somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লগাররা কি সাংবাদিকদের চেয়ে প্রভাবশালী?

২৮ শে জুন, ২০১৪ রাত ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাজী আলিম-উজ-জামান
জনগণকে তথ্য ও মতামত দিয়ে সহায়তা করার বিষয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা বরাবরই অগ্রগণ্য। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্ব ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। এতে সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহ ও সাধারণ মানুষে তথ্য আহরণের ক্ষেত্র বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে তথ্যদাতা এমন কিছু মানুষের সংখ্যা, যাঁরা সরাসরি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু তথ্য দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের ভূমিকা প্রবল। এর মধ্যে প্রভাবশালী হচ্ছেন ব্লগাররা।
এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক গণমাধ্যমভিত্তিক ব্লগাররা এ কাজটি প্রায় সমানভাবে করে আসছেন। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় সর্বশেষ তথ্য প্রদানে ব্লগাররা কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন।
ব্লগারদের জোটবদ্ধ মতামত ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত পর্যন্ত পরিবর্তনে। মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে ব্লগারদের তথ্য দেওয়ার কর্মকাণ্ডকে এখন আর অসম বলা যায় না। তাই সাংবাদিক না ব্লগার, কে বেশি প্রভাবশালী, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি কে বেশি জনপ্রিয়—এসব প্রশ্ন জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র।
একই সঙ্গে এ প্রশ্নও আসছে, তবে কি ব্লগারও সাংবাদিক? সময় কি এসেছে ‘সাংবাদিকতা’ শব্দটির আরও বৃহত্তর অর্থ খোঁজার?
২.
শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে জীবনের হাসি-কান্না—সবকিছুই একটি ব্লগে থাকে। সাংবাদিকতা এর বাইরের কোনো বিষয় নয়। আর ব্লগ তো ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক গণমাধ্যম। প্রশ্নটা হচ্ছে, সামাজিক গণমাধ্যম আর মূলধারার গণমাধ্যম নিয়ে। শত বছর ধরে যা মূল ধারা ছিল, সেটিই মূল ধারা থাকবে, সে নিশ্চয়তা দিচ্ছে কে? তবে ব্লগের এখনকার প্রতিযোগিতাটা মূল ধারার সঙ্গে।
এর পরও ‘ব্লগের সাংবাদিকতা’কে ঠিক সাংবাদিকতা বলে মানতে চান না অভিজ্ঞজনেরা। রক্ষণশীল অনেক সংবাদপত্র ব্লগকে সম্ভাব্য বিপদ হিসেবে দেখে। তাদের মতে, ব্লগে যাচাই না করে ভুল তথ্য দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। অসত্ রাজনীতিকেরা ব্লগ ব্যবহার করে জনগণের মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।
পুলিত্জার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিক ডেভিড এস ব্রডার মনে করেন, ব্লগিং একেবারেই সাংবাদিকতা নয়। কারণ আপনি সারা দিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে পারবেন না। বাইরে গিয়ে সোর্সের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিষয়গুলো নিজের মতো করে অনুসন্ধান করতে হবে। তার পর যা জানলেন, বুঝলেন, তা লিখবেন, প্রতিবেদকেরা সাধারণত যেভাবে কাজ করেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা ব্রডার এই কথার ভেতর দিয়ে বলতে চাইছেন, ব্লগাররা সাধারণত মতামতধর্মী লেখা লেখেন। আর মতামত সাংবাদিকতা হতে পারে না।
এস ব্রডার যা বলেছেন, সেটাই কি সবকিছু? প্রখ্যাত ব্লগার অ্যালেক্স উইলহেম এ কথার জবাব দিয়েছেন প্রভাবশালী ব্লগ টিএনডব্লিউর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে। তিনি বলছেন, এটা সত্য যে মানুষ নির্জলা তথ্য জানতে চায়। একই সঙ্গে তারা এটাও জানতে চায়, নির্জলা তথ্যের অর্থসহ বিশ্লেষণ। এখানেই ব্লগিংয়ের উত্পত্তি। কারণ ব্লগাররা পাঠকের সামনে কোনো একটি বিষয়ের তথ্যসহ পরিপ্রেক্ষিতও হাজির করেন।
উইলহেম বলছেন, ক্ষেত্রবিশেষে ব্লগাররা রিপোর্টারদের আগেই সর্বশেষ তথ্যটি দিতে পারেন। কেবল তা-ই নয়, তাঁদের লেখা কপি এডিটররা ঠিক করে দেন। ব্লগারদের লেখার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তিনি ব্লগিংকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার পক্ষে মত দেন। তাঁর ভাষায় ব্লগিং=সাংবাদিকতা+ মতামত।
৩.
ব্লগার না সাংবাদিক, কে বেশি শক্তিশালী—সেই তর্কে না গিয়ে গণমাধ্যম পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, সাংবাদিক হওয়ার জন্য ব্লগিং হলো প্রথম ধাপ। ব্লগে লিখে হাত পাকিয়ে তবেই না সাংবাদিক হওয়া। ধরা যাক, আপনি কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রাপ্ত সাংবাদিক। আপনার পদবিসহ পরিচয়পত্র আছে। এই নিয়োগ বা পদবি কিন্তু আপনাকে ভালো রিপোর্টার বা সুলেখক বানাতে পারবে না।
আজকের তথ্যপ্রধান যুগে যারা সাংবাদিক বা লেখক হতে চান, আগে তাঁদের নিজস্ব ব্লগ খোলা দরকার। সেখানে তাঁরা নিজের ধারণাগুলো লিখবেন। এরপর সেই লেখা যদি পাঠকের নজর কাড়ে, লাখো ‘হিট’ পায়, হাজারো ‘ফলোআর’ তৈরি হয়, তবেই সাংবাদিক হওয়ার কথা তাঁরা মাথায় নিতে পারেন। এই মতের অনুসারীরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে প্রমাণ করতে হবে সাংবাদিক হিসেবে আপনি কতটা যোগ্য, সেই দিন শেষ হয়ে গেছে।
৪.
এবিসি নাইটলাইনের জন বার্মান মনে করেন, ব্লগেও ভালো মানের রিপোর্টিং হতে পারে। কিন্তু সব ব্লগেই ভালো রিপোর্টিং হওয়ার দরকার নেই।
অনেক প্রখ্যাত সাংবাদিক আছেন, যাঁরা নামী ব্লগার হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক তুখোড় রিপোর্টার আছেন, যিনি ব্রেকিং নিউজটি ব্লগে ব্রেক করে থাকেন। এঁদের একজন এবিসি টেলিভিশনের হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা জেইক ট্যাপার। তিনি প্রায়ই ব্লগে নিউজ ব্রেক করেন, পরে সেটা এবিসিতে সম্প্রচার হয়। কেবল তা-ই নয়, তিনি হামেশা এমন এমন খবর ব্লগে ব্রেক করেন, যা একান্তই ব্লগ এক্সক্লুসিভ, কখনোই টেলিভিশনে দেখানো হয় না।
প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে জন বার্মান বলছেন, ‘এ অবস্থায় হোয়াইট হাউসে কী ঘটছে, তা জানতে আপনি যদি ট্যাপারের ব্লগ না পড়েন, তবে আপনি আস্ত আহাম্মক। একইভাবে আপনি গাড়লই থেকে যাবেন, যদি তাঁর টেলিভিশন রিপোর্টিং না দেখেন।’
তাই ভালো মানের প্রতিবেদন হতে পারে যেকোনো জায়গায়, একখণ্ড খবরের কাগজে, কম্পিউটারের পর্দায় বা টেলিভিশন চ্যানেলে। সঠিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয় একটি প্রতিবেদন। কিছু কিছু ব্লগ সে চেষ্টা করে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ নামী ব্লগও তা পেরে ওঠে না। বার্মান বলছেন, তাই ব্লগের সাংবাদিকতাকে ঠিক সাংবাদিকতা বলা যায় না।
৫.
আমাদের দেশেও এ বিতর্কটি বেশ জোরেশোরেই আছে। ব্লগারদের দাবি, এখনকার সাংবাদিকতায় যে বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণার সমাহার, এতে তাঁদের অবদান আছে।
ব্লগারদের দাবি, গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে প্রথম সমস্বরে প্রতিবাদ তাঁরাই করেছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। ছাত্রী নির্যাতনকাণ্ডে অভিযুক্ত পরিমল জয়ধরকে গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড প্রদানে তাঁদের লেখালেখির ভূমিকা আছে। অথচ মূল ধারার গণমাধ্যম তখন চুপ ছিল। ইন্টারনেটের গতি কমানোর সরকারি পদক্ষেপকে থামিয়েছেন তাঁরাই।
সম্প্রতি লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা অনুষ্ঠানে ইসলামি ব্যাংকের টাকা গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রথমে তাঁরাই সোচ্চার হয়েছেন। ব্লগারদের দাবির বিষয়ে অবশ্য সাংবাদিকদের মধ্যে জোরালো দ্বিমত আছে।
সন্দেহ নেই, ব্লগ নাগরিকের অধিকারবোধ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে। তার পরও ব্লগিং বনাম সাংবাদিকতা, বিতর্কটিকে চলতে দেওয়া ভালো। কে প্রথম স্থান পেল, এখনই তা নির্ধারণ করতে গেলে জুরিবোর্ডের শাস্তির দাবিতে লেখালেখি শুরু হয়ে যেতে পারে!
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
ইমেইল: [email protected]
আমার এ লেখাটি ২৭ জুন প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×