somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বাড়ি'র বইয়ের মেলায়...

২২ শে জুলাই, ২০২২ দুপুর ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমার জীবনে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো বসন্ত (এক্স্যাক্ট নাম্বার টা বললাম না, সিনিয়র সিটিজেনের কাতারে ফেলে দিতে পারে লোকজন), বেশ কিছু প্রেম (প্রায় সবগুলোই সফলতার সাথে ছ্যাকা খাওয়া), একটা বউ (এখন পর্যন্ত আছে) আর তিনটা বুকশেলফ এসেছে। যেহেতু গল্পটা বুকশেলফ নিয়ে তাই বাকি গুলোর ডিটেইলস বলাটা আজ ঠিক হবে না।

বুকশেলফ নাম্বার ওয়ান -

বুকশেলফ নিয়ে গল্প বলতে হলে শুরুতেই বলতে হবে - সে এক বিরাট ইতিহাস। আমার পরিবারের সবাই, আই মিন সবাই ছিলো বই পড়ুয়া। এই "বদ অভ্যাস" টা তাই জিনগত বলা যায়। আমার মা খালারা স্কুল কলেজে দারুণ রেজাল্ট করে বই টই পেয়ে অস্থির হয়ে যেত, পড়ার বইয়ের পাশাপাশি সারাদিন ঘরের কাজ করতো আর বই পড়তো। এক খালা'র মাথায় ছিল বড়লোকের বেটির মত লম্বা লম্বা চুল। বইয়ের নেশায় তার চুলের যত্ন নেয়ার সময় হতো না। তাই হলুদ গেন্দা ফুলের বদলে এক সময় তার মাথায় জায়গা করে নিলো কালো কালো উকুন। শেষে বিরক্ত হয়ে একদিন সেই খালাম্মা তার দীঘল কালো ঝর্ণার মতো চুল গুলো ফেলে দিলো। তার কাছে বই আগে, চুল পরে। আমাদের পরিবারে প্রচলিত মিথ, খালার মাথার সেই উকুন গুলোও নাকি শেষের দিকে এসে নিজেদের নাম লিখতে পড়তে পারতো। আর ছোট মামা ছিল আরেক পাগল। সে তার জীবনের ৯০ ভাগ সময় পার করেছে বসার ঘরের সোফায় কাত হয়ে শুয়ে, হাতে বই নিয়ে।

সেই আমলে অত্যন্ত আধুনিক ডিজাইনের একটা বুকশেলফ আমার মা, মামা, খালা'রা তাদের জমানো বৃত্তির টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আমার নানাবাড়ীতে। চারদিকে বই রাখার খোপ, আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, শেলফ টাকে চারপাশেই ঘোরানো যেত !!

আমার শৈশবের সবচে আনন্দময় সময় কেটেছে আমার নানাবাড়ীতে। স্কুল ছুটি পেলেই চলে যেতাম সেখানে, আর ঝাঁপিয়ে পড়তাম সেই বুকশেলফে। আর দাদাবাড়ীতে গিয়ে পেতাম আব্বার নিজস্ব কালেকশন গুলোকে। কত বিচিত্র স্বাদের, বিচিত্র বর্ণের, দেশী, বিদেশী বইয়ের যে সমাহার ছিলো সেখানে, বলার বাইরে। সেবা'র বই, কলকাতার বই, সোভিয়েত বই !! আমি লোভীর মত বুকশেলফ গুলোতে হামলে পড়তাম, কোনটা রেখে কোন টা পড়ি !! আহা শৈশব !!

বুকশেলফ নাম্বার টু -

ক্লাস ফাইভ আর এইটে বৃত্তি পেয়েছিলাম৷ স্কুলের বেতন মাফ !! আম্মা ওই জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা দিত পছন্দমত কিছু কেনার জন্য৷ আমি ছোট মামার হাত ধরে চলে যেতাম নারায়নগঞ্জ ডিআইটি মার্কেটের বইয়ের দোকান গুলোতে৷ মনের সুখে খুজে খুজে বই কিনতাম, গোয়েন্দা বই, রূপকথার বই, কমিক্স আরো কত কি !! স্কুলে যাওয়ার রিকশা ভাড়া আর টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিনতাম সেবার অনুবাদ আর তিন গোয়েন্দা।

ইন্টারে আমার কলেজ ছিলো তীর্থস্থান নীলক্ষেত থেকে একদম হাটা দূরত্বে৷ সিটিং সার্ভিসের বদলে লোকাল বাস, রিকশার বদলে টেম্পু, বাসের বদলে ট্রেন, নাস্তার বদলে বাদাম, লাঞ্চে পাউরুটি ডুবিয়ে চা - এভাবেই টাকাগুলো জমতো আর আমি ছুটতাম নীলক্ষেতে৷ ঘন্টার পর ঘন্টা নতুন পুরান বইয়ের ঘ্রানে বুঁদ থেকে কিছু বই কিনে তৃপ্তি করে দুইটা রসে ভেজানো জিলাপী খেয়ে মনে হোত, আহা এই তো জীবন !!

তারপর ভার্সিটি আর ট্যুশনি !! আমার জীবনের আনন্দের খোরাক তখনো সেই বই৷ নীলক্ষেত থেকে নিউমার্কেট, শাহবাগ, আজিজ !! কত সময় পার করেছি এই প্রিয় জায়গাগুলোতে শুধু বই দেখে দেখে !! হেটে হেটে চলে গেছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে৷ ঘাম আর ক্লান্তি উবে যেত বই হাতে নিয়েই৷

প্রথম চাকরিতে জয়েন করার আগে আম্মা দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন নতুন শার্ট প্যান্ট কিনতে৷। আমি সেই টাকা দিয়ে একগাদা নতুন বই নিয়ে ফিরেছিলাম বাসায়! সারা বছর টাকা জমাতাম বইমেলার জন্য৷ পাচ সাত হাজার টাকার বই কিনে দুই হাতে ধরে বুকের সাথে চেপে বই নিয়ে বাড়ি ফিরতাম !! কি আনন্দের ছিল সেই যাত্রা !!

আমার নিজস্ব কোন বুকশেলফ তখনো ছিলো না। তাহলে বইগুলো রাখতাম কোথায়? আমার এক খালার ব্যাক্তিগত বুকশেলফে, উনি ডাক্তারি পড়তে দেশের বাইরে চলে যাবার সময় আম্মাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি আম্মার পুরোন বইগুলোকে নিচের তাকে ভাগিয়ে দিয়ে আমার বইগুলোকে সাজিয়ে রাখতাম উপরে।

একসময় এত বই হয়ে গেল যে, বুড়ো হাড়ে এত ওজন আর সইতে পারছিলো না সেই বুকশেলফটা। বইয়ের ভীড়ে বাতাস ঢোকার জায়গা ছিলনা আর সেখানে। শেলফটার পায়া নড়বড়ে হয়ে গেল, আওয়াজ হতো ক্যাঁচ ক্যুচ করে। কিন্তু নতুন শেলফ কেনার মত টাকা আর বাসায় জায়গাও ছিলনা তখন।

বুকশেলফ নাম্বার থ্রি -

নতুন চাকরি আর নতুন বউ - দুইটাই একসাথে পেয়ে জন্ম শহর নাঃগঞ্জ ছেড়ে চলে আসলাম ঢাকায়। নতুন বাসায় উঠেই প্রথমে যে ফার্নিচার টা কিনলাম, তা হলো নতুন একটা বুকশেলফ। বসুন্ধরা সিটির অপজিটের ফার্নিচার মার্কেট থেকে ছয় ফিট বাই চার ফিটের মেলামাইন বোর্ডের চমৎকার একটা বুকশেলফ। পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিল। প্রায় নয় বছর আগের কথা বলছি। ছবিগুলোতে যে শেলফ টাকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন, জ্বী, এটাই সেই বুকশেলফ। যদিও এই ছবিগুলোও তিন বছর আগের।

নতুন বাসায় মা, বউ ঘর সাজায়, আর আমি বুকশেলফ সাজাই। একবার জনরা অনুযায়ী সাজাই, আরেকবার লেখক অনুযায়ী। একবার সাইজ অনুযায়ী তো আরেকবার প্রচ্ছদের কালার অনুযায়ী সাজাই। মনস্থির করতে পারি না, অস্থির লাগে, খাওয়ার রুচি চলে যায়, ঘুম আসে না - বিরাট বিপদ। আব্বা, আম্মা আমাকে আগে থেকে চিনলেও নতুন বউ টেনশনে পড়ে গেল - এ কোন পাগল বিয়ে করলাম? অবশেষে বহু পারমিউটেশন, কম্বিনেশন করে একদিন মন মতো সাজাতে পারলাম সব বইগুলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বাসার সবাই৷

তবে বউয়ের সন্দেহ পুরোপুরি গেলো না! কারণ, আমি বউয়ের দিকে যতটা সময় তাকিয়ে থাকি, তারচে ঢের বেশি সময় আমি তাকিয়ে থাকি বইয়ের দিকে৷ মুগ্ধ চোখে ঘন্টার পর ঘন্টা আমি অপলক দেখতে থাকি আমার নতুন বউকে, থুক্কু বুকশেলফকে৷ ফলে বিয়ের মাস খানেকের মধ্যেই "আনরোমান্টিক গাবর" উপাধি পেয়ে গেলাম বউ'র কাছ থেকে৷

একসময় বেঁচে থাকার তাগিদে বউ আর বইয়ের মধ্যে সাম্যাবস্থা আনতে হলো। যদিও বউয়ের জন্য বরাদ্দ করা সময় থেকে চুরি করে বই কে দেই এখনো। পড়ার যথেষ্ঠ সময় না থাকলেও বই কেনা চলছে পুরোদমে। ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমার বুকশেলফ - ইতিহাস, বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধ, মিথ, থ্রিলার, ধ্রুপদী সাহিত্যের নানান জনরায়, দেশী, বিদেশী অসাধারণ বৈচিত্রময় আর দুষ্প্রাপ্য কিছু বইয়ের সমাহারে।

এখন আর তেমন জায়গা নেই এই শেলফটাতেও। নতুন আরেকটা আলমিরা কিনতে মন চাচ্ছিলো, কিন্তু জায়গার অভাবে মা হুমকি দিয়েছে, "'নতুন শেলফ কিনলে হয় তুই থাকবি বাসায়, নাইলে তোর বুকশেলফ !!" তাই আপাতত বাধ্য হয়ে সোফার নিচে কার্টনের ভেতর ভরে রাখতে হচ্ছে বইগুলোকে। কারণ, বাসা থেকে বের করে দিলে খাব কি?

শেষ কথা দ্যা ফাইনাল টক -

আমার জীবনে বই আর বইয়ের আলমিরা নিয়ে এত গল্প আছে যে লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে!! বাথরুমে লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়তে গিয়ে বেদম মার খাওয়া, বই পড়তে পড়তে রাস্তায় হাটার সময় রিকশার নিচে পড়া, বই হারানো, চুরি যাওয়া, বন্ধুদের সাথে বই নিয়ে কাড়াকাড়ি - এইরকম বহু বেদনাবিধুর ও আনন্দময় গল্পের সাক্ষী আমার বইময় জীবন!

শেষ কথা হচ্ছে, আমার এই লাইব্রেরীটা একদিনে হয়নি৷ শৈশব, কৈশোর,তারুণ্য আর যৌবন পার করছি আমি এই সংগ্রহের নেশায়৷ অনেক কষ্ট আর ঘাম জড়িয়ে আছে আমার এই গর্বের ধনের পেছনে৷

একটাই আশা, বইয়ের প্রতি ভালবাসার এই লিগ্যাসিটা একদিন বয়ে নিয়ে যাবে আমার উত্তরাধিকার....



সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০২২ দুপুর ১২:৫৫
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×