আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা সারা বিশ্বকে দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করছে। আর উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বে দেশগুলোতে পাশ্চাত্যকে অনুসরন করে চলা রীতিমতো জাতে ওঠা ব্যাপার। অথচ মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর ভোগবাদি মানসিকতা পাশ্চাত্যকে ক্রমেই অন্তসারশূণ্য খোলসে পরিণত করেছে। মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা সার্জনদের কাছে অনেক মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী আসে, যারা নিজেদের চুল ছিড়ে ভক্ষন করে, এমনকী পরিমাণ বেশি হলে নাড়ি পর্যন্ত আটকে যায়। কিন্ত সভ্যতার নামে পাশ্চাত্য সমাজ আজ যা গলাধঃকরন করছে, কদাচার লালন করছে, তাতে তারা জাতি হিসেবেই যে পুরোপুরি মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ, ভারসাম্যহীন জাতিতে রূপান্তরিত হতে চলেছে তাতে কোন সন্দেহ প্রকাশ করা চলেনা। সাম্প্রতিক পত্রিকার দুটো ভিন্ন ধর্মী সংবাদ আবারও তার প্রমাণ দিল। লেখাটি অনেক দিন আগের হলেও সময়ের অভাবে এডিটিং না করতে পারায় দেরী করেই প্রকাশ করতে হলো।
শিরোনাম ছিল রীতি মতো চমকে দেয়ার মতো,‘এবার পুরুষ মা’। খবরটি এরূপ; ওরেগনের সুখী দম্পতি টমাস ও ন্যান্সি। ন্যান্সির স্বামী টমাস এখন পাঁচ মাসের গর্ভবান (?) এতে তিনি দারুন খুশী। ন্যান্সি তার স্বামীর আদর যত্ন করছেন। নিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তারের কাছে। ভারী কাজ করতে দিচ্ছেন না। তবে পুরুষ টমাসের এই তাক লাগানো মাতৃত্বের পেছনে অন্য এবটা গল্প আছে। টমাস ট্রান্সজেন্ডার। অর্থ্যাৎ লিঙ্গ পরিবর্তনকারী। তিনি জন্মেছিলেন পুরোদস্তুর মহিলা হিসেবে। পরে আইন মেনে লিঙ্গ বদলে পুরুষ হন। বিয়ে করেন ন্যান্সিকে। আইনের বলে পুরুষ হলেও আগের স্বাভাবিক স্ত্রী জননাঙ্গ গুলো বাদ দেননি। আমেরিকায় লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পূর্ববর্তী জননাঙ্গ গুলো বাদ দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। চিকিৎসা শাস্ত্রের টেষ্টোষ্টেরন থেরাপি প্রযুক্তির সাহায্যে টমাস শারীরিক ভাবে পুরুষের পূর্ণতা লাভ করেন। একটি ওয়েব সাইটে টমাস সম্প্রতি লিখেছেন, সন্তান ধারনের স্বপ্ন নারী বা পুরুষের উভয়েরই থাকতে পারে। আমারও ছিল, এখনও আছে। আর সেকারনেই আমার স্ত্রী জননাঙ্গ অটুট রেখেছিলাম। এখন আমি পুরুষ হয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পাচ্ছি। এর চেয়ে আনন্দের, গর্বের আর কি হতে পারে। বছর কুঁড়ি আগে ন্যান্সি এন্ডোমেট্রিওসিসে (জরায়ুর রোগ) আক্রান্ত হলে তার জরায়ু কেটে ফেলতে হয়। এ কারনে ৪৫ বছরের ন্যান্সি সন্তান ধারনে অক্ষম। স্ত্রীর অক্ষমতা পুষিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করেন নি টমাস। সভ্যতার ইতিহাসে নাম লেখাতে তাই বিপ্লব ঘটাতে বদ্ধ পরিকর টমাস আর ন্যান্সি। কিন্তু টমাসের গর্ভে যে সন্তান বেড়ে ইঠেছে তার বাবা কে? সাহসী টমাস রহস্য উদঘাটন করেছেন- ক্লিনিকে কৃত্রিমভাবে তার গর্ভে অন্যের শুক্রানু প্রবেশ করানো হয়েছে (আমার দেশ,৪ঠা এপ্রিল)। যদি কোন সুস্থ বিবেক বোধ সম্পন্ন মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এ গল্প থেকে কি বুঝলেন? উত্তর হবে, হ-য-ব-র-ল। স্ত্রী বন্ধ্যা বলে স্বামী সন্তান ধারন করেছেন। প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে স্রষ্টার উপরে মানুষের কর্তৃত্ব স্থাপিত হতে যাচ্ছে? (নাউজুবিল্লাহ) আসলে রহস্যটা অন্য খানে, যা প্রকাশ করছে পাশ্চাত্যের অসংলগ্ন, বিকৃত মানসিকতাকে। দুই নারী পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন কৃত্রিম ভাবে নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। পুরুষ হবার স্বাদ মেটালেও আবার সন্তান ধারনের ইচ্ছা তার ছিল। আর তাই পুরুষ হবার পরও জরায়ু অক্ষত রেখে দেন। আমেরিকায় লিঙ্গ পরিবর্তন করতে লাইসেন্স করতে হয় তবে পূর্ববর্তী জননাঙ্গ গুলো বাদ দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। আবার সন্তানের পিতৃ পরিচয় অজানা, কারণ শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়েছে কৃত্রিমভাবে ক্লিনিকে। প্রতিটি বিষয়ই প্রশ্ন জাগানিয়া। অবাধ মেলামেশা বা সমকামিতা পাশ্চাত্যে নতুন কিছু নয়। কিন্ত একে ছাপিয়েও ন্যান্সি আর টমাসের ঘটনা জন্ম দিয়েছে নতুন ইতিহাসের, পাশ্চাত্য সমাজ যার জন্য গর্ব বোধ করে। কি অদ্ভুত!
এর দুদিন পরে একই পত্রিকায় আরো একটি ভিন্ন ধর্মী সংবাদ প্রকাশ হয়, গর্ভ ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন আমেরিকার নারীরা। সরোগেট মাদার শব্দটির সাথে নিশ্চয়ই
অনেকেরই পরিচয় আছে। খবরটির সারবস্তু এরকম যে, আমেরিকায় অনেক নারী এখন গর্ভ ভাড়া দিয়ে বছরে হাজার ডলারেরও বেশি আয় করছেন। এদের অনেকের স্বামী ইরাক যুদ্ধে নিয়োজিত। যেসকল দম্পতি নিঃসন্তান, তাদের কল্যানেই তারা এ সেবা সরবরাহের মাধ্যমে অর্থ আয় করছেন। এ জন্য তারা নিজের দেহে কৃত্রিমভাবে শুক্রাণু প্রতিস্থাপন করছেন। প্রয়োজনে গ্রহীতা দম্পতির পুরুষ সাথে শেয়ার করতেও কোন সমস্যা নেই। আমেরিকায় ক্রমেই এ নতুন আইডিয়া জনপ্রিয় হচ্ছে। অনেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন। দৃধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে আরো আছে ষ্পার্ম ব্যাঙ্ক, স্বামী বেচারা পুরুষত্বহীন হলেও চিন্তা নাই। ঐ ব্যাঙ্ক আপনার স্ত্রীকে স্পার্ম সরবরাহ করবে। কি চাই খেলোয়াড়, বিজ্ঞানী, নায়ক বা সেলিব্রেটি? সবার স্পার্মই আছে ভান্ডারে। কিন্তু বলুন দেখি, স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তানটি জন্ম নিল, সেটি কি সত্যিই স্বামীর বলে কোন দাবী থাকে?
অনেকেই হয়ত বলবেন, পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যদি কোন দম্পতি এ পন্থা বেছে নেয়, তাতে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা নৈতিকতার প্রশ্নে। সমাধান তো পালক.দত্তক নিলেই হয়ে যায়। যে সন্তানটি অন্যের গর্ভে জন্ম নিল, সেখানে মাতৃত্ব শুধু আইনের কথায়, কলমের খোঁচায় বদলে যাবে? জীবনের চরমতম কষ্ট স্বীকার করে, সন্তান গর্ভে ধারন করে যে নারী সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, তার কাছে অতুলনীয় মাতৃত্ব তবে কি শুধুই ব্যবসার উপকরন হতে চলেছে? মানবিকতা আর ভালোবাসার কোন মূল্য নেই? কোথায় মাতৃত্বের অপরিসীম হৃদয় ছোয়া স্নেহের পরশ? হায়রে পাশ্চাত্য সভ্যতা? পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে নারীর সবকিছু নিয়েই তারা আজ ক্ষান্ত হয়নি, মাতৃত্বকেও ব্যবসার উপকরনে পরিণত করেছে, যেখানে অর্থ সব কিছুর নিয়ন্তা। পাশ্চাত্য সমাজে না হয় এখন বাবার পরিচয় নেই, মায়ের পরিচয়ই সন্তানের পরিচয়। কিন্তু ভাড়া করা গর্ভে যে সন্তানটি জন্ম নেবে, তার প্রকৃত পরিচয়ই বা কি হবে?
যারা বলবেন এগুলো ভালো উদ্যোগ, আপত্তি কেন? তাদের জন্য বলব, সব ভালো উদ্যোগই যদি স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করে দেয়, প্রকৃতিকে অস্বীকার করে তাহলে তা বিপর্যয় সৃষ্টি ব্যতীত আর কিইবা করতে পারবে? আজকে কেন জলবায়ু নিয়ে এত মাতামাতি? কেন বন্য প্রানীদের বাঁচিয়ে রাখার এ আকুতি? কেন পাহাড়-টিলা, সবুজ বন আর বৃক্ষরাজি নিধনের বিরুদ্ধে এত শ্লোগান? সবই কি মানুষের জন্য নয়? প্রকৃতির কিছু বিধানকে মানুষের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা প্রয়োজন, নিজের স্বার্থেই। সৃষ্টিকর্তার একটি নিয়ম আছে। সবাইকে তিনি সমানভাবে সব সুযোগ দেননি। তেমনি সকল প্রাকৃতিক ও আধুনিক মাধ্যমে (টেস্টটিউব বেবি) সর্বত চেষ্টার পরেও অনেক দম্পতি সন্তান লাভ করতে পারবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। এটিই প্রকৃতির বিধান । চিন্তা করুন তো, মানুষ যেভাবে এজিং প্রসেসকে ঠেকানো চেষ্টা করছে, তা যদি ৫০ বছরে সফল হয়। তাহলে ১০০ বছর পরে দেখা যাবে পৃথিবীর অর্ধেকটাতে হাড়জিরজিরে, অক্ষম, রোগাক্রান্ত সব মানুষগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে? কেউ কেউ হয়তবা ১৫০/১৮০ বছর বয়সে পিতাও হচ্ছে। কি চমৎকার দৃশ্য। তাই মানবতার নামে প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বকে বিকৃতি করাটা কখনই শুভকর নয়। সুনামি, জলবায়ু বিপর্যয়, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, দুষণের জন্য যদি মানুষের বিধ্বংসী ভূমিকাকে দায়ী করা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতে হবে বিকৃতাচারের ভয়াবহ বিস্তারও মানব সভ্যতার জন্য আগামীতে অপ্রতিরোধ্য সুনামি বয়ে আনবে।
ফিরে আসা যাক আলোচনায়। অবৈধ মেলামেশা, লিভ টুগেদার পাশ্চাত্য সমাজে এখনও কোন অপরাধ তো নয়ই, বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত। আমেরিকায় একটি জরীপে দেখা গেছে, প্রায় আশি ভাগ নারী কিশোরী অবস্থাতেই, স্কুল জীবনেই কুমারীত্ব হারায়, যাদের অর্ধেকই পরবর্তীতে অবৈধ সন্তানের মা হয়। অবশ্য এতেও কোন সমস্যা নেই, কারণ পাশ্চাত্য সমাজে পিতৃ পরিচয়হীন শিশুর লালন পালনের ভার রাষ্ট্রের। ফ্রান্সের ৫০% নাগরিকের কোন পিতৃ পরিচয় নেই। এ কারনে তাদের পরিচয়, মায়ের পরিচয়ে। বাবা যেই হোক, মা তো ফিক্সড।
নারী পুরুষের অবাধ সম্পর্কেও তৃপ্ত নয় পাশ্চাত্য সমাজ। তাই এখন অবাধে চলছে সমকামিতা, সমলিঙ্গে বিবাহ। সমকামি নারী পুরুষ বিবাহের জন্য অনেক দেশে আইন পর্যন্ত করা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে এ বিকৃতাচার চালু থাকলেও সমলিঙ্গে বিবাহকে স্বীকৃতির দাবীতে পাশ্চাত্যের অনেক দেশে প্রকাশ্য রাজপথে চলেছে বিক্ষোভ। সমকামিরা অন্যদের উৎসাহ দেবার জন্য প্রতি বছরই অনেক দেশে ঘটা করে শোভাযাত্রা, র্যালী করে থাকেন।
এখন অবশ্য নারী পুরষের অবাধ সম্পর্ক বা সমকামিতাও পাশ্চাত্য সমাজে পুরোন হয়ে গেছে। তাই সব ছাপিয়ে নতুন এডিশন যোগ করতে এখন মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে, ভাই-বোন, পবিত্র সম্পর্ককেও ভোগের বাহনে পরিণত করেছে। অনেকেই হয়তো, ঘৃনায় মুখ বিকৃত করে ফেলবেন, ভাববেন অতিরঞ্জিত প্রলাপ। কিন্ত এতে বিন্দু মাত্র মিথ্যা নেই। বরং এটাই নির্মম বাস্তবতা। কোন অতল গহীনে পৌছেছে আজ তথাকথিত সভ্যতার ধারক বাহকরা? অবিশ্বাসের তীক্ষ ছুরি আজ এমনতর পবিত্র সম্পর্ককেও সন্দেহের বেড়াজালে ফেলে দিচ্ছে? পাঁচ সেকেন্ড ভাবুন তো। হৃদয়ের বিশাল স্থান দখল করে নেয়া শ্রদ্ধা ও পরম ভলোবাসার মা কিংবা বোনের প্রতি এ ধরনের কল্পনা কি স্বপ্নেও সম্ভব? তাও শেখাচ্ছে আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা, আমাদের কারও কারও কাছে আরাধ্য সংস্কৃতি। আমার এক অতি ঘনিষ্ট আমেরিকান বন্ধু, যে কিনা একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, খুব দুঃখ করে বলছিল, এখন ইন্টারনেটে এ জাতীয় সম্পর্ক নিয়ে ভিডিও, উত্তেজক গল্প “ইনসেস্ট’ নামে ইন্টারনেটে ছাড়া হচ্ছে, যখনই চোখে পড়ে আমার (বন্ধু) বমি ভাব আসে। একজন আমেরিকান খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়েও তার ভেতরকার মূল্যবোধ এখন পর্যন্ত তাকে পীড়িত করছে। অথচ পাশ্চাত্য তা নিজের জন্য স্বাভাবিক করে নিয়েছে। পাশ্চাত্যের এই অব্যাহত অবাধ প্রচারে মূল্যবোধ সর্বস্ব কতজন টিকে থাকতে পারবে, তা বলাই বাহুল্য? ইদানীং বাংলাদেশে একজন পাশ্চাত্য প্রেমিক সম্পাদক (আমি যার লেখার ভক্ত ছিলাম), যিনি নিজেকে ‘বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তক’ বলে দাবী করেন, তার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যাতেও এ জাতীয় গল্প প্রকাশ হয়ে থাকে। জানিনা তিনি কি উদ্দেশ্যে তা প্রকাশ করেন?
অসভ্যতার এখানেই শেষ নয়। অবৈধ বিকৃতাচারের ছবি, ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নোংরা ম্যাগাজিন, ইন্টারনেটে। ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল আর স্পাই ক্যামেরার কল্যানে অনেক নিষ্পাপ মানুষের অগোচরে তাদের অসংলগ্ন অবস্থা বা দুর্বল মুহুর্তের ছবি উঠে যাচ্ছে তাদের অগোচরে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব করছে অতি আপনজন কেউ। সাথে সাথে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে। অনেক ক্ষেত্রে প্রচারকারীকে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ, পয়সাও দেয়া হচ্ছে। অনেকেই হয়ত উপভোগও করেছেন। আমার আকুতি একটু রিয়েলাইজেশনের। ভাবুন তো একটি বার, আপনার স্ত্রী , নাড়ী ছেঁড়া ধন কন্যাটি কিংবা বোনের ছবি কেউ যদি দুর্বলতার সুযোগে এভাবে নেটে ছেড়ে দেয়, তাহলে কষ্টের অনুভূতিটা কেমন হবে?
দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশেও এই কালচার প্রবেশ করছে অতি আগ্রাসী রূপ নিয়ে। এসব প্রচারে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পাশ্চাত্য তৈরী করেছে হাজার হাজার ওয়েব সাইট। এসব আয়োজনের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে সামান্য মূল্যবোধ এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে, তাও ধ্বংস করবার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। শুধু কম্পিউটারই নয়, বরং মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিস বা ‘ওয়াপ’ বা ‘জিপিআরএস’ এর কল্যানে এসব নোংরামীর পুরোটা হাতের নির্দোষ মোবাইলের মাধ্যমেই, ঘরে বিছানায় শুয়ে উপভোগ করা যাচ্ছে। সন্তানকে কতইবা নজরে রাখবেন সচেতন মা-বাবারা। ভারতে চালানো সাম্প্রতিক একটি জরীপে জানা পায়, ইন্টারনেট ব্রাউজারদের ৭০% কোন না কোনভাবে পর্ণ সাইটগুলোতে ঢুকেছে, যাদের অধিকাংশেরই বয়স তের থেকে ত্রিশ এর ভেতর। এ চিত্র শুধু ভারতেরই নয়, বরং সারা বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে।
পাশ্চাত্য ছায়াছবির তীর্থ কেন্দ্র হলিউডে নির্মিত অধিকাংশ ছায়াছবিগুলো তাদের সমাজের অস্থিরতার বাস্তব প্রমাণ। শত ভাগই যে খারাপ, তা অবশ্য নয়। চরম নগ্নতা আর অশ্লীলতার প্রসঙ্গ বাদই দিলাম। কাল্পনিক এসব ছায়াছবিতে ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য এমন ভাবে তৈরী করা হয় যে, তাতে মানুষের কল্পনার সম্ভাব্য সব রকম ভয়াবহতাকে সর্বাত্মক ভাবে রূপ দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। এসব দৃশ্য সাধারন নাগরিক তো বটেই, বাচ্চাদের অপূর্ণাঙ্গ মগজকে ধোলাই করে হিংসাত্মক মনোভাব তৈরী করছে। যার প্রমাণ কিছুদিন পর পরই শোনা যায়, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বসেই নিজেদের সহপাঠীদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে। পত্রিকার সচেতন পাঠক মাত্রই তা স্মরন থাকার কথা।
বাচ্চাদের কার্টুন প্রীতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের বাজে কালচারে অভ্যস্ত করে তুলছে। প্রসঙ্গ ক্রমে আমার দুজন আত্মীয়ের কার্টুনের পোকা নাবালক শিশু সন্তানদের কথা না বললেই নয়। দুটোই ঘটনাই আমি সচক্ষে দেখেছি। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া একজনের শিশু পুত্রকে হঠাৎ করে একদিন খেয়াল করলাম, ছোট বোনের সাথে দুষ্টুমী করে ঘায়েল করার জন্য শরীর বোনের দিকে বাঁকিয়ে বার বার সে মুখ দিয়ে বায়ু ছাড়ার মতো শব্দ করছে। বেশ খানিক্ষন ব্যাপারটি খেয়াল করে, ছিঃ! বলে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম এ জিনিস সে কোথায় শিখেছে। সে থেমে গেলেও কোন ভাবেই তা ন্বীকার করলনা। ভাগ্যক্রমে কিছুক্ষন পরেই কার্টুন নেটওয়ার্ক চ্যানেলে দেখতে পেলাম, ‘পোকেমন’ নামক কার্টুন সিরিয়াল, যা কিনা বাচ্চাদের কাছে হটকেক, তার নায়ক শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য বায়ু অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। আর অবুঝ বালক সেটাকেই স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছে। অপর ঘটনাটিও প্রায় একই রকম, দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া আরেক আত্মীয়ের বাচ্চাটি যখনই কথা বলবে, কার্টুনে দেখা ‘টম এন্ড জেরী’র মতো করে, না বোঝাবার জন্য মুখে না বলে বারবার মাথা নাড়বে, কখনওবা মুখ বিকৃত করছে, কোথায় গেলে মাঝে মাঝে চার হাত পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য দু একবার এরূপ করাটা স্বাভাবিকভাবেই দুষ্টুমী মনে হতে পারে, কিন্তু এটি যখন নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়, কোন সচেতন বাবা মা কি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন? মূলঃত এসব-ই পাশ্চাত্য সভ্যতার মহান অবদান।
কোমলমতি, নিষ্পাপ শিশুদের আনন্দ দেবার নামে পাশ্চাত্য কি গেলাচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। অনেকেই ভিডিও গেমকে নির্দোষ বিনোদনের মাধ্যম বলে মনে করেন। এতে অবশ্য খুব একটা দ্বিমত নেই আমার। তবে অনেক গেমস আছে, যা নগ্নতা নির্ভর। আবার কিছু গেমস আছে, যেখানে গল গল করে রক্ত ঝরছে, খেলোয়াড়কে নায়ক সেজে খুন করতে হচ্ছে। এসব বাচ্চাদের কচি মনকে হিংসাত্মক বা অন্যরকম করে তুলতে পারে। বছর চারেক আগে ফ্রান্সে ছয় বছরের এক শিশু ঘরে রক্ষিত পিস্তল দিয়ে হঠাৎ বিনা কারনে তার বাবাকে গুলী করার পর তদন্ত করে জানা গেল, এটি সে ‘গ্র্যান্ড থেফট অটা’ নামক গেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে খেলাচ্ছলে করেছে, যার ভয়াবহতা সে এতটুকুও বুঝতে পারেনি। পাঠক হয়তো শুনে আঁতকে উঠবেন, এই গেমটি বাংলাদেশের অনেক কম বয়সী গেম খেলোয়ারের কাছেই অত্যাধিক জনপ্রিয়। এহেন অনেক গেমই এখন কোমলমতি শিশুদের হাতে পৌছে যাচ্ছে।
পাশ্চাত্য আমাদের কল্যাণকর কিছুই দেয়নি, এ কথা বলা যেমন সঠিক হবেনা তেমনি তাদের ভোগবাদী মানসিকতা, নৈতিকতাহীন নষ্ট সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী রূপ আজ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে দারুন হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আর সামাজিক মূল্যবোধগুলো আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। সকল সভ্যতার একটি চুড়ান্ত পরিণতি আছে। পাশ্চাত্য সমাজে প্রচলিত তুলনাহীন বিকৃতাচার, তাদের ধ্বংসাত্মক পরিণতিকেই অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। কিন্তু আমাদের প্রজন্মকে তার অংশীদার করার দুঃস্বপ্ন কি দেখতে চাইবেন কোন মানবতা পূর্ণ, মূল্যবোধ আর সৌর্ন্দয্যমন্ডিত সভ্যতার গর্বিত ধারক কোন বিবেকবান মানুষ, কোন স্নেহশীল বাবা-মা কিংবা ভাই?
বি:দ্র: অপ্রাসঙ্গিক হলেও সচেতন বাবা-মায়েদের প্রতি কয়েকটি কথা বলেই শেষ করছি;
১. আপনার সন্তানকে সঠিক ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা দিন, সষ্টিকর্তাকে ভয় করতে শেখান।
২. মাথা ব্যথার চিকিৎসা তা কেটে ফেলা নয়। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির বিরোধিতা আপনার সন্তানকে পিচিয়ে দেবে। বরং বাসার ডিশ সংযুক্ত টিভি বা কম্পিউটার বাড়ীর কমন প্লেসে রাখুন, যেখানে লোকজনের যাতায়াত আছে। এতে অপব্যবহার হতে পারবে না।
৩. যোগাযোগের প্রয়োজনে আপনার সন্তানকে যদি অল্প বয়সে মোবাইল কিনে দিতেই হয়, স্কুল পড়ুয়া সন্তানকে ভিডিও যুক্ত মোবাইল কিনে দেবার কোন যৌক্তিকতা নেই।
৪. আপনার সন্তানকে টিভি কিংবা কম্পিউটার নির্ভর ‘গৃহ পালিত ব্রয়লারে’ পরিণত না করে তাকে খেলাধূলা বা বই পড়ায় উৎসাহিত করুন। এতে সে সামাজিক হতে শিখবে।
৫. আপনার সন্তান কি দেখছে, গভীর রাতে কম্পিউটারে কি পড়ছে, কার সাথে চ্যাট করছে তা জানার অধিকার অবশ্যই আপনার আছে। তবে পাহারা, খবরদারি কিংবা জবরদস্তি নয়, বরং সচেতন থাকুন, চোখ কান খোলা রাখুন। সামান্য সচেতনতা, এতটুকু কাঠিন্য আমাদের সন্তানদের অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে।
আরও জানুন
Click This Link
Click This Link