ডাইনোসরেরা দৌড়ালো ডেন্টিষ্টের কাছে । ডেন্টিষ্ট ডাইনোদের শরীরের সঙ্গে মানানসই ইয়া লম্বা লম্বা দাঁত ফিট করতে গেল । কিন্তু বিপদ এল যখন ডাইনোসরেরা বেঁকে বসল । বললো, আমাদের ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দাও । বড় দাঁত আমাদের একঘেয়ে হয়ে গেছে । পেছন থেকে অন্য ডাইনোসরেরা চীত্কার করে উঠলো , উল্টে দাও, পাল্টে দাও । ডাক্তার বললো, তোমরা ছোট্ট ছোট্ট দাঁত নিয়ে কি করবে ? ঝিনুক তো ভাঙতে পারবে না । তখন ডাইনোসরেরা বললো, তাহলে মানুষের মত দাঁত দাও । ডাক্তার ভাবলো, মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী: ওদের দাঁত দিয়ে দিলে ডাইনোদের দাঁতের বুদ্ধি খুলে যাবে । ফলে ঝিনুক ছেড়ে কোপ্তা কোর্মা খাবে । তখন স্বাভাবিক খাদ্য শৃঙ্খলে টান পড়বে । মুখে বললো, মানুষের দাঁত ? ঐ দাঁত পড়লে কিন্তু সারাদিন মানুষের মত বকবক করবে । ডাইনোসরেরা সমস্বরে বললো না না ঐ দাঁত চাই না । আমাদের নিজেদের দাঁত ফিরিয়ে দাও । ডাক্তার পড়লো বিপদে । তার কাছে ডাইনোসরের দাঁত ছিলো না । সে বললো, দাঁত একবার গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না । দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে হয় ।
এদিকে বুড়ো ডাইনোসরদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগলো । সরকার ভয় পেয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে দশ দফা কর্মসূচী নিয়ে এলো । কেন না , সরকার সেই বছরই ওল্ড সিটিজেনদের সুবিধা দানের জন্যে বিশ দফা কর্মসূচীর প্রস্তাব করেছিল । সরকার এখন দেখল বয়স্ক নাগরিকদের সুবিধাদানের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করা অসম্ভব । ট্যাকশাল এমনিতেই শূণ্য । ফলে দপ্তরে দপ্তরে সার্কুলার পাঠালো, জনসংখ্যা বাড়াও । ছোটদের যোগান বাড়লে তবেই বুড়োদের চাহিদা প্রশমিত হবে । নির্দেশ জারী হল । আওয়াজ উঠলো- প্রতি ঘরে দশটি শিশু । কেউ রবীন্দ্রনাথ কেউ যীশু ।। ঘোষণা করা হল, প্রতি পাঁচ বছরে সর্বাধিক উত্পাদনকারী দম্পতি কে ধৃতরাষ্ট্র পুরস্কার দেওয়া হবে । দশের বেশি সন্তান থাকলে মা-বাবাকে কেবিসি তে সরাসরি প্রতিদ্বন্দিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে ।
ছোট ডাইনোসরদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল । তাদেরকে সর্বত্র গুরুত্ব দেওয়া শুরু হল । সরকার থেকে ভোটাধিকারের বয়স কমিয়ে দেওয়া হল । ষ্টার টিভি জুনিয়ার কেবিসি চালু করে দিল । বুড়োদের পরিবর্তে ছোটদের মীমাংসার রায়ই অঞ্চলের সবাই মেনে নিতে লাগলো । ছোট ডাইনোসরেরা ঝিনুক ভেঙে দিত অর বুড়োরা মুক্তো চুষে চুষে খেত । ফলে বুড়োরা ক্রমশ অলস ও অকর্মণ্য হয়ে পড়তে লাগলো । তারা শুধু বসে বসে ছোটদের সমালোচনা করত । ছোটরা রোজ নিন্দে শুনতে শুনতে একদিন বলে উঠল, ধ্যাত্তেরিকা । তারা লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিল । তাদের অন্য একটা ইস্যু ও ছিল । তাদের মধ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বিপদজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল । মানবাধিকার কমিশন থেকে সরকারকে নোটিশ পাঠানো হল ।
বুড়ো ডাইনোসররা পড়ল বিপদে, তারাও সরকারের কাছে দরবার শুরু করলো । খাদ্য দপ্তরে গিয়ে বললো, রেশনে মুক্তো দেওয়া যেতেই পারে শুধু একটু অসুবিধা আছে । পাইল করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ঝুটা মুক্তো যতদিন না আমরা তৈরী করতে পারছি ততদিন আপনাদের না খেয়ে থাকতে হবে । ডাইনোসরেরা বললো, তা কি করে সম্ভব ! খাদ্য মন্ত্রক বললো, আমাদের কিছু করার নেই । রেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে গেলে আগমার্ক থাকতেই হবে । ভেজাল না থাকলে আগছাপ পড়বে না । ডাইনোসরেরা বললো, তা বলে না খেয়ে থাকতে পারবো না । আপনারা ভেজাল মেশান । খাদ্যদপ্তর খুশিই হল, আপনারা এক্ষুনি তথ্য প্রযুক্তি দপ্তরে খোঁজ নিন ভেজাল মুক্তো কোথায় তৈরী হচ্ছে ।
ডাইনোসরেরা গেল তথ্য ও প্রযুক্তির দপ্তরে । তথ্য প্রযুক্তি দপ্তর ইন্টারনেটে অনেক ঘেঁটে ঘুটে বলল, আমেরিকার গান্ধী মেমোরিয়াল ল্যাবে নকল মুক্তো তৈরী হচ্ছে বটে কিন্তু খাদ্য দপ্তরের যে পরিমাণে দরকার তাতে ঐ ল্যাবের দশ বছর লেগে যাবে । এই রকম দশ খানা ল্যাবে যদি বানানো যায় তবে এক বছর লাগবে । একশো খানা ল্যাবে বানাতে পারলে মাস খানেক আপনাদের না খেয়ে থাকলেই চলবে। তবে বিশ্বায়ন ছাড়া বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুক্তো বানানো অসম্ভব । আপনারা শিল্পদপ্তরে চাপ দিন ।
ডাইনোসরেরা সকলে মিলে শিল্পদপ্তরে গেল । তারা শুনে চমকে উঠলো, খাদ্য দপ্তরের রাস্তায় পা দেবেন না । সাগর থেকে মাগনা পাওয়া মুক্তো কিনে খেতে খেতে একদিন দেউলিয়া হয়ে যাবেন । তার থেকে কিছু ভালো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীকে ডেকে আনি । তারা তাদের নব প্রযুক্তির নতুন মেশিন-পত্তর দিয়ে ঝিনুক গুড়িয়ে মুক্তো সাপ্লাই দেবে । ফ্রেশ আর ভেজাল-টেজাল থাকবে না । আর দশটা কোম্পানী এলে কম্পিটিশনে দামও কম থাকবে । আপনারা বিদেশ মন্ত্রকে খোঁজ নিন । কোন বিদেশী কোম্পানী বিনিয়োগ করতেচায় কিনা
বিদেশী কোম্পানীগুলো সমুদ্র পারে তাদের অফিস খোলার জন্যে মুখিয়ে ছিল । কাগজে টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতে লাগলো কী ভাবে তাদের প্রযুক্তি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে ঝিনুক ! সরকার ঠিক করলো এবার বিশ্বায়ন করবে । ডাইনোসরেদের কানে গেল সেই কথা । তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো । বিদেশী কোম্পানী প্রথমে দাঁড়াবে, তারপর বসবে তারপর শুতে চাইবে । আস্তে আস্তে নিজস্ব শিল্প সংস্থা সব লোব পাবে । তখন মুক্তোর বদলে ম্যাকডোনাল্ড চুসতে হবে । সে আরেক বিপদ । তারা সরকারকে লিখিত ভাবে জানালো, বিশ্বায়ন করে সমস্যার নিরসন চাই না । অন্য ভাবে খাদ্য সমস্যা মেটান । সরকার বললো, তাহলে হরলিক্স বা কমপ্ল্যান খান ।
হরলিক্স, কমপ্ল্যানের বিক্রি খুব বেড়ে গেল । কিন্তু বুড়োরা কিছুদিনের মধ্যেই বিপদ টের পেতে লাগলো । তাদের ছিল খুব সন্দেহ বাতিক । তারা সব কিছুর মধ্যেই বিপদ টের পেত । বুড়োরা কেউ চোঁ চোঁ করে লম্বা হতে লাগলো, কারও স্মৃতিশক্তি খুব বেড়ে যেতে লাগলো । স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে জানানো হলো, তোমরা যখন বিশ্বায়ন করতে দিলে না তখন এরকম ছোট-খাট সমস্যা দেখা দেবেই । ডাইনোসরেরা বললো, এই ভাবে চললে আমাদের গায়েও ডারউইনবাদের হাওয়া লেগে যাবে । আমরা পাল্টে যেতে চাই না । এ রকম চললে ক্রমে ক্রমে আমরা অন্য স্পিসিস হয়ে যাবো । স্বাস্থ্য দপ্তর বললো, হু । তাহলে কোক কোক খাও । পেপসি খাও ।
অবশেষে বিশ্বায়ন হল । একে একে বিদেশী কোম্পানী আসতে শুরু করলো । ডাইনোসরেরা ক্রমশ পাল্টে যেতে লাগলো । এখন তারা সব কিছু মেনে নিতে শিখেছে । ম্যাকডোনাল্ড, ডগ-বিস্কুট পেপসি খায় । এখন প্রায় মানুষের মতই বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে । দাঁত পড়লে ডেনটিষ্টের কাছে যায় বটে তবে এখন আর সমস্যা হয় না - মজার ব্যাপার মানুষের দাঁত তাদের দিব্যি ফিট করে যায় । সব চেয়ে বড় কথা তাদের বুড়ো হওয়ার বয়স এখন অনেক বেড়ে গেছে, আসলে সিস্টেমটাই বদলে গেছে কিনা !
প্রথম প্রকাশ : অক্ষর, শারদীয়া সংখ্যা, ১৪০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


