে। সেদিনই আনাম সাহেবের একটা চাকুরির ইন্টার্ভিউ এর তারিখ পড়ে গেলো। অনেক কাঠ খড়ি পুড়িয়ে এতদিনে এই একটা চাকুরীর ভাইভা অবধি পৌঁছতে পেরেছেন তিনি। সারারাত দোটানায় ছিলেন। রিতার শক্ত বারণ ছিলো। সুযোগ সব সময় আসে না। ভাইভাটা যেন কোন ভাবেই মিস না করে আনাম সাহেব। আনাম সেদিন রিতার বারণ শোনেননি। সকালে উঠেই চেপে বসেছিলেন বাসে সিটে। রিতা ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলো। নতুন বউয়ের লজ্জ্বাবনত দু’চোখ সেদিন বিস্ফোরণ দেখেছিলেন আনাম সাহেব।
‘আনাম তোমার ভাইভা???’
‘পিছিয়েছে’... একগাল হেসে সাবলীল শব্দে শতভাগ একটা মিথ্যে বলেছিলেন আনাম সাহেব। মিথ্যেটা এখনো সত্য হিসেবেই জানে রিতা বেগম।
খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো রিতা আর আনাম সাহেবের। হুট করে চোখের পলকে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব নয়। দশ বছর ধরে সুখ দুঃখের অদৃশ্য ইটে তিলে তিলে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব। ভেঙে গেছে। একদিনের তুমুল ভূমিকম্পে হুড়মুড় করে ভেঙে গেছে রিতা আর আনাম সাহেবের বন্ধুত্বের সুরম্য অট্টালিকাটা। মর্ত্যের মানুষের কি সাধ্য আছে ভূমিকম্প ঠেকানোর? গভীর রাতে কেঁপে উঠেছিলো মোবাইলটা। কথোপকথন টা মিষ্টি কথা দিয়ে শুরু হলেও শেষটা বেশ তিক্ত ছিলো। আপন সাহেব চাননা তার বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে কেউ এতো গভীরভাবে মিশুক। দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছিলেন। আনাম সাহেব কথা রেখেছিলেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লগ স্কেলে দূরত্বের সম্প্রসারণ ঘটেছে। একটা সময় পর প্রতিটি মানুষই কারো না কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বহিরাগত উটকো লোকজনের অনধিকার চর্চা দৃষ্টিকটুই বৈকি!
জগতের সকল রিতা বেগম স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকুক। সব অসুখ বাসা বাঁধুক আনাম সাহেবের শরীর জুড়ে, মনের সুখ পাখিটা কালো কাক হয়ে জানলা দিয়ে দূরে কোথাও উড়ে যাক। উরন্ত কাকে সুখ খুঁজুক আনাম সাহেব।
একগ্লাস পানি ও মুঠোভর্তি ওষুধ নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে হিয়া। আনাম সাহেব এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তার জানালা টিভির উন্মুক্ত স্ক্রিনে। টিভি স্ক্রিনটা ছাই রঙয়ের মেঘে ছেয়ে গেছে। থেকে থেকে ছাই রঙ ছাপিয়ে তীব্র আলোর ঝলকানী চোখে এসে বিঁধছে আনাম সাহেবের। এ তীব্র আলোটা এখন খুব দরকার আনাম সাহেবের!
‘স্যার ওষুধ গুলো খেয়ে নিন!’
‘কি লাভ তাতে? মরেই তো যাবো!’
‘জীবনটা তো এখনো আছে। খেয়ে নিন। মরে গেলে আর জোর করবো না!’
হিয়ার সরল কৌতুকে হো হো করে হেসে ওঠেন আনাম সাহেব।
‘স্যার, ম্যানেজার সাহেব ফোন করেছিলেন। আপনার ছুটি নাকি শেষ হয়েছে...’
‘ছুটির কি আর শেষ আছে। চাকরিটা আমি ছেঁড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি হিয়া...’
‘সে কী! তাহলে তো আমার চাকরিটাও তো যাবে!’
‘সেটা তো এমনিও যাবে। বায়াপসির রিপোর্টটা এলেই সব আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে...’
রিপোর্টের কথা শুনে সম্বিৎ ফেরে হিয়ার। ঘন্টা খানেক আগে একটা ফোন এসেছিলো। রিপোর্টের কথাই বলছিলো মেয়েটা। পত্রিকা অফিসের ফোন ভেবে কেটে দিয়েছে হিয়া।
আনাম সাহেবের দৃষ্টি এখন মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে আছে। রিপোর্টের স্ক্যান কপি মেইলে পাঠানোর কথা ছিলো। পাঠিয়েছে।
বজ্রপাতের তীব্র শব্দে কেঁপে উঠলেন আনাম সাহেব। আনাম সাহেবের জানালা টিভিতে এখন বৃষ্টি হচ্ছে। ছাই রঙএর মেঘ গলে স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। অবাধ্য দমকা বাতাস সেই স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিকে আনাম সাহেবের ঘর অবধি পৌঁছে দিচ্ছে। মোবাইল স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই হিয়াকে জানালাটা বন্ধ করে দিতে বললেন আনাম সাহেব।
উদ্বিগ্ন মুখে আনাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে হিয়া। মোবাইলটা বিছানার পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আনাম সাহেব।
‘আজ খিচুড়ি রাঁধতে পারবে হিয়া? এমন বৃষ্টির দিন খিচুড়ি ছাড়া কি সেলিব্রেট করা যায়?’
হিয়ার চোখ ছলছল করে ওঠে।
‘স্যার, রিপোর্ট?’
ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠেন আনাম সাহেব।
‘ভয় নেই। তোমার চাকরীটা আপাতত যাচ্ছে না। যাও তুমি খিচুড়ি রাঁধো গে!’
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৩৮