এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার বই আসছে বাজারে। বইটি আসার আগে ব্লগের পাঠকদের জন্য প্রথম পর্ব দেওয়া হলো। ভাল লাগলে আরও দেওয়া হবে। প্রথম পর্বের নাম পিছন ফিরে দেখা'।
পিছন ফিরে দেখা
চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলাম।
দৃষ্টিতে ধরা পড়লো পলেস্তেরা খসে খসে পড়ছে- এমন একটা ছাদ।
বড়ই অচেনা ঠেকলো। এরকম ছাদের নিচে তো ঘুমাইনি কখনো!
মুখের ভিতর জিভটা নড়ে ওঠলো। সেখানেও পেলাম একটা অনভ্যস্ত স্বাদ। রাতে কী মুখ ধোওয়া হয়নি? এমন তো হওয়ার কথা নয়।
পিঠের নিচে ঠান্ডা শক্ত মেঝে, অমসৃন- এবড়ো থেবড়ো। চারদিকে আলো আঁধারির লুকোচুরি। উঠে বসতে চাইলাম, সারা শরীর বিদ্রোহ করলো। পিঠে তীব্র ব্যথা।
মাথাটা ঘুরিয়ে ডানে, বামে তাকালাম।
স্যাতস্যাতে ঘর, ১০ ফুট বাই ১৪ ফুট হবে। একটা মাত্র দরজা, সেখানে আবার কবাটের পরিবর্তে মোটামোটা লোহার রডের তৈরি গ্রিল। গ্রিলের পর একটা করিডোর। করিডোরের ঠিক অপর পাশে একেবারে মুখোমুখি একই রকম আরো একটি গ্রিলের দরজা। একই রকম আরেকটি ঘর। সে ঘরে কয়েকজন লোক বসে, তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
ওদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনলাম।
শরীর নাড়াতে না পারলেও চোখ ঘুরিয়ে নিজের ঘরটাকে দেখার চেষ্টা করলাম।
ঘরে কোন বাল্ব নেই, করিডোরে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা একমাত্র বিজলী বাতি থেকে ছিটেফোটা কিছু আলো এসে পড়ছিল।
সেই আলোতে অনেক কিছুই প্রথমে দেখতে পেলাম না।
দেখতে না পেলেও ঘ্্রাণ পেতে কোন সমস্যাই হলো না। তীব্র ঝাঁঝালো একটা বোটকা গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা মারলো।
প্রশ্রাবের গন্ধ।
প্রশ্রাবের সঙ্গে অনেক কিছু মিশে গন্ধটাকে করে তুলেছে তীব্র, আরও অসহ্য।
ততণ অন্ধকারটা সয়ে গেছে চোখে। দেখলাম ঘরের মধ্যেই পায়খানা প্রশ্রাবের জন্য উš§ুক্ত একটা টয়লেট।
আশে পাশে প্রচুর তেলাপোকা, টিকটিকি, আবর্জনা। কয়েকটা ইদুরকেও দেখলাম নির্ভয়ে চলাফেরা করছে।
সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মনে পড়লো জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্তের কথা।
পুলিশগুলো আমাকে মারছিল, লাঠি আর তাদের বুট জুতো দিয়ে।
কোথায় যেন আমাকে ঢুকানোর কথা ছিল।
তাহলে কি এটাই সেই জায়গা- যেখানে আমাকে ঢুকাতে তাদের এত উৎসাহ আর আগ্রহ?
প্যান টি দেখে মনে হলো অনেকণ থেকে প্রশ্রাবের বেগ চেপে ছিলাম।
উঠার কথা চিন্তা করতেই, চোখ গেল লোহার গ্রিলের দিকে। সামনের ঘরের লোকগুলো এখনো তাকিয়ে।
প্যানটি এমন এক জায়গায় যে, প্রশ্রাবের জন্য সেখানে বসলে, তা থাকবে সামনের করে লোকগুলোর দৃষ্টি সীমানার মধ্যেই।
ধারণা করলাম- এটাই বোধহয় থানা হাজত। সামনেরটা পুরুষ আসামীদের জন্য, আর আমারটি মেয়েদের।
পুরুষদেরটিতে বেশ কয়েকজন থাকলেও, মেয়েদেরটিতে আমি একাই।
কিন্তু আমি হাজতে কেন?
কী করেছি আমি?
আস্তে আস্তে মনে পড়তে থাকলো সবকিছু।
আমি চোর, আমি নাকি মোবাইল চুরি করেছি।
কার মোবাইল?
আমার স্বামীর। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের মোবাইল।
আমি যদি মোবাইল চুরিই করে থাকি, তাহলে তার হাতে যে চারটি মোবাইল এখনো সচল অবস্থায় আছে সেগুলো কোথা থেকে এলো?
চুরি যাওয়া মোবাইলগুলো কি উদ্ধার হয়েছে?
তাছাড়া ওই মোবাইল ফোনগুলো তো আমিই কিনে দিয়েছিলাম।
নিজের কিনে দেয়া জিনিস কি কেউ চুরি করে?
আমি নাকি গহনাও চুরি করেছি।
কার গহনা?
ওই বাসায় আমি আর কাজের মেয়েগুলো ছাড়া আর কোন নারী নেই।
তাহলে কার গহনা চুরি করলাম? আমার নিজের গহনাই চুরি করেছি?
আর পুলিশের নির্মম সেই মার- লাঠির বাড়ি, বুটের লাথি- এসব কেন? এভাবেই বুঝি চোরের কাছ থেকে চোরাই মাল উদ্ধার করে ওরা?
কিন্তু আমি তো চোর না।
তাহলে?
নাকি চুরির অভিযোগ নিছকই অজুহাত? রাজনীতিই কি এখানে মূল কারণ?
অথচ রাজনীতির কী ই বা বুঝতাম!
আমার স্বামী এরশাদই এনেছে আমাকে রাজনীতিতে। ছিলাম তার অনুগামী এতদিন, আমি তো ভিন্ন কোন রাজনীতি করতাম না। যা কিছু করেছি তার নির্দেশে, তার ভাল’র জন্যই করেছি।
তাহলে সে কেন মামলা করতে যাবে আমার বিরুদ্ধে?
রাজনীতিই কি নিয়ে এসেছে আমাকে এখানে? আমার তো এখানে আসার কথা ছিল না।
আর দশটা বাঙালী রমনীর মত আটপৌঢ়ে হতে পারতো আমার জীবন। তা না হয়ে এই ছোট্ট জীবনে এতকিছু ঘটে গেল!
এর সবই কি আমি চেয়েছিলাম? নাকি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আমার উপর?
সবাই কি আমাকে ব্যবহার করেছে তাদের খেলার পতুল হিসাবে? আর অসহায়ের মত, বোকার মত, আমি কেবল ব্যবহƒত হয়েছি? খেলা শেষ হলে পরিত্যাক্ত পুতুলটিকে অবহেলায় ফেলে রেখে চলে গেছে সবাই?
পিছনের দিকে তাকালাম।
মনে হলো, কত ছোট্ট এই জীবন! আর সেখানে স্মৃতির চেয়ে শক্তিশালী বুঝি আর কেউ নেই। মুহূর্তেই সারাটা জীবনকে টেনে বর্তমানে নিয়ে আসতে পারে। রিওয়াইন্ড করা ভিডিও’র মত ছবির এক একট ফ্রেম যেন সরে যেতে থাকলো।
নিজেকে আরও একবার দেখার সুযোগ পেলাম।
নিজেকে দেখলাম।
বাঙলার একজন নারীকে দেখলাম। দেখলাম নারীর অসহায়ত্বকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




