(২)
কার্ফিউ শিতিল হলো:
মেরাথন কার্ফিউ এর কারণে মানুষ ঘরের ভেতর বন্দী হয়ে রইলো। দেখামাত্র গুলির নির্দ্দেশ। বাজার-হাট বন্ধ। প্রায় প্রতিটি ঘরে খাবারে টান পড়লো। ফ্রিজের প্রচলন তেমন নেই। সারা শহরে হয়তো দুই একটা ঘরে আছে। তিনদিন বাদে কার্ফিউ কিছু সময়ের জন্য শীতিল হলো। ঘরের বার হওয়ার একটা সুযোগ হলো। রাস্তায় এখন আর ব্যারিকেড নাই। বাঙালি পুলিশ আর ইপিআর সদস্যদের ধরে এনে তাদেরকে দিয়ে ব্যরিকেড অপসারণ করা হয়েছে। পুরো দেশটি এখন কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে । কয়েদির মতো নিয়ন্ত্রিত মানুষের চলাফেরা। কিছু কিছু দোকানপাট খুলেছে। কিন্তু বেচা-বিক্রির দিকে দোকানিদের খেয়াল নেই। চাল ডাল নুন প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য টেনে টেনে নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে ব্যাস্ত হলো তারা। প্রথম প্রথম মিলিটারীরা গলিপথ দিয়ে তেমন ঢুকতো না। কার্ফিউ এর মধ্যে দ্রুত পায়ে এ-বাসা থেকে ও-বাসা যাওয়া যেতো। কিন্তু ঝুকিঁ ছিলো। একদিন গলি দিয়ে এসে বাসায় পা রেখেছি মাত্র। এসময় বিপরিত দিক থেকে প্রচুর ধূলো উড়িয়ে একটি মিলিটারী জীপ অতিক্রম করে গেলো। আমাদের বাসার সামনে একটি মেস ছিলো। মেসের কেউ একজন দরজা খুলে উকিঁ দিয়েছিলো। সাথে সাথে একটি বুলেট এস দরজায় বিধলো। কারফিউ এ ঘন্টা দুই-এক সময়ের বিরতিতে আমাকে চলে যেতে হলো গ্রামের বাড়িতে। সুরমা নদীর অপর পাড়ে কদমতলী বাস ষ্ট্যান্ড। সেখান থেকে মুড়িরটিন মার্কা বাসে যেতে হয়। চালকের পেছনে আড়াআড়ি দুই সারি লম্বা বেঞ্চ। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি হালকা কুশন। এটি ‘আপার ক্লাস’। পেছনে লম্বালম্বী তিন সারি কাঠের বেঞ্চ। এটি ‘লোয়ার ক্লাস’। সৌভাগ্যক্রমে একটি বাস পেয়ে গেলাম। এই একটিমাত্র বাসই ছাড়ছে আজ। বাসে উঠে বসলাম। ষোল মাইলের মাথায় আমাদের বাড়ি। এইটুকু পথ যেতে অনেক সময় লাগতো। বারো মাইলের মতো হবে গোলাপগঞ্জ বাজার। সেখানে একটা বিরতি হতো। বাস ছাড়ার পরপরই থামতে হলো। তল্লাশি হবে। আমরা বাস থেকে নামলাম। দুই জন মিলিটারী সিপাহি। যুদ্ধ সাজে। ভয় জাগানো চেহারা। একজন নিরস্ত্র বাঙালি পুলিশ অফিসার। দুই তিনজন নিরস্ত্র বাঙাললি পুলিশ সদস্য। মিলিটারী সিপাহিরা বীরদর্পে দাড়িয়েঁ রইলো। কেন জানি ঐ বয়স্ক পুলিশ অফিসারের চেহারাটি মনের মধ্যে গেঁথে রইলো। এখনও মনে আছে। কপালজুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পরনের খাকিঁ সার্টটি ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। বিমর্ষ চেহারায় বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তল্লাশী করলেন। তাদেঁর মধ্যে একটা রবোটিক আচরণ লক্ষ্য করলাম। মূল্যবান যাকিছু পাওয়া গেলো রেখে দেওয়া হলো। বাস চলতে শুরু করলো। ‘ভইটিকর’ নামক স্থানে এসে আবার থামতে হলো। তল্লাশী হবে। এখানে মুক্তিবাহিনী। চৌকষ স্মার্ট কয়েকজন বেঙল রেজিম্যান্টের সৈনিক। তাদের দেখে বুকটা ভরে উঠলো। তল্লাশী শেষে গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। অর্থাত এখন আমরা মুক্তাঞ্চলের ভেতর দিয়ে চলছি। অবশেষে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ি পৌছেঁ দেখলাম, আমাদের চাচা শিকার করা যার শখ। মানুষ যাকেঁ শিকারী বলে ডাকে। তিনি পুকুর পাড়ে গ্রামের মানুষকে ট্রেনিং দিচ্ছেন। অস্ত্র বলতে দুইটি দু-নলা বন্ধুক, একটি টুটু বোর আর একটি এয়ার গান। বাকি সব বাশেঁর লাঠি। পাখি শিকারের বন্ধুক আর সাপ পেটানোর লাঠি। এগুলো যুদ্ধের জন্য কতটা উপযোগী। পাকিস্তান আর্মীর সাবেক সদস্য আমাদের শিকারী চাচার জানা না থাকার কথা নয়। কিন্তু সময় তখন অন্যরকম। মুক্তির নেশায় মেতেছে মানুষ।
...চলবে।।