পাথরকুচি পাতা থেকে তৈরি দ্রবণই বিদ্যুত্ তৈরির মূল উপাদান। বিদ্যুৎ দিয়ে এনার্জি বাল্ব জ্বালাচ্ছেন উদ্ভাবক মো. কামরুল আলম খান ছবি: মনিরুল আলম * ভাঙাচোরা একটি চেয়ারের ওপর একটি ছোট বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। লক্ষ করলে মনে হবে, পাখায় বিদ্যুত্সংযোগ নেই। আছে শুধু একটি প্লাস্টিকের মগের মধ্যে সবুজ রঙের তরল পদার্থ। সেই তরলের মধ্যে দুটি ধাতব পাত ডোবানো। পৃথক তার সেই পাত দুটিকে যুক্ত করেছে পাখার সঙ্গে। এতেই পাখা ঘুরছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি পরীক্ষাগারের সামনে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সপ্তাহখানেক ধরে এই পাখাটি অবিরাম ঘুরছে। মগের ওই তরল পদার্থ আসলে পাথরকুচি পাতার রস। ওই রসই বিদ্যুতের মূল উৎস। নতুন এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. কামরুল আলম খান। তিনি বললেন, পাথরকুচির পাতা থেকে উত্পাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে বাতি জ্বালানো, পাখা ঘোরানো এমনকি টেলিভিশন চালানোও সম্ভব। এতে খরচও অনেক কম। শুরুর গল্প: কামরুল আলম বলেন, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা, বিদ্যুৎ সমস্যা—এসব নিয়ে ভাববার সময় মনে হয়েছে উদ্ভাবন ছাড়া সংকট মোকাবিলা সম্ভব হবে না। নবায়নযোগ্য শক্তির কথাও ভেবেছেন তিনি। এসব ভাবতে ভাবতেই পাথরকুচি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালের শুরুর দিকের কথা। এক ছাত্রকে দিয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে এক কেজি পাথরকুচি পাতা নিয়ে আসেন তিনি। তারপর শুরু হয় গবেষণা। কয়েক মাসের মধ্যেই আশানুরূপ ফল পেলেন তিনি। প্রথমে ১২ ভোল্টের ক্ষুদ্র আকৃতির বাতি জ্বালিয়ে তিনি আশার আলো দেখতে পান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে এই উদ্ভাবনের মেধাস্বত্ব নিবন্ধন (প্যাটেন্ট) করেন তিনি। এরপর গত দেড় বছরের গবেষণার পর বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, সাদাকালো টেলিভিশন চালাচ্ছেন তিনি। গবেষণার টেবিলে পাথরকুচি: বাংলাদেশে পাথরকুচি পাতা নামে পরিচিত হলেও (বৈজ্ঞানিক নাম Bryophillum বা ব্রায়োফাইলাম) বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। ভেষজগুণের কারণে অনেকে পাথরকুচিকে ‘মিরাকল লিফ’ বলেন। পেটের ব্যথা কমাতে দেশের অনেক অঞ্চলে এই পাতার ব্যবহার আছে। পাথরকুচির পাতায় কী আছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে? এমন প্রশ্নের উত্তরে কামরুল আলম বলেন, পদার্থের মধ্যে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন ও ক্ষারীয় হাইড্রোক্সিল আয়ন থাকে। এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন বেশি পরিমাণে থাকলে সেই পদার্থ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তিনি বলেন, পাথরকুচি পাতায় হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুবই সহায়ক। কামরুল আলম আরও কয়েকটি গাছের পাতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন তেঁতুল, লেবু, আলু, আম, কাঁঠাল, টমেটো, বটের পাতায় ক্ষারীয় আয়নের পরিমাণ বেশি বলে বিদ্যুৎ উত্পাদন সম্ভব নয়। যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়: পাথরকুচি পাতা দিয়ে ব্লেন্ডার মেশিনের মাধ্যমে শরবতের মতো দ্রবণ তৈরি করা হয়। দ্রবণে পাথরকুচি পাতা ও পানির অনুপাত হতে হবে ৮:১। ওই দ্রবণ প্লাস্টিকের পাত্রে রাখা হয়। এরপর একটি তামা ও একটি দস্তার পাত দ্রবণে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। দ্রবণের সংস্পর্শে আসামাত্রই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে তামার পাতে ধনাত্মক ও দস্তার পাতে ঋণাত্মক বিভবের (পটেনশিয়াল) সৃষ্টি হয়। বিপরীতমুখী এই বিভবের দ্বারাই দুই পাতের মধ্যে বিভব পার্থক্য হয়। এতেই বিদ্যুত্প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বেশি বিদ্যুৎ পেতে হলে একাধিক তামা ও দস্তার পাত ঘন করে সমান্তরালভাবে বসাতে হবে। পাথরকুচি পাতা চাষ: পাথরকুচি পাতার চাষ বেশ সহজ। পাথরকুচির শুধু পাতা মাটিতে ফেলে রাখলেই সেখান থেকে গাছ জন্মায়। পতিত জমি, বাড়ির ছাদে, উঠানে, টবে, যেকোনো জায়গায় এই পাতার চাষ সম্ভব। কামরুল আলম বলেন, দেশের পতিত জমিতে সহজেই প্রচুর পাথরকুচি পাতার চাষ সম্ভব। আর চাষের এক মাসের মধ্যেই পাতা কাজে লাগানো যায়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ তৈরি করতে এক মাসের মধ্যে নতুন করে পাথরকুচির দ্রবণের প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আলোকিত করতে পরিকল্পনা করেছেন কামরুল আলম। এর জন্য ৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ দরকার হবে। আর ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে লাগবে প্রায় ৪০০ কেজি পাতা। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা মুঠোফোনে তাঁকে বলেছেন, তাঁরা পাতা সরবরাহ করবেন। খরচ হবে কম: কামরুল আলম বলেন, পাথরকুচি পাতা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হবে কম। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়বে এক টাকার কম। এটা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের তিন ভাগের এক ভাগ। তিনি দাবি করেন, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে অবকাঠামো খাতে ব্যয় হবে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি: এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক পাখা তৈরি করেছেন কামরুল আলম। ১২ ভোল্টের এই বৈদ্যুতিক পাখা টানা এক মাস হাওয়া দিতে পারে। এক মাস পর শুধু দ্রবণ পাল্টে দিলেই পাখা আবার ঘুরবে। কামরুল আলম বলেন, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত্সংযোগের আওতায় এলেও লোডশেডিংয়ে তারা বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, পল্লি অঞ্চলে তাঁর প্রযুক্তি সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব হবে। প্রতিটি পরিবার নিজেদের প্রয়োজনের বিদ্যুৎ নিজেরা উৎপাদন করতে পারবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর দ্রবণের বর্জ্য অন্য কাজেও ব্যবহার করা যাবে। পাথরকুচির বর্জ্য কোনো পাত্রে বদ্ধ অবস্থায় রাখলে তা থেকে মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়। এই গ্যাস দিয়ে রান্না করা সম্ভব। গ্যাস উৎপাদনের পর বর্জ্য আবার জৈব সার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। চাই আরও গবেষণা: কামরুল আলম খান নিজের অর্থে এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সহায়তা নিয়ে এ পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারছেন না। পাথরকুচির দ্রবণ রাখার জন্য তাঁর দরকার বড় বড় পাত্র। বর্তমানে তিনি ব্যাটারির খোলস ব্যবহার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্বব্যাংক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ‘হেকেপ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প আছে। এই প্রকল্প গবেষণায় সহায়তা দেয়। কামরুল আলম পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন ও গবেষণার জন্য সেখানে এক কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। কামরুল আলম বলেন, পাথরকুচি পাতা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য আরও একটি গবেষণা চলছে। তিনি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি চলছে। কামরুল আলম খান বলেন, ‘প্রথমে আমি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও পরবর্তী সময়ে পুরো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এই বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত করতে চাই।’ এ ক্ষেত্রে সফল হলে তিনি দ্বীপাঞ্চলের মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেবেন। এ জন্য ‘পাথরকুচি পাতাপল্লি’ স্থাপন করার পরিকল্পনা তাঁর আছে। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।
আলোচিত ব্লগ
=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=
০১।
=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা
ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা
সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন
পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।
পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।
জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সমস্যা মিয়ার সমস্যা
সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।
তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন