অভ্যাসটাই কেনো জানি দিনকে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুতেই খারাপ দেখি, রাস্তার পাশে ফেলে রাখা নোংরা আবর্জনার গন্ধ পাই, নিকৃষ্ট সম্ভাবনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। বোধহয়, এই ধরনের লোকদেরকেই বাংলায় বলে "ছিদ্রান্বেষী"। কী যে করি!? নিজেকে নিয়ে খুবি দুশ্চিন্তা হয়। এখানে, এই দেশে , এই সময়ে সবকিছুই কী খারাপ হচ্ছে? মোট্টেই না। ভালো জিনিষের অভাব কিন্তু নেই। ভালো খাবার, ভালো (সুন্দর) বাড়ী, ভালো শয্যাসঙ্গী (হোক সে বৈধ আথবা অবৈধ!)- সবই তো পাওয়া সম্ভব। হয়তো কিছু মালকড়ি চালাচালির বিষয় আছে এখানে, এগুলো পেতে, কিন্তু জিনিস তো ভালো। আরেব্বাস!!! ভালো জিনিস চাইবা, আর কিছু(!) খরচ করবা না , তা ক্যামনে হয়? শ্বশুর বাড়ীর আবদার পাইছো? যত্তসব ফকিরনির বাচ্চাগো মতো চিন্তাভাবনা! যাই হোক, কিন্তু এই ভালো মানুষদের ভালো ভালো সব কাজের ছিদ্র খুঁজে বের করাটা কেন জানি আমার মহা বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নয়তো পেটের ভাত হজম হতে চায় না। সবসময় একা একাই কাজটি করি। বোরিং লাগে! আসুন না, আজকে না হয় ব্লগের অনেকে মিলেই একসাথে একটু ছিদ্রান্বেষী হই।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যে ক্ষেত্রটি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সেটি হলো আমাদের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থাৎ গার্মেন্টস সেক্টর। বর্তমানে বাংলাদেশে এই খাতটি থেকে বাংলাদেশ সরকার বছরে সবচেয়ে বেশি (৭৬%) বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। একই সাথে দেশের নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যুক্ত এই শিল্পটির সাথে। সবচেয়ে বেশি মেয়েরা। তাই এই সেক্টরটি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও এর জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষা অনেকদিনের। আর এইপোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকদের সবচেয়ে বড় সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে BGMEA (Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association) যা মূলত একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রায় ৩৫০০ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান এই BGMEA এর সাথে যুক্ত। BGMEA মূলত বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকে সম্মিলিতভাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মালিক পক্ষের সংঘবদ্ধ প্লাটফর্ম হওয়ার কারণে, পোশাক শিল্পে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ যখন তুঙ্গে উঠে, শ্রমিকরা যখন তাদের ন্যায্য দাবীতে আওয়াজ তোলে সমস্বরে, তখন এই প্রতিষ্ঠানটি সবসময়ই মালিক পক্ষের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই কিছুদিন আগের ঘটনাগুলো তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সস্তা শ্রম আমাদের এই বাংলাদেশে। শ্রমিকদের ৫০০০ টাকার দাবীতে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে কাচকলা দেখিয়ে মজুরি নতুনভাবে ৩০০০ টাকা বর্তমান সরকার BGMEA এর সাথে বৈঠক করে ঠিক করলেও অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় তা অপ্রতুল। তৈরি-পোশাক খাত আছে এমন কয়েকটা দেশের ন্যূনতম মজুরি হচ্ছেঃ ভিয়েতনাম ৯২ ডলার (ঘণ্টায় ০.৪৪ ডলার), শ্রীলঙ্কা ৯২ ডলার (ঘণ্টায় ০.৪৪ ডলার), তুরস্কে ৫১০ ডলার (ঘণ্টায় ২.৪৪ ডলার), মেক্সিকো ৪৫৩ ডলার (ঘণ্টায় ২.১৭ ডলার), পাকিস্তান ১১৬ ডলার (ঘণ্টায় ০.৫৬ ডলার)। আর বাংলাদেশে এ মজুরি হচ্ছে ৪২ ডলার (ঘণ্টায় ০.২০ ডলার)। ইনডিয়ায় শ্রমিক মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ বেশি। তাই, এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, BGMEA বর্তমানে মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণকারী একটি প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক শ্রেণীর নয়।
এখন যে বিষয়টিতে আমি ছিদ্র খুঁজে পেলাম, একটু সন্দেহ দেখা দিলো আমার, সেটি হলো সম্প্রতি তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের গানের প্রতিভা অন্বেষণে BGMEA আয়োজিত প্রিমিয়ার ব্যাংক "গাও- প্রাণ খুলে গাও" নামক প্রতিযোগিতাভিত্তিক অনুষ্ঠানটি। যে BGMEA শ্রমিকদের ন্যূনতম যৌক্তিক দাবীকে রাষ্ট্রের প্রশাসনের লাঠিয়াল বাহিনীর দ্বারা ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়, তারা যখন শ্রমিকদের প্রতিভার খোঁজ খবর নেয়া শুরু করে, তার পেছনে অর্থ লগ্নি করে(!) , তখন জানি অজানা কী শংকায় মন কেঁপে ওঠে। কী কী কারণে এরকম একচোখা একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ এমন উদার হলো তার কিছু অনুমান আমি করেছি।
বাংলাদেশের জনগণ তার সংস্কৃতির কারণেই গান-কবিতার প্রতি একটু আলাদা ভালোলাগা পোষণ করে থাকে। আগ্রহও অপিরিসীম। সেই ভালো লাগা থেকেই এই ধরনের প্রতিযোগিতার প্রতি তাদের ঝোঁকের সৃষ্টি। একই সাথে আছে নিজের কোনো একটি সুপ্ত সুম্ভাবনার সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই দুই মিলিয়ে এই ধরনের প্রতিযোগিতাগুলো যে কোনো শ্রেনী, পেশা মানুষের কাছে বড় রকমের আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে। খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণীর নিকট তো অবশ্যই। তাতে আসলে এই গার্মেন্টস শ্রমিকদের কী শংকা থাকতে পারে? বেশ কিছু শংকাই এখানে কাজ করে আসলে।
প্রথমত, এই প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার সময়টা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। এতদিন পর্যন্ত মালিক সমিতি শ্রমিকদের এই ন্যূনতম মজুরীর যে দাবী পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ছিলো, তা কিন্তু এখনো রয়েছে। এখনো বিভিন্ন জায়গায়, প্রকৃত শ্রমিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো নূন্নতম মজুরী ৫০০০ টাকা ও এই দাবীতে সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর হাতে আটক হওয়া সকল শ্রমিক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে। এমন পরিস্থিতিতে BGMEA এর এই ধরনের প্রতিভা খোঁজের প্রচেষ্টা মূলত শ্রমিক আন্দোলন থেকে সাধারন শ্রমিকদের ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টি ফেরানোরই একটি প্রয়াস বলেই মনে হচ্ছে আমার কাছে।
দ্বিতীয়ত, এই ধরনের প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে দিয়ে BGMEA এই সাম্প্রতিক সময়ের যৌক্তিক কারণে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলন ও এর রেশ বন্ধ করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণ পোষাক শ্রমিকদের উপর অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে দেশের আপামর মানুষের কাছে তাদের যে ভাবমূর্তি হারিয়েছে, তা কিছুটা হলেও পুনুরুদ্ধারে সচেষ্ট হচ্ছে বলেই আমার দৃঢ় ধারনা। একই সাথে এই আয়োজনের ভিতর দিয়ে তারা এক ধরনের "Social Responsibility" প্রদর্শন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে এবং নতুন করে জনমানসে নিজেদের এক ধরনের গ্রহনযোগ্য ও পজেটিভ অবস্থান তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে, যদিও তার কর্পোরেট রূপটি একেবারেই দিবালোকে পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। কেননা, মিডিয়া কেন্দ্রিক এই ধরনের প্রতিভা অন্বেষণের প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য যে প্রতিভার উদার ও অনৈতিক বানিজ্যিকীকরণ; সচেতন ব্যক্তিমাত্রই এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট বোঝেন। আবার এর মধ্যে দিয়ে তারা স্ব স্ব শমিকদের নিকট নিজেদের একটা পজেটিভ ইমেজ তৈরি করারও উদ্যোগ নেবে।
তৃতীয়ত, এই ধরনের আয়োজনের ভিতর দিয়ে মালিকপক্ষ পোশাক শ্রমিকদের ভিতর একধরনের আত্নকেন্দ্রিক বোধ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে বলেই আমার ধারনা। যারা এই ধরনের আয়োজনগুলোর সার্বিক বিষয় সম্পর্কে ধারনা রাখেন, তারা জানেন এই আয়োজনগুলোর ফলাফল শেষ পর্যন্ত আয়োজক গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের উপরি নির্ভরশীল, বিচারক, sms বা এই ধরনের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা হলেও মূল বিচারে তা কখনোই আয়োজকের স্বারথবিরোধী বা উদ্দেশ্যের বিপরীত হয়ে উঠে না। ফলে আয়োজক গোষ্ঠীগুলো এই প্রক্রিয়ার দ্বারা সহজেই অংশগ্রহণকারীদের চিন্তা চেতনা দৃষ্টিভঙ্গি ও সার্বিক আচরণে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ পায়। এই সুযোগের অনৈতিক ব্যবহারের ভুরি ভুরি উদাহরণ মিডিয়া জগতে মেলে। BGMEA এর এই প্রতিভা খোঁজার আয়োজনের অন্তরালে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে স্বার্থপরতার বীজ বপনের চক্রান্ত সুস্পষ্ট। বিভিন্ন রাউন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ও সেই লড়াইয়ে থাকা প্রতিযোগিদের তখন সহজেই সুন্দর আগামীর(!) স্বপ্ন দেখিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার বড় ধরনের সুযোগ তারা পেয়ে যাবে। এতে মূল আন্দোলন ও তাদের যৌক্তিক দাবী আদায়ের যে লড়াই শেষ পর্যন্ত তা চরম্ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে আমার আশংকা রয়ছে। সহজ সরল পোশাক শ্রমিকরা খুব স্বাভাবিক কারণেই তাদের এই চক্রান্ত বুঝতে সক্ষম নয়, কেননা এই ধরনের উচ্চ (কু)বুদ্ধিসম্পন্ন psychological game এ তারা অভ্যস্ত নয় এবং একই সাথে এই বিষয়টি সামগ্রিকভাবে অনুধাবনের জন্য যে শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রয়োজন তা থেকে এই সমাজব্যবস্থায় তারা সবসময়ই বঞ্চিত হয়ে আসছে।
যে বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর ও হীন বলে মনে হয়েছে, সেটি হলো, এই ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে খুব সহজেই BGMEA পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছে এই সকল আন্দোলন ধরে, তা নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা চালাবে, এবং নিঃসন্দেহে তাদের চক্রান্তের সফলতার জন্য এই ধরনের আয়োজন বড় ধরনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশ শব্দের আবরণে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও, এর সংস্কৃতি এখনো সামন্তবাদী। আর সামন্তবাদী সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা নিম্নবর্গের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে লুম্পেন চরিত্র থাকা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। আমার ধারনা এই প্রতিযোগিতার ডামাডোলের আড়ালে BGMEA সেই সুযোগটি গ্রহনের চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিযোগিতার নাম করে তা পোশাক শ্রমিকদের একটি অংশকে বিশেষ সুবিধা দানের মাধ্যমে মালিকপক্ষ তাদের স্ব-শ্রেণীর বিপক্ষ হিসেবে দাড় করিয়ে দেবে। এর ফলশ্রুতিতে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে যে ঐক্য তা বিনষ্ট হবে, সামগ্রিকভাবেই তাদের যৌক্তিক আন্দোলনটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু সেখানে এখন যেমন মালিক-শ্রমিক পক্ষ-বিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তা না হয়ে শ্রমিক-শ্রমিক পক্ষ-বিপক্ষ হবে। অর্থাৎ নিজেদের পায়ে তারা মালিকদের পরিকল্পিত পন্থায় নিজেরাই কুড়াল মারবে/ মারতে উদ্যত হবে। আর এতে সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে মালিকশ্রেণী তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা আবারো পোশাক শ্রমিকদের প্রশ্নাতীতভাবে শোষণের সুযোগ পেয়ে যাবে। বিপরীতে শ্রমিকরা এই সকল ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে নিজেদের প্রতিই আস্থাহীনতায় ভুগবে, যা তাদের পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হবে।
তাই শেষ পর্যন্ত পোশাক শ্রমিকদের প্রতিভা অণ্বেষণের এই প্রক্রিয়াকে আমার কাছে মোটেও শুভ উদ্যোগ বলে মনে হচ্ছে না। এর অশনি সংকেত অনেক বেশি গভীর ও উদ্বেগজনক। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমি এই ধরনের নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিভা অণ্বেষণের বিপরীতে অবস্থান করি না। আমার বক্তব্য হচ্ছে, এই ধরনের উদ্যোগ আসলে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান না নিয়ে বরং তা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে করা উচিৎ। তাহলে এর প্রক্রিয়া অনেক বেশি সুষ্ঠু হবে, এতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রতিভার বিকাশ করা ও তাকে সাপোর্ট করা সম্ভব হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




