'আপ্নের গা'ডা মেলা গরম। রাইতে ঘুমান নি। এই শ'ইল(শরীর) লই গাড়িতে যাওনের দরকার নাই'
বউ'র কথা কানে না নিয়ে কলিম আলী শার্ট খুজে, প্যান্ট খুজে। মেয়েরে ডেকে ডেকে জিগায়, তার বাদামি ফুলহাতা শার্ট'টা বারান্দার বাশে ঝুলানো আছে কি না? কালোরঙের প্যান্টটা কই?
মেয়ে শার্ট-প্যান্ট এনে দিলে আস্তে আস্তে গায়ে লাগায়। তেলচিটে বালিশের নিচ থেকে মানিব্যাগ পকেটে ঢুকায়।
সখিনা রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে আবারো বলে- 'কাইল তো কইলেন ভালো ইনকাম হইছে। আইজ এই শরীল লই যাওনের কি দরকার।'
শুনে মেজাজ খারাপ হয় কলিম আলীর। বেকুব মহিলা। সংসার কেমনে চলে সেই হিসেব নেই। তার ইচ্ছে করে রান্নাঘরে গিয়ে সখিনার কান বরাবর কষে একটা থাপ্পড় দিতে। কিন্তু কলিম আলী রান্নাঘরের দিকে যায়না। সে শোবার ঘরের দুয়ার পর্যন্ত গিয়ে, খিটখিটে মেজাজে বউকে শাসায়। বলে, ''সকাল থাইক্যা ক্যাটক্যাট করিস ক্যান?! কথা কানে যায়না?! কইলাম না আইজ ভালো একডা খেপ আছে।''
সখিনা আর কথা বাড়ায় না। জারুলের আধকাঁচা ডাল চুলোয় গুঁজে বাশের চুজ্ঞা দিয়ে বাতাস করতে থাকে; আর খিটখিটে কণ্ঠে মেয়েকে ঝাড়ি দে- ''নবাবের বেটি চৌকে(চোখে) কোনো কাম দেখেন না। কাইল এতো কইরা কইলাম, ভেজা লাকড়িগুলা রোইদে দে। দিলোই না। কামের বেডির কথার তো কোনো দাম নাই!''
বউ'র বাধাবিপত্তি হাউকাউ উপেক্ষা করে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে কলিম আলী। শব্দ শুনে সখিনা চুপিচাপি রান্নাঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা প্রতিদিনকার মতো কলিম আলীর সাথে সামনের সিটে এসে বসে।
কলিম আলী লুকিং গ্লাসে 'দুয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সখিনাকে' দেখে। সখিনার ভালোবাসা তাকে মুগ্ধ করে। নৈঃশব্দ্যে পিছুডাকে। কিন্তু সে ওসব পাত্তা দেয় না।
বউ বাচ্চার কথায় কান দিয়ে কাম কামাই দেওয়ার কপাল নেই তার। পরের গাড়ি চালায় সে। মাস শেষে মালিককে গুণেগুণে ২০,০০০ টাকা দিতে হয় তার।
২
বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে, মুল্লাপুর যাত্রী ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানদোকানি সাথে গালগল্প করছিলো মুখলেছ। হর্ণ বাজতেই, দৌড়ে এসে সালাম দিয়ে খিল্লিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, 'ওস্তাদ পান লন, স্পেশাল রেডলিফ দিয়া আনছি।'
পান খাওয়ার মুড নেই কলিম আলীর। তবুও খিল্লিটা নিয়ে বুকপকেটে পকেটে রাখতে রাখতে মুখলেছরে জিগায়- 'মুখলেছ সকালে কিছু খাইছে কি না?! মুখলেছ ভেটকি মেরে জবাব দেয়, 'খাইছি ওস্তাদ। চা পান, সিগারেট....'
কিছুক্ষণ লর কলিম আলী বলে- আয় চান মিয়ার হুটেলে ডাল পরোটা খাইয়া যাই। লাম্বা খেপ। মেলা দূর যাওন লাগবো।
মুখলেছ সায় দেয়।
ঘন্টাখানেক পর:
মালবোঝাই গাড়ি গন্তব্য অভিমুখে এগিয়ে চলছে। মুখলেছ বিভিন্ন বিষয় আসয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করছে। কলিম আলী নীরবে বসে বসে মুখলেছের প্যাঁচাল শুনছে। মুখলেছ কলিম আলীর হেলপার। গাড়িতে পণ্য ওঠানো, নামানোর কাজে সে বেশ দক্ষ। গাড়িও মোটামুটি চালাতে জানে। কলিম আলী চাইলে এতোদিনে পাক্কা ড্রাইভার হয়ে যেতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কলিম আলী চায় না মুখলেছের প্রমোশন হোক। আসলে কোনো ড্রাইভারই চায়না তার হেল্পারটা ড্রাইভার হয়ে যাক। এটা ড্রাইভারদের একটা সহজাত প্রভৃতি।
মুখলেছের অবশ্য এটা নিয়ে তেমন দুঃখ নেই। কারণ তার সমপর্যায়ের সব হেলপারদেরই একি দশা। ওস্তাদদের মুড ভালো থাকলে তারা সাপ্তাহে দুএকবার চান্স পায়। তবে অন্যান্য ওস্তাদদের(ড্রাইভার) তুলনায় কলিম আলীর মুড একটু বেশিই ভালো থাকে। মুখলেছ এটাকে তার পরম সৌভাগ্য মনে করে।
৩
মালপত্তর গন্তব্যে পৌছিয়ে ফেরার পথে কলিম আলী লক্ষ্য করে, ক্রমাগত তার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। চোখের সামনে নৃত্য করছে সরিষার হলুদ, ঝাপসা ঝাপসা অন্ধকার। হাত-পাগুলোও তার কথা শুনতে চাইছে না।
তাই সে গাড়িটা বামে সাইড করে মুখলেছের কাছে জানতে চায়- মুখলেছ গাড়ি চালাইতে পারবে কি না? মুখলেছ মাথা নেড়ে নেড়ে জানায়, পারবে।
বুক পকেট থেকে তিন চারটে ট্যাবলেট পানি দিয়ে টকটক করে গিলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কলিম আলী। ভাগ্যিস, সকালে দেবা বাবুর ফার্মেসি থেকে ট্যাবলেটগুলা নিয়েছিলো। এবং মুখলেছও গাড়ি চালাতে জানে....
মিনিট পাঁচেক পর, আল্লাহর নাম নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট করে মুখলেছ। কলিম আলী পাশে বসে গাইড করে।
তারা যখন বাড়িতে এসে পৌছে প্রকৃতিতে তখন মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে।
গাড়ির শব্দ শুনে ঘরের ভেতর থেকে কলিম আলীর মেয়েটা দৌড়ে আসে। মেয়েকে দেখে কলিম আলীর মনে পড়ে- সে সকালে বলে গিয়েছিলো রাতে ফেরার সময় দাসবাজারের পিয়াজু, জিলাপি নিয়ে আসবে।
কলিম আলী মেয়েকে দেওয়া কথা যথাসাধ্য রাখবার চেষ্টা করে। আজ যেহেতু পারেনি! তাই তার মন খারাপ হয়। কয়েক ফোটা জল চোখ ফেটে বের হয়ে আসতে চায়!
মুখলেছের কাঁধে ভর করে বাবাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে মেয়েটা পিয়াজু, জিলাপির কথা ভুলে 'মা'কে ডাক দেয়। সখিনা বাইরে এসে কলিম আলীকে দেখে হাউকাউ শুরু করে- 'সকালে কত করে বলেছিলো, আজ বাইরে যাওয়ার দরকার নেই; কিন্তু কেউ তার কথার গুরুত্ব দেয়নি।'
কলিম আলী চুপ করে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে সখিনার হাউকাউ শুনে। সখিনা ক্যাটক্যাট করতে করতে কলিম আলীর মাথায় পানি ঢালে, জলপট্টি দেয়...
জিজ্ঞেস করে কিছু খাবে কি না। কলিম আলী মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে 'না'; সে সুস্থ আছে, ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কলিম আলীর চোখে কিছুতেই ঘুম আসেনা। নৈসর্গিক নিয়মে বেলা বাড়ে। বাড়ে - সখিনা আর কলিম আলীর সংসার জীবনের অন্যরকম যন্ত্রণার একটি বিশ্রী রাত.....
পাদটীকা:
* ছবিগুলো অন্তর্জল থেকে নেওয়া। আমাদের এলাকার কলিম আলীরও (ছদ্মনাম) ২ম ছবির মতো একটা টয়োটা পিকআপ আছে
* নিউজপোর্টালে দেখলাম, অবস্থা আশংকা জনক হওয়ার আমাদের এলাকার এক ড্রাইভারকে গতকাল ওসমানীতে ভর্তি করা হয়েছে। ড্রাইভারের খুজখবর নিয়ে গল্পের মতো করে লিখবার চেষ্টা করলাম।
* ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আজ সারাদেশে ডাক্তারসহ আরো ৪ জন মারা গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৪