somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খাগড়াছড়ি সকাল ও একালের চিত্র

০৯ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খাগড়াছড়ি সেকাল ও একালের চিত্র
প্রমোদ রঞ্জন চাকমা
বাংলার ১৩৫০ সালের আগেও পরের কথা। সে সময় বুড়োবুড়ীদের মুখে শুনা। খাগড়াছড়ি উভয় খালে নলখাগড়া বন ছিল। ছড়ার উভয়পাড় ছিল সংর্কীণ, এপাড়ের নলখাগড়ার আগা ও পাড়ের নলখাগড়া আগার সাথে জট পাকিয়ে থাকতো। এজন্য এ ছড়ার নাম খাগড়াছড়ি। নলখাগড়া দেখতে অনেকটা বাঁশের কঞ্চির মত এবং যে সব কোড় বের হয় সেগুলোও বাঁশের কোড়ের মতনই দেখতে। খাগড়াছড়ির দুইটা খাল বা ছড়া। একটা ডাইনের খাগড়াছড়ি অন্যটা বামের খাগড়াছড়ি। ডাইনের খাগড়াছড়ি খালটা বর্তমান খাগড়াছড়ি পৌরসভা অফিসের পিছনে পূর্ব দিক হতে আসা বামের খাগড়াছড়ি খালের সঙ্গে মিশে কিছুদুরে চেঙ্গী খালে গিয়ে মিশেছে। বামের খাগড়াছড়ির খালটা একটু বড় আর ডানের খালটা কিছুটা ছোট। এ দুই খালের মিলনস্থল থেকে চেঙ্গী খাল খুব বেশী দুরে ছিল না। বর্তমান খাগড়াছড়ি বাজার জামে মসজিদের পাশ দিয়ে চেঙ্গী খাল প্রবাহিত ছিল এবং সেখানেই ছিল খাগড়াছড়ি মোহনা। বামের খাগড়াছড়ি বলতে তৈ-পাকলা, বড়পাড়া, খাগড়াপুর এবং মহাজনপাড়া হয়ে যে ছড়া আর ডাইনের খাগড়াছড়ি বলতে বখরাছড়া হরিনাথ পাড়া , সাতভাইয়া পাড়া ও পানখাইয়া পাড়া হয়ে যে ছড়া বামের খাগড়াছড়িতে মিশেছে। ডাইনের খাগড়াছড়ি ছড়ার উৎপত্তি স্থল ঝান্ডিমুড়া নামক এক পাহাড় শ্রেণী। আঁকাবাকা অবস্থায় চার পাঁচ মাইল আর বামের খাগড়াছড়ির উৎপত্তি স্থল কলীপাড়া পুষিবন পাড়ার পাহাড় শ্রেণী। এর দৈর্ঘ্য প্রায় আট মাইল। উভয় ছড়ার তীরে তীরে গড়ে উঠা পাড়া বা গ্রাম এবং বাজার নিয়ে খাগড়াছড়ি। গোলাবাড়ী এবং খবংপুড়িয়া তখন খাগড়াছড়ির অন্তর্ভূক্ত ছিল না। আধুনা মহাজনপাড়া , পানখাইয়া পাড়া, সাতভাইয়া পাড়া ও বাজার সংলগ্ন যেসব বসতি গড়ে উঠেছে তৎকালে সেসব ছিল এলাকাবাসীর খামার ও খেতখোলা। পাহাড়গুলো ছিল গভীর অরণ্য ডাকা। শিকারীদের শিকার করার জায়গা। হরিণ, বন্যশুকর,বনমোরগ ছিল প্রচুর। মাঝে মধ্যে গয়ালও দেখা যেত। জুমিয়া পরিবারে এসব বন কেটে জুম চাষ করতো। জুমে ধান পাকার সময় হলে বন্য শুকরের উপদ্রপ শুরু হতো। তখন শিকারীরা ওৎ পেতে শুকুর শিকার করতো। আর জুমের ফসল উঠে গেলে হরিণের ঝাক সকাল সন্ধ্যায় কচি লতা পাতা খাওয়ার জন্য জুমে চড়তে আসত। এসময়ে শিকারীদের শিকারের জো হয়। বর্তমান ডিসি অফিস সংলগ্ন সব পাহাড়ে ছিল বন। মহাজন পাড়ার উত্তরে পাহাড়ও ছিল গভীর বন ডাকা। এসব বনে বাঘও ছিল। রাতে বন থেকে পাড়ায় বাঘ ঢুকে গরু-বছুর, ছাগল ও কুকুর নিয়ে যেত। সন্ধ্যা নামলেই বাঘের ভয়ে মানুষ রা¯তায় খুব একটা বের হতো না। জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। খাগড়াছড়ি বাজার থেকে দীঘিনালা পর্যšত একটা জঙ্গলাকীর্ণ পায়ে হাটা রা¯তা ছিল। বর্ষাকালে কাদা আর পিচ্ছিল পথে হাটা খুবই কষ্টকর ছিল। অনুরূপ খাগড়াছড়ি বাজার থেকে পানছড়ি বাজার পর্যšত ও একটা রা¯তা ছিল। রা¯তা দুটো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর তৈরী বলে এসব রা¯তা “কোম্পানী রাস্তা” বলা হতো। তখনকার জেলা শহর রাঙ্গামাটি থেকে বুড়িঘাট বাজার, মহালছড়ি বাজার হয়ে পায়ে হাঁটা কোম্পানী বা¯তা খাগড়াছড়ি বাজারে এসে মিশেছে। ওদিকে রাঙ্গামাটির সাথে চট্টগ্রামের যাতায়াত ছিল স্থলপথে ও নদী পথে লঞ্চযোগে। সে সময় অধিকাংশ লোকই নদীপথে লঞ্চযোগে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি যাওয়া আসা করতো। তখন স্থলপথ উন্নত ছিল না এবং যাত্রীবাহী যানবাহনও ছিল না। রামগড় ছিল মহকুমা শহর। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিল তিনটি মহকুমা। রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবান। খাগড়াছড়ি থেকে রামগড় যাওয়ার জন্য যদিও গুইমারা হয়ে একটা জঙ্গলাকীর্ণ কোম্পানী রা¯তা ছিল, কিšতু লোকজন সে পথে কম যাওয়া-আসা-করতো। পাহাড়ী গেঁয়ো পথ ধরে মাটিরাঙ্গা অথবা অযোধ্যা বাজার হয়ে সোজা রামগড়-খাগড়াছড়ি যাওয়া আসা করতো। পাহাড়ী গেঁয়ো পথে এসে মধ্যাহ্নে খাগড়াছড়ি থেকে রামগড় যেতো এবং রামগড় থেকেও খাগড়াছড়ি আসা সম্ভব হতো। কিšতু গুইমারা হয়ে গেলে একদিনের বেশী সময় লাগতো। মহকুমা শহর রামগড় আর জেলা শহর রাঙ্গামাটির যাতায়াত ও যোগাযোগ ছিল গুইমারা হয়ে হাটহাজারী, তারপর রাঙ্গামাটি। তৎসময়ে রা¯তা ছিল অনুন্নত। খাগড়াছড়ি বাজার গড়ে উঠেছে চেঙ্গী নদীর তীরে। খাগড়াছড়ির মোহনায় উত্তর-দক্ষিণ দু’লাইন এবং পূর্ব পশ্চিমে এক লাইন দোকানের সারি। বাজারের মাঝখানে টিনশেড দুটো স্টল ছিল। হাটের দিনে দোকানীরা স্টল দুটোতে পশরা খুলতো। বিকটবর্তী বাজার যেমন পানছড়ি, ভাইবোনছড়া, বোয়ালখালী, মাইচছড়ি, মহালছড়ি থেকে ব্যবসায়ীরা এসে স্টলে দোকান খুলতো এবং পরদিন চলে যেত। অনুরূপভাবে সেসব বাজারেও এ বাজারের দোকানদাররা পশরা নিয়ে যেত। খাগড়াছড়ি হাটবাজার ছিল বৃহস্পতিবার, মঙ্গলবার ছিল মাইচছড়ি, ভাইবোনছড়া ও বোয়ালখালী। আর মহালছড়ি পানছড়ি হাটবাজার ছিল রোবরার। একই ব্যবসায়ী সপ্তাহে একাধিক হাটে মাল কেনাবেচা করার সুযোগ পেত। এতে তারা লাভবান হতো খুব। তখনকার দোকানী ব্যবসায়ীরা ছিল সবাই সমতলবাসী। তাদের মধ্যে একটা প্রবণতা ছিল সুদের ব্যবসা। সহজ সরল পাহাড়ীদের লোভ দেখিয়ে সুদের উপর টাকা ধার দিত। খাতক সময় মত টাকা শোধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও মহাজন টাকা খাতকদের হাতে জমা রেখে আসত পাছে চোর ডাকাত লুট করে নিয়ে যায়। তখন চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল । আষাঢ়-শ্রাবণ মাস অভাবের দিন, কৃষিকাজ ব্যয় করার দিন। মহাজন হিসেব করে বসে থাকে খাতক টাকাগুলো খরচ করুক। শ্রাবণের শেষে বা ভাদ্রের প্রথমে মহাজন খাতকের কাছে যায় অপরের কাছে লগ্নি করার অজুহাত দেখিয়ে টাকা খুজঁতে । খাতক নিজের খরচে হিসেব দেখিয়ে মহাজনকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়। মহাজন খুশী, অন্য খাতক খুজতে হলো না। খাতকও খুশী অন্যের কাজে গিযে কাকুতি মিনতি করে আর হাত পাততে হলো না। এভাবে মহাজনেরা টাকা একই খাতকের কাছে চক্রবৃদ্ধি হারে লগ্নি হয়ে থাকে। অনেক টাকা জমা হয়েছে। তখন খাতকে সুদিনের সময় মোটা অংকের টাকা উশুল করে নিয়ে আসে। সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের অক্ষমতা দেখিয়ে খাতক কিছু টাকা রেখে দিতে চাইলে এতে মহাজনও আপত্তি করতো না। হিসেব- নিকাশ করে মহাজন সুদের উপর বাকী টাকাগুলো রেখে আসে। বিশ্বাস আছে টাকা নষ্ট হবে না। খাতক মারা গেলেও পরজন্মের ভয়ে তার বংশধরেরা সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও ঋণমুক্ত করবে কিংবা নিজেরা ঋণের বোঝা গ্রহণ করবে। এভাবে অধিকাংশ ব্যবসায়ী স্থানীয় লোকদের শোষণ করতো। দেখা গেছে সে সময় নিস্ব আসা সমতলবাসী পহাড়ী পাড়ায় পাড়ায় দিনমজুর কিংবা মাসোহারা বেতনে গৃহস্থের বাড়ীতে কাজ করে ২/৩ বছরের মধ্যে স্বাবলম্বী হয়ে ছোটখাট ব্যবসা গড়ে তোলে। তাদের কাছে চেনা পরিচিত লোকদের সাথেই কাজ কারবার বেশী এবং তাদেরকে শোষণ করেই তারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। এই চিত্র শুধু খাগড়াছড়িতে নয় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে একই রীতি ছিল। এখনো কিছু কিছু সেই রীতিতে চলতে দেখা যায়। আগেই বলা হয়েছে , তখন খাগড়াছড়িতে লোকবসতি খুবই কম ছিল। সে সময়ে পাড়াগুলোর মধ্যে পানখাইয়া পাড়ায় বিচ্ছিন্ন বসাবাসকারী ৩০/৪০ পরিবার, পার্শ্ববর্তী গ্রাম সাতভাইয়া পাড়ায় ছিল ৮/১০ পরিবার মারমা। অনুরূপ হরিনাথ পাড়ায়ও ছিল ৭/৮ পরিবার চাকমা তার পূর্বে বহুদুরে ছিল ত্রিপুরাপাড়া যা এখনো আছে। বর্তমানে উন্নয়ন বোর্ড সন্নিকটবর্তী (মাষ্টারপাড়া) একটা মারমা পাড়া ছিল-যার নাম ছিল খিয়্য মহাজনপাড়া। খিয়্য মগ এবং কংক্যা মগ নামে অবস্থাভাবাপন্ন দুই ভাই তাদের কতিপয় আতœীয়বর্গ নিয়ে এখানে বসবাস করত। তা কংক্য ঘাট নামে পরিচিত ছিল। পাকি¯তানী আমলের শেষভাগে ও বাংলাদেশ হবার প্রথমভাগে তাদের জমি হুকুম দখলের কারণে তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে। ইদানিং সেই অবস্থাভাবাপন্ন পরিবারে সদস্যদের কাহারো কাহারো দিন মজুরী করে অন্নসংস্থান করতে হচ্ছে। বর্তমান উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়াল ঘেরা ও টাউন হলের আশেপাশে এলাকা ছিল তাদের উর্বরা ধান্য জমি। সরকারী হুকুম দখলের পর যে জমি তাদের হাতে ছিল,আর্থিক কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ও হকুমদখলী জায়গা বাঙ্গালী বসতি গড়ে ওঠার কারণে পেটের দায়ে সেসব জমিও ক্রমান্বয়ে বিক্রয় করতে বাধ্য হয় তারা। বর্তমানে মাষ্টারপাড়াস্থিত পুলিশ লাইন ও তার পূর্বদিকের পাহাড় ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। খিয়্য মহাজন সেই জঙ্গল সাফ করে কয়েক বছর পর পর জুম চাষ করতেন। এ পাড়ার পশ্চিমে ছড়ার পশ্চিমে পাড়ে মহাজন পাড়া। রামকমল ও হরিকমল মহাজন এ দু ভাইয়ের নামে এ পাড়ার নাম হয়। যে সময় এ পাড়ায় যেসব পরিবারের বসবাস কিছু সবাই ছিল অবস্থাপন্ন। তাদের ধার কর্জ করতে হতো না বরং অপরকে কিছু কিছু ধার কর্জ দিত। ইদানিং সেই সব স্বচ্ছল পরিবার আর নেই। অধিকাংশ পরিবার ভূমিহীন নিঃস্ব। বর্তমান ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেসব সমতল ভূমি দেখা যায় তা ছিল মহাজন পাড়ার লোকদের ধান্য জমি। বিডিআর ক্যাম্পের সংলগ্ন পূর্ব দিকে দুই পাহাড়ের মাঝখানের জমিও ছিল এ পাড়ার লোকদের ধান্য জমি; এখানো কিছু আছে। খামার দিয়ে পাড়ার লোকেরা এসব জমি থেকে ফসল ঘরে নিয়ে আসত। এখন আর সেসব জমির আশেপাশে চাষ করা সম্ভব হয় না। সমতল থেকে আসা বসতিকারীদের গরু-ছাগল আর হাঁস-মুরগীর অত্যাচারে পুরো ফসল ঘরে আনা সম্ভব হয়ে উঠে না। ইদানিং সেখানকার বাঙ্গালী বসতিকারীরা স্বল্প ফসলের বিনিময়ে চাষবাদ করছে এবং জমির মালিকেরা অন্যত্র গিয়ে কেউ দিন মজুরী আর কেউ পরের জমি চাষ করতে বাধ্য হচ্ছে। মহাজন পাড়ার পূর্বে লোকবসতি কমছিল। ভূমি ছিল উর্বর । আজকাল পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমি ভাগ হয়েছে, উর্বরতাও বহুলাংশে কমে গেছে, তাই লোকদের মধ্যে অনেক আগের আর সেই স্বচ্ছলতা নেই বললে চলে। আজ নানা কারণে অনেকে ভূমিহীন হয়েছে। যেসব পরিবার ভূমিহীন কিংবা জমির মালিক সেসব পরিবার মদ চোলাই দিনমজুরী করে দিনযাপন করছে। মুষ্টিমেয় লোক যারা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে তারা ছোট খাট চাকরী নিয়ে কোনরকমে চলছে। মহাজন পাড়ার উত্তরে যেসব পাহাড় রয়েছে সেকালে এগুলো গভীর অরণ্য ছিল। এ পাড়ার ভূমিহীনেরা পাহাড় সাফ করে জুম চাষ করতো; আবার কোন কোন ভূমির মালিকেরা জঙ্গল সাফ করে জুম করতো। জুম করার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। তৃপ্তি ছিল। মাঘ-ফাল্গুনের মধ্যে জুম কাটা শেষ করতে হয়। যেখানে বাশঁ বন থাকে তা মাঘ মাসের মধ্যেই কেটে ফেলতে হয় না। না হলে পুরানো যায় না। জুম পোড়া না গেলে মাটিতে উর্বরতা আসে না এবং সেগুলো পরিস্কার করতে অনেক সময়ের অপচয় হয়। চৈত্র মাসের মধ্যে অবশ্যই জুম পোড়া দিতে হয় এবং এ মাসের মধ্যেই আধা পোড়া গাছগাছালী আবার এক জায়গায় জড়ো করে সেগুলো আবার আগুনে পোড়া দিতে হয়। এ কাজটা করতে বিলম্ব হলে বৈশাখের প্রথম ভাগের ধান কোচা (গর্ত করে ধান বুনা) সম্ভব হয় না। এসব কাজ করার সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য জুমের মাঝখানে মাচান দিয়ে একটা টংঘর বানানো হয়। দুপুরের খাবার সময় এ টংঘরের পেচাং এ (ঝুলšত বারন্দা) বসে ফিরফিরে দখিনা বাতাসে খাবার খাওয়া কতই তৃপ্তিকর। তরকারী ছাড়া শুধু লবণ দিয়েও পেট পুরে ভাত খাওয়া যায়। বৈশাখ মাসে বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে ধান কোচা/বোনা শুরু হয়। বৈশাখের শধ্যে ধান বুনতে না পারলে ফলন কম হয়। এসব পাহাড়ের জঙ্গলে বাঘ আর বন্য শুকুরের আবাস ছিল। বন্য শুকুরের হাত থেকে ফলন রক্ষার জন্য এবং বাঘের উপদ্রব কমানোর জন্য এসব পাহাড়ে জুম চাষ অবশ্যই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়তো। তাই নাল জমির মালিকেরা ও হয়তো শখ করে , নয়তো বাধ্য হয়ে জুম চাষ করতো। বর্ষাকালে তরকারীর অভাব দেখা দেয়, যাদের জুম থাকে তাদের তরকারীর অভাব হয় না। জুমে ঢেড়শ, শীম, ঝিঙা, লাউ কুমড়া ইত্যাদি নানা জাতীয় সবজি আর শশা ও চিনার জাতীয় নানাফল হয়। তাই অনেকে শখ করে জুম চাষ করতো। মহাজন পাড়ার পশ্চিমে এখন যেসব বসতি দেখা যায়। সেসব জায়গা এ পাড়ার ও খবংপুড়িয়া গ্রামবাসীদের বোনা আমন ধানের জমি ছিল। ফল্গুন-চৈত্রমাসের মধ্যে নাড়া পোড়ার সাথে সাথে চাষ দিয়ে দিলে মাটি শক্ত হয় তাই নাড়া পোড়ার সাথে সাথে গর্চা ধান বুনা হয়। ফাল্গুন-চৈত্রমাসের মধ্যেই ধান বোনা শেষ হয়ে যায়। ধানবুনা শেষ হলে গেরস্থের তেমন আর কোন কাজ থাকে না। তাই তারা জুমের কাজে লেগে যায়। জুমে যখন ধান পাকে ঘরে ধান আসে তখন জুম ওয়ালা গেরস্থের নবান্নের উৎসব শুরু হয়। শুকুর মোরগ-মুরগী কেটে মালক্ষ্মীকে পূজা করে ভাত দেওয়া হয়। পড়শী যারা থাকে, দুরের নিকট আতœীয়কে ডেকে এনে এ জুমে ধান কাটা শেষ তিল, কার্পাশ ও বিভিন্ন সবজীর গাছও থাকে। তিল, কার্পাস এবং সবজি যাতে পুষ্ট ও সতেজ হয় ধানের নাড়া এবং অন্যান্য আগাছা কেটে দেয়া হয়, নাড়া এবং আগাছা মাটিতে পঁচে সবুজ সারের কাজ হয়। এতে তিল কার্পাস এবং অন্য সব গাছ আরো সতেজ হয়ে উঠে। জুমে যখন কার্পার ফুটে তখন মনে হয়,জুম যেন হাসছে। তখন জুমের যে সৌন্দর্য্য ফুটে উঠে তা অবর্ণনীয়। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাসে তিল আর কার্পাস আসে। এসময় জুমিয়া গেরস্থরা আগামী দিনের সুখের স্বপ্নের জাল বুনে। সেকালে পাহাড় আর টিলাগুলোতে গাছপালা পরিপূর্ণ চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রায় প্রচুর বৃষ্টি হতো। এসব পাহাড়ে এখন গাছপালা না থাকাতে তেমন আর বৃষ্টি হয় না। ফাল্গুন চৈত্র মাসে বুনা গর্চা ধানের কথা যে বলা হয়েছে তা এ বৃষ্টির ফলে দ্রুত বাড়তো। বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্য জ্যৈষ্ঠের প্রথম ভাগে, কিছু জমির মালিকেরা ধানের চারা লম্বা করার জন্য তাদের জমির আইল বাঁধ দিয়ে রাখে। পানি বাড়ার সাথে সাথে গর্চা ধানও বাড়তে থাকে। মহাজনপাড়া থেকে শাšিতনগর ও কলোনীপাড়া হয়ে বাস টার্মিনাল পর্যšত বর্তমান রা¯তা গেছে তা ছিল একালের এক ধরনের বাঁধ। অনুরূপ কলোনী পাড়া থেকে শাšিত নগরের মাঝখান দিয়ে ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস পর্যšত যে রা¯তা গেছে তাও এ ধরনের বাঁধ। এ ধরনের বহু বড় বড় আইল ছিল, যেগুলো জমির বাঁধ হিসেবে ব্যবহার হতো। সে সময়ে এ বাঁধগুলো যে রা¯তা তাও বেশ উ ঁচু এবং প্রশ¯ত ছিল। ইদানিং মানুষ ও গবাদি পশুর হাটাহাটিতে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে নীচু হয়ে গেছে। বর্তমান ফুড গোডাউনের উত্তর দিকে গো হাটা হয়ে চেঙ্গীপাড় পর্যšত যে রা¯তা ছিল তাও এ ধরনের একটা বাঁধ ছিল। বর্ষার পানি আটকানোর জন্য বাধ্য হয়ে প্রতি বছর বাঁধ সংস্কার করতে হতো। সে সময়ে খবংপুড়িয়া এবং তৎসংলগ্ন পাড়ার লোকেরা এ বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে বাজারে যাওয়া-আসা করতো। তখন এ ধরনের যে সব বাঁধ ছিল সেগুলো এখন সংস্কারের অভাবে প্রায় মাটির সাথে মিলে গেছে। কলোনী পাড়া আর শান্তিনগরের পাশ দিয়ে নারানখাইয়া নাশীতে যে ব্রীজখানা আছে সেখানে প্রতি বছর শ্রাবণের দ্বিতীয় সপ্তাহে খবংপুড়িয়া ও মহাজনপাড়ার লোকেরা মিলে একটা বাঁধ দিত সে সময়ে নাশীটা এত গভীর আর এত প্রশ¯ত ছিল না। গর্চাধানে বেশী পানির প্রয়োজন। ধান বেশী লম্বা হলে ফলন বাড়ে তাই এ বাঁধের ব্যবস্থা। জ্যৈষ্ঠ মাসে যে সব বাঁধ বেঁধে পানি আটকিয়ে রাখা হয় সে সব জমির ধান অনেক বড় ও লম্বা হয়ে যায়। নাশীতে বাঁধ দেয়াতে এলাকা ডুবে গেলে ধান আরও লম্বা হতে থাকে। বোনা আমনের বৈশিষ্ট-পানির সাথে সাথে লম্বা হওয়া, পানিতে ডুবে গেলেও সহজে পচে না বরং পানি ফুড়ে তাড়াতাড়ি লম্বা হয়। তবে অতিরিক্ত কচি ধান বেশী নীচে তলিয়ে গেলে তা আর লম্বা হতে পারে না,পঁচে যায়। ঘোলা পানিতে তলিয়ে গেলেও কচিধান পঁচে। বেশী বৃষ্টি হলে ভাদ্র মাসে, বাঁধের উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তো। সে সময় দুপাড়ার লোকদের মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। মহাজনপাড়ার লোকেরাই সে সুযোগই বেশী পেত কারণ মহাজনপাড়ার লোকদের জমির আইলের উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে যেত। যেদিক দিয়ে পানি গড়িয়ে যেত সেখানে মাছ ধরার ফাঁদ বসিয়ে প্রচুর মাছ ধরা হতো। মাছ ধরার জায়গা নিয়ে ঝগড়াঝাটি করতো না বরং একে অন্যকে মাছ ধরার সুযোগ করে দিত। যারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত অন্যেরা তার বাড়ীতে কিছু কিছু মাছ পৌঁছে দিত। এতে তার বাড়ীতে মাছের পাহাড় জমে যেত। সে সময় মাছের এসোটে গন্ধে গ্রামে ঢোকা যেত না। কার মাছ কে খায়; অনেকে সেগুলো শুটকী করে রেখে দিত। বাঁধের পানিতে যখন গোটা বিল ডুবে যায়, তখন বড়শী দিয়ে মাছ ধরার আর এক ধুম পড়ে যায়। ছেলে, বুড়ো, যুবা সবাই মাছ ধরার আনন্দে মেতে উঠে। তখন লোকের কাজ-কর্ম খুব একটা থাকেনা। গর্চা ধান বোনা ও জুমের আগাছা বাছাই নিড়াই হয়ে গেলে শুধু ফসল ঘরে তোলার জন্যে অপেক্ষা করা। রোপা জমি ছিল সেসব জমিতে কাজ করতে তেমন বেগ পেতে হতো না। বড়শীতে কৈ মাছ ছিল প্রধান শিকার। অন্যান্য মাছের প্রাচুর্য্য যদিও ছিল, লম্বা ছিপ বড়শীতে শুধু কৈ মাছ ধরা পড়তো। এ মাছের বড়শীর টোপ ছিল গাজানো পুটি শুটকী স্থানীয় ভাষায় যেগুলো বের্মা শুটকী আর সমতলে হিদোল বলে পরিচিত। একটা শুটকী দিয়ে ৫/৬টা টোপ বানানো যায় এবং টোপ দিয়ে ৩/৪ টা কৈই মাছ তোলা সম্ভব। শিং, মাগুর এবং টাকি মাছের টোপ হচ্ছে কেঁচো। এসব মাছ লম্বা বড়শীতে কম ধরা পড়ে। আড়াই তিন হাত লম্বা বাঁশের কঞ্চিতে আগায় মতো দিয়ে বড়শী বেঁধে জমির আইলে পুতে রাখা হতো। লম্বা ছিপ বড়শীতে যে রকম ফাটনা থাকে এসব বড়শীতে ফাটনা থাকে না। বড়শীতে মাছ আটকা পড়ছে কিনা টের পাবার জন্যে কঞ্চির আগায় সুতার কিছূ অংশ ভাস করে রাখা হয়। বড়শীতে মাছ আটকা পড়লে বড়শীর দড়ির ভাস কঞ্চির আগা থেকে খসে যায়। এসময় বুঝতে হয় মাছ টোপে টান মেরেছে। তখন গিয়ে মাছটা বড়শী থেকে ছাড়িয়ে নতুন টোপ দিয়ে বড়শীটা আবার সেই জায়গায় বসানো হয়। এসব বড়শীকে আন্দা বড়শী বলা হয়ে থাকে। লম্বা শিপ বড়শীতে যেমন মাছ সবসময় আটকা পড়ে না। এসব বড়শীতে দড়ি টান পড়লেও প্রতিবারে মাছ আটকা পড়ে না। কোন কোন সময় ফসকে যায়। একজন লোক এ ধরনের ২০/২৫টি আন্দা বড়শী নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কিšতু লম্বা ছিপওয়ালা বড়শী দুই বা অধিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এসময় গোটা এলাকা ছিল মাছ শিকারীদের বিনোদনস্থল। কার্তিক মাসে ধানের শীষ বের হয়। অগ্রহায়নে এ সব ধান পাকে। তাড়াতাড়ি ধান পাকার জন্য অঘ্রানের দ্বিতীয় সপ্তাহে নারানখাইয়া নদীর বাঁধ কেটে দেয়া হয়। সে সময় কার্তিকের শেষে অগ্রহায়নের পয়লাতে ভুইয়াওয়ালা কৃষকদের অভাব দেখা দেয়। যাকে কার্তিকের রাট বলা হয়। জৈষ্ঠ মাসে যে বাঁধ দেয়া হয়েছিল সে সব জমির মালিকেরা তাদের বাঁধ ছেড়ে দিয়ে সেখানে মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম বসায়ে রাখে। শোল আর টাকি মাছ চাইয়ে আটকা পড়ে না, সেগুলো লাফিয়ে যায়। সেজন্য তাদেরকে ধারার জন্যে বেতের চাবাড়া দিয়ে বড় লুই বসানো হয়। (বেতের তৈরী ত্রিকনার ফঁদ )। এ ধরনের ছোট লুই দিয়ে ছোট ছেলে মেয়েরা খাল-বিল থেকে ছোট ছোট মাছ কাকড়া ছেকে নেয়। শিং, মাগুর, পুটি, কৈ ইত্যাদি মাছ চাইয়ে ধরা পড়ে। ঘরে ঘরে মাছ ধরার কি আনন্দ। নারানখাইয়া নদীর বাঁধ কেটে দেয়ার একদিন আগে অথবা সেদিনই দু পাড়ার লোক মিলে বেতের জাল তৈরী করে। স্থানীয় ভাষায় এ জালকে চাপড়া বলে। একটু পানি কমলে বাঁধের আরো উপরে চাপড়া বসানো হয় এবং উল্টোদিকে করে চাপড়া দিয়ে বানানো একখানা বড় লুই বসানো হয়, যাতে শোল এবং বড় বড় টাকি মাছ ধরা পড়ে। অন্যান্য মাছ গুলো চাইয়ে ধারা পড়ে। তষনকার দিনে নারানখাইয়া এলাকা মাছের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এত মাছ কোন এলাকায় ধরা পড়ত না। মাসাধিক কাল পর্যšত মাছ ধরা পড়ে। মহাজন পাড়া এবং খবংপুড়িয়া লোকেরা মিলে যা মাছ ধরত এবং মাছ বিক্রির টাকাগুলো সমানভাবে ভাগ করে নিত। যে স্থানে মাছ ধরা হত সে স্থানটার নাম ছিল “নন্ধক”-যা বর্তমান উপালী বিহারের একটু দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। সচরাচর মাছ স্রোতের সাথে নীচের দিকে চলে যায়। কিšতু এ নারানখাইয়া বিলের মাছ যায় স্রোতের বিপরীতে নারানখাইয়া ডোবার দিকে। বন্দকের উত্তর দিকে একটা ডোবা আছে যা নারানখাইয়া ডোবা নামে পরিচিত। বর্ষাকালে এই ডোবা থেকে মাছ বের হয়ে সমগ্র বিলে ছড়িয়ে পড়ত। বাঁধ ভেঙ্গে দেয়াতে পানি কমার সাথে সাথে তারা মূল আখড়ায় যেতে থাকে। তাই বন্দকে মাছ আটকা পড়ে। মাছ বন্দী করে রাখা হয় বলে স্থানীয় নাম বন্দক। বাঁধ ভাঙ্গা প্রথম পানির সাথে যেসর মাছ চেঙ্গী খালে যেত সে সব মাছ আবার ফিরে আসে। কই, মাগুর, শিং, টাকি, শোল এসব মাছ বন্দক ডোবার মাছ। খালের পরিবেশের সাথে মিশতে না পেরে নিজ আবাসের পানির স্বাদ বুঝে পুনরায় উল্টোদিকে ফিরে আসতো। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টিতে নারানখাইয়া ডোবা থেকে ডিম পাড়ার জন্য বের হয়ে আসত এবং যেখানে পানি জমা থাকত সেখানে ডিম ছাড়ত। এসব মাছের পোনা সারা বিলে ছড়িয়ে বড় হত। এ সব মাছ অগ্রায়নে বিলের পানি কমার সাথে সাথে মূল নারানখাইয়া ডোবার দিকে চলে যেত এবং বন্দকে ধরা পড়ত। বর্তমানে ফুট গোডাউনের দক্ষিণ দিকে যে বসতি গড়ে উঠেছে তা সেকালে ছিল কুল গাছে গভীর বন। বাংলাদেশ হওয়ার পর মুসলমানদের বসতি গড়ে উঠেছে বলে তা এখন মুসলিম পাড়া। আধিকাল থেকে তা মহাজন পাড়ার শশ্মান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এ শশ্মানে পাড়ার আধিবসতিকারী মহাজন পাড়ার বুড়ো বুড়িদের স্মৃতি¯তম্ভ ছিল। বসতি গড়ে ওঠার স্মৃতিসৌধ এখন আর নেই। মহাজন পাড়া থেকে বাজার পর্যšত যে বসতি দেখা যায় রা¯তার পূর্ব পার্শ্বে ছিল গ্রামবাসীদের রবি আর খরিপ ফসলের জমি। রা¯তার পশ্চিম পাশে ধানি জমি। এসব জমিতে ভাদ্র আশ্বিন মাসে রা¯তার উপর দাঁড়িয়ে বড়শী দিয়ে অনায়াসে মাছ ধরা যেত। রা¯তা মেরামতের জন্যে পাশের জমি থেকে যে মাটি খোড়া হতো সেসব গর্তে প্রচুর মাছ জমতো। একালের খাগড়াছড়ির যেসব জায়গায় প্রচুর ধান ফলেছে সেসব বসতি গড়ে ওঠাতে এখন খাদ্যাভাব। মহাজনপাড়ার উত্তরদিকের টিলাগুলোতে এখন বসতি আর সরকারী অফিস আদালত গড়ে উঠেছে। উপজেলা কার্যালয় এলাকায় ছিল খেজুর বাগান। ১৯৫৫ সালে মহাজন পাড়ার স্বর্গীয় হরিকমল মহাজন ৭নং হোল্ডিং মূলে গ্রোভল্যান্ড হিসেবে বন্দোব¯তী নিয়ে গোটা পাহাড়ে খেজুর চারা রোপন করেন। সেসময় থেকে সে জায়গার নামে খেজুর বাগান নামে পরিচিত হয়। কিছু কিছু খেজুর গাছ এখানে আছে। এরও আগে এ জায়গার নাম ছিল হাতির গোর। কারণ কোন এককালে সেখানে খেদা দিয়ে বন্যা হাতি ধরা হয়েছিল। বর্তমান বাজারের পূর্ব লাইন ও তার আশ পাশ এলাকা ছিল পানখাইয়া পাড়া লোকদের দোফসালী ধানী জমি। অগ্রহায়ন-পৌষ মাসে ধান কাটা শেষ হলে নাড়া সাফ করে এ সব জমিতে খিরা, কপি, মরিচ আর ভূট্টার চাষ করা হত। বর্ষাকালে এসব জমি পানির নিচে তলিয়ে যেতো। বর্তমান মিলনপুর , কল্যাণপুর, মধুপর ছিল পানখাইয়াপাড়ার লোকদের ধানি জমি ও বিচ্ছিন্ন কয়েক পরিবারের বসতি। খাগড়াছড়ি শহর থেকে এক মাইল পূর্বে উত্তরে দীঘিনালা রা¯তায় খাগড়াপুর। এ পাড়ায় জয়রাম কার্বারী ও উরাচাঁন কার্বারী নামে দু’ অবস্থাপন্ন পরিবার ও তাদের আতœীয়বর্গ অধিকাংশই ছিল জুমিয়া,মুষ্ঠিমেয় কয়েক পরিবারের ধনী জমি ছিল। সেকালে সমতলে চাষবাদের চেয়ে জুম চাষে লাভ বেশি হত। এক মৌসুমে একই জায়গা থেকে বিভিন্ন ফসল পর্যায়ক্রমে আসে বলে জুম চাষ লাভজনক। পঞ্চাশ ষাট বছর আগের কথা অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে খাগড়াছড়িতে একটি মাত্র মধ্য ইংরেজী স্কুল ছিল। বর্তমান পৌরসভা অফিসের পাশে যে মেটে কোয়টায় ঘঝও এর অফিস আসে সে ঘরে ছিল মধ্য ইংরেজী স্কুল অর্থাৎ গঊ স্কুল। পৌরসভা অফিস ও ঘঝও এর অফিসের মাঝামাঝি ছিল ছাত্রবাস । সেকালে বোডিং বলা হত। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে তেমন স্কুল ছিল না। দুরদুরাšতর থেকে ছাত্র এসে স্কুলে বোডিংয়ে অবস্থান করে পড়াশুনা করত। বোডিংয়ে অবস্থান করে পড়াশুনা করা যেত বলেই এই গঊ স্কুলটিকে তখন বোডিং স্কুল বলত। এর চেয়ে বড় স্কুল ছিল না বলে কেউ কেউ বড় স্কুল ও বলত। পানছড়ি, দীঘিনালা ও মহালছড়িতে এধরনের কোন গঊ স্কুল ছিল না। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু রাঙ্গামাটিতে একটা সরকারী হাই স্কূল ছিল। চন্দ্রঘোনা রামগড় মহালছড়ি ও খাগড়াছড়ি এ চার জায়গায় মাত্র চারটি গঊ স্কুল ছিল গঊ স্কুলের পড়া শেষে হাই স্কুলে পড়ার জন্য এসব এলাকায় ছাত্রদের হয় রাঙ্গামাটি নয়তো চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাইস্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করতে হতো। তাই তখন বিদ্যার্জন খুবই কঠিন ছিল। যারা খুবই সংগতিপন্ন কেবল তারাই তাদের ছেলেদেরকে দুরে পাঠায়ে লেখাপড়া শেখাতে সক্ষম হতো। মেয়েরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে ছিল। তখন নিম্ন প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বলে দু ধরনে প্রাইমারী স্কুল ছিল। নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী এবং উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যšত পড়াশুনা হত। সে সময় থেকে তিন জন ছাত্র/ছাত্রীকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্যে বাছাই করা হতো। বোর্ডের বৃত্তি ও জেনারেল বৃত্তি বলে দু’ ধরনের বৃত্তি প্রচলন ছিল। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের তখন কতই কদর। বৃত্তি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল খাগড়াছড়ি,দীঘিনালা,খাগড়াছড়ি এসে ছাত্র/ছাত্রীরা জড়ো হতো। রাঙ্গামাটি জেলা শহর থেকে একজন সাব-ইনসেপেক্টর (বর্তমানে ঞঊঙ) এসে পরীক্ষা নিতেন। একজন সাব-ইনসেপেক্টরের কতই সম্মান। শিক্ষক ছাত্র এবং অভিভাবকেরা তাকে প্রচুর ভেট (উপটোকন) এনে দিতেন। সমাজ শিক্ষকদের তখন বেশ আদর ছিল। অভিভাবকদের ঘরে তাঁদের খানাপিনা চলতো। তখন একজন শিক্ষকের বেতন ছিল সতের /আঠার টাকা । মাসিক বেতন কম হলেও টাকার মূল্য ছিল বেশি, জিনিস পত্রের দামছিল কম। বহিরাগত শিক্ষকদের খেরাকী ছিল ফ্রি। বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি, সম্পাদক এবং অন্যান্য অভিভাবক সদস্যরা বিনা পয়সায় খায়াতেন। বিনিময়ে শিক্ষক মহাশয় তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশুনায় তদারকি করতেন। শিক্ষকদের বেতন ছিল অনিয়মিত তিন-চার মাস পর পর এক সঙ্গে মোটা অংকের বেতন পেতেন টাকাগুলো তাদের উপকারে আসত। সেই সব মোটা অংকের টাকা দিয়ে ভাল একটা কাজ করতে পারতেন। পরিবারের জন্য তেমন টাকা পাঠাতে হতো না। নিজেদের ঘর সংসারে তেমন অভাব অনটন ছিল না। বাজার থেকে তেমন কিছূ কিনতে হতো না। তরিতরকারি মাছ,মাংস বাড়িতেই উৎপন্ন হত। শুধু তেল নুন কাপড় ছোপড় বাজার থেকে আনলেই হতো। সে সময় খাঁটি সরিষার তেলের দাম ছিল প্রতিসের দেড় টাকা,লবনের সের ছিল এক আনা অথবা তিন পয়সা লংক্লথ এর গজ ছিল চার/পাঁচ আনা,একখানা ভাল ধুতির দাম ছিল পাঁচসিকে কি দেড় টাকা এবং অন্যান্য জিনিস পাতির দাম অনুরূপ স¯তা ছিল। খবংপুড়িয়াই একটি কমলছড়িতে একটি এলপি স্কুল ছিল। খাগড়াছড়ির কাছাকাছি আর কোন স্কুল ছিল না। পরবর্তীকালে পেরাছড়া ও পানখাইয়া পাড়ায় দু’’ টো এলপি স্কুল হয়। এসব স্কুল থেকে দ্বিতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণী পাশ করার পর খাগড়াছড়িতে এসে ভর্তি হতো। সেসময় হতে বর্ষাকালে কাদায় এক হাটু গেঁড়ে যেত আর গরম কালেও ধুলায় পায়ের গোড়ালি ডুবে যেত। তখন খাগড়াছড়ি গঊ স্কুল থেকে ক্লাস সিক্স পাশ করার পর হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য রাঙ্গামাটি যেতে হয়। যাদের অবস্থা একটু ভাল রাঙ্গামাটিতে বা চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে তারা ভর্তি হতো। তখন এ এলাকাবাসীর জন্য উচ্চ শিক্ষাতো দুরের কথা মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করা পর্যšত ব্যয়বহুল ও কষ্ঠসাধ্য ছিল। বখাটে ছেলেরা অনেক সময় বাপের টাকা শ্রাদ্ধ করে ফিরে আসত। তারা বাহিরে গিয়ে স্বাধীন হয়ে ওঠে,তাদেরকে পরিচালনা করার জন্য কেউ থাকে না।সঙ্গী সাথীদের সাঙ্গে মিশে উচ্ছনে যায়। এতে অধিকাংশ পরিবার আর্থিকভাবে বিপর্য¯ত হয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত লোকদেরতো বাইরে নিয়ে পড়ানো মোটেই সম্ভব হতো না। ক্লাস সিক্স পড়ার পর অধিকাংশ ছাত্রের শিক্ষার ইতি টানতে হতো। সেকালে মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থার মোটেও চল ছিল না। মা বাপেরাও খুব একটা বেশি আগ্রহী ছিল না। চাকমাদের মধ্যে তবুও দু’একটা মেয়েকে স্কুলে যেতে দেখা যেত। কিšতু মারমা,ত্রিপুরা,মেয়েদেরকে মোটেই স্কুলে দেখা যেত না। সেসময় মেয়েদের গৃহস্থালি কাজ মাকে বেশি সাহায্য করতে হতো। ছোট্ট ভাইবোনদের দেখাশুনা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না করতে হতো। ক্ষেতের কাজ কাম করতো মা-বাবা। এ ছিল সে সময়ের দৈননিন্দ জীবনের কাজ। মেয়ে বাইরে গিয়ে খেলবে কিংবা সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে গল্প গুজব করবে সেই সুযোগ ছিল না। একটু বড় হলে ক্ষেতে গিয়ে তাদের মা-বাবাকে কাজে সাহায্য করতে হতো। বাহিরে কাজ না থাকলে বাড়িতে তুলা ধুনা,চড়কা কাটা, কাপড় বুনা ইত্যাদি কাজ শিখতে হতো। সেই সময় চাকমা, মগ, ত্রিপুরা এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে বেশ সৌহার্দ্য ছিল। ভাবের আদান প্রদান ছিল। গ্রামের কার্বারী ছিল গ্রামের প্রধান। হেডম্যান এবং রাজারা এ সব কার্বারী নিয়োগ করতেন। লোকেরা ছিল রাজভক্ত। যুব, কিশোর, বুড়ো সবাই কার্বারীর কথা মেনে চলত। ঝগড়া ঝাটি মারামারি কমই ছিল। প্রতি গ্রামে একান্নভুক্ত বড় বড় পরিবারের যাবতীয় কাজ কাম চলত। সেকালে বুড়োবুড়িদের বেশ মান্য করা হতো। প্রতিবেশী গ্রাম কোন উপলক্ষে ভোজের আয়োজন হলে পাশের গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই নিমন্ত্রিত হতো। চাকমা পাড়ার ভোজের আয়োজন হলে চাকমা পাড়ার মুরুব্বিরা নিমন্ত্রিত হতো। সেকালেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। ওঁঝা বৈদ্যরা ঝাড় ফুক তন্ত্রমন্ত্র ও বনাজী ওষধপত্র দিয়ে রোগের চিকিৎসা করত। রোগ ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে তেত্রিশ কোটি দেবতাকে খুশি করার জন্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা এক ধরনের পূজা করত। তা চাকমাদের ঠানমানা এবং ত্রিপুরা কের পূজা নামে পরিচিত। অধিকাংশ পাড়া গাঁয়ে এখনো ঠানমানা বা কের পূজা প্রচলন আছে। যুুগ বদলে যাচ্ছে, যুগ বদলের সাথে সাথে পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছে। মানুষের রুচি এবং মন মানসিকতারও
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:৩৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×