ছবিঃ অন্তর্জাল।
পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভায় ছোট ছোট মাচাং গুলোকে কেমন অন্যরকম লাগছে। পাহাড়ের গায়ে টুপ করে সন্ধ্যা নেমে যায়। বুনো ফুলের কেমন মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছে। চায়ের কাপটা রাখতে রাখতে আমি তাকায় অংশুমান এর দিকে। চুলে হালকা পাক ধরেছে, ভারী শরীর। মাঝে কত বছর কেটে গেল, বছর দশেক। এই দশ বছরে কত কিছু ঘটে গেছে।
কুন্তলা কেমন আছো?
ভালো। আমার কি ওকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করা উচিত? কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করছে না।
আমি কেমন আছি জানতে চাইলে না?
আমি ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকি, হুম বলো।
অংশুমান একটা বক্স এগিয়ে দেয় আমার দিকে। কি এটা?
দেখো.....
বক্সের ভেতর সোনালী কাগজ মোড়ানো চকলেট দেখা যাচ্ছে। আমার গলার ভেতর মনে হচ্ছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। ওহ ইশ্বর, আমি চাচ্ছি না ওর সামনে কাঁদতে। এত বছর পর ও ঠিকই মনে রেখেছে। তখন আমি বলতাম আমাদের যখন দেখা হবে আমার জন্য এত্তগুলা চকলেট নিয়ে আসবা। আমি অনেক কষ্টে কান্না গিলে ফেলি। অংশুমান এত বছর পর কেন?? দূরের পাহাড়ে কোথাও মৃদু তালে মাদল বাজছে। সেই সুরে আমার ভেতরেও যেন কিসের ব্যথা বেজে ওঠে।
কুন্তলা কি ভাবছো এত?
নাহ, কিছু না।
আমি স্যরি , আমার অনেক গিলটি ফীল হয়। তখন আমি অনেক ভয় পেতাম। আর তুমি ও তো চাওনি তাই আমি আর কিছু বলিনি।
স্যরি , আচ্ছা তোমাদের এই স্যরি এত স্বস্তা কেন? একটা স্যরি বললে আর সব হয়ে গেল। আর তুমি কিসে ভয় পেতে? তোমার অর্থ, সোশ্যাল স্ট্যাটাস এইসব তো? অংশুমান তুমি হয়তো জানো না মানুষের সবথেকে বড় ভয় একাকিত্বের ভয়। এই যে তুমি বলো তোমার অনেক লোনলি ফীল হয়। কেন বলতো? বড় লোকের সুন্দরী মেয়েরা কি তোমার লোনলিনেস দূর করতে পারেনি?
আর কি বললে আমি চাইনি, কি চাইবো বলো তো? তোমার অর্থ, সোশ্যাল স্ট্যাটাস তো আমি কোনদিন চাইনি, ওসব যদি প্রয়োজন থাকতো তাহলে ভিক্ষে চাইতে পারতাম, কিন্তু ভালোবাসা তো ভিক্ষে চাওয়ার বিষয় নয়। তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার পায়ে পরে কাঁদবো? ওহ অংশুমান, তোমার চিন্তাধারা এত নীচ হলো কবে থেকে....
কুন্তলা তুমি অনেক বদলে গেছ।
হা হা হা, আমি বদলে গেছি নাকি তোমার কন্ঠস্বরের মত তুমিও বদলে গেছ তাই এমন মনে হচ্ছে। আচ্ছা, এই তুমিই তো একদিন চাইতে আমি বদলে যাই, তাহলে এখন কেন নিতে পারছোনা বলতো? সত্যিই তোমাদের পুরুষদের মধ্যে এত হিপোক্রেসি।
এমন অপরিচিতার মত কথা বলছো কেন?
চেনা মানুষকে অন্য কেউ ছুঁলে সেখানে আর কোন অধিকারবোধ থাকে না। অধিকার আর বোধ ব্যাপার দুটিযে একসাথে জড়িত। যেখানে এই দুটি নেই, সেখানে আর পরিচিতা থাকলাম কীভাবে?
জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধানে যে সময়টা এটা কি বলতে পারো? পুরোটা হচ্ছে অনুভূতির খেলা। মোহ, কাম, মায়া এই তিনটা স্তর সবাই পার হতে পারে না, যারা মায়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তারাই পারে একটা জীবন জয় করে নিতে। তুমি পারোনি অংশুমান।
কুন্তলা প্লিজ, ওভাবে বলো না....
কেন অংশুমান খুব লাগছে? সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর ও আমি তো চেয়েছিলাম খুব দামী পারফিউমের মত সযত্নে তুলে রাখতে, তুমিই তো আর দশজনকে আমাকে নিয়ে বলে বেড়াতে লাগলে, নিজেকে সস্তা কর্পূরের মত বানিয়ে ফেললে। অতিরিক্ত সম্মান, ভালোবাসা কোন কিছুই বেশীরভাগ মানুষ নিতে পারে না, তুমি ও পারোনি।
দূরে কোথাও গীর্জার ঘন্টা ধ্বনি বাজছে। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। ঘন্টাখানেক আগে লাস্ট বাসে অংশুমান চলে গেছে। ঝিরি পথ ধরে আমি এগিয়ে যাই। নীচের খাদে একটা বক্স গড়িয়ে পড়ে। সেদিন ও এমন ঝলমলে রাত ছিল। অংশুমান তুমি জানোনা, দুহাতে যতটা কাছে টেনে নিতে জানি, ঠিক ততটাই দু পায়ে ঠেলে দেয়ার ক্ষমতা আমি রাখি। তোমায় না পাওয়ার ব্যথা যতটা আমাকে পোড়ায়, তারচেয়ে বেশী পোড়ায় তোমার প্রতি এই যে আমার ঘৃণাবোধ। চলে যাও অংশুমান, ঠিক ততটাই দূরে, যতটা দূরে গেলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মত আর কোন অনুভূতি কাজ করে না। জন্ম নিয়েই কেউ সুখী হয় না, যে যার মত সুখ সৃষ্টি করে নিতে হয়। আমি কুন্তলা বিষাদের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। আমার দেয়াল ঘড়ির কাটায় আর তুমি নেই। পাঁজরের পুরনো ব্যথার মত বহু বছর পর এভাবে ফিরে এসো না।
রাতের নিস্তব্ধতায় এপিটাফের লিখার মত সহস্র অভিমান আমার ভেতর বয়ে যায়। ভেজা চোখের এ অনুভূতি কি ঘৃণার নাকি মায়ার রাতের আলো-আঁধারির মত তা অস্পষ্ট থেকে যায় আমার কাছে। অদ্ভুত এক অনুভূতির মায়াজাল ঘিরে ধরে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১২:১২