গিলোটিনের যিনি উদ্ভাবক তাকেই নাকি শেষ পর্যন্ত গিলোটিনে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
ফার্মগেটে ওভারব্রিজ পার হয়ে রিকশা ঠিক করছি (মেরামত না, দরাদরি), এমন সময় পাশেই এক রিকশা ড্রাইভার বিরক্তিভরা গলায় অনেকটা চেঁচিয়েই বলে ওঠেন, আরে লাভ রোড! এইটা আবার কী? বাপের জ েন্ম হুনি নাই!
তার সঙ্গে আলাপরত প্যাসেঞ্জার পুরোপুরি ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে যায়। মুখমণ্ডলে একটা চূড়ান্ত হতাশার প্রলেপ লক্ষ্য করি তার । বোঝা যাচ্ছে তিনি লাভ রোড খুঁজতে খুঁজতে হয়রান পেরেশান হয়ে পড়ে আজকের ক্ষতির খাতার হিসাব করছেন মনে মনে। এসময়ে আমার মনে পড়ে, চট্টগ্রাম শহরে একটা জায়গার নাম লাভ-লেইন। তবে চিটাগাংয়ের ওই প্রেম গলি ঢাকায় এসে আবার কোনো কানাগলির চক্করে এফিডেভিট করে মহব্বতের সদর রাস্তা হয়ে গেল কিনা এই চিন্তা লাভ রোডকে নিয়ে ঢাকাসহ পুরো দেশের এবং বিদেশের অনেকেই নাকি করেছেন বলে শুনেছি। যাক, এসব আবার মন্দলোকদের বাতচিত, আমাদের শুনে কাজ না হওয়ারই কথা।
তবে আমার কর্মস্থল এই নয়া নামকরণকৃত (বা লাভকরনকৃত) সড়কের কাছাকাছি বলেই আমি এই দুর্লভ রাস্তাটাকে চিনি। তাই পরোপকারী মনোভাব নিয়ে ড্রাইভারের সাহায্যে এগিয়ে যাই, ওই যে তিব্বতের কাছে, পূবালী ব্যাংকের পাশের যে রাস্তটা, ওটাই লাভ রোড।
রিকশাওয়ালার তাও চিনতে কষ্ট হয়। এবার আমি বলি, আরে সমকালের পাশে আরেকটা নতুন পত্রিকা অফিস হয়েছে দেখেননি? কাঁচের বিল্ডিং! যায়যায়দিন...
যাই হোক কাঁচের বিল্ডিং বলায় কাঁচ ঘেরা যায় যায় দিন অফিস এবং তৎসংলগ্ন রাস্তটা চিনতে পেরে এবার বোকা বোকা একটা হাসি দেয় ড্রাইভার। আমি, ওই যাত্রী এবং যারা এতোক্ষণ আমাদের শুনছিলেন তারা সবাই যেন একসঙ্গে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
যায়যায়দিনের কথা মনে আসতেই এর স¤ক্সাদক শফিক রেহমান এবং অবধারিতভােবই ভালোবাসা দিবস অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র কথা মনে পড়ে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা তামাক আর ফিল্টার কিংবা অবৈধ মেলামেশার সঙ্গে এইডসের সম্পর্কের মতো। এদেশে বিদেশের অনেক স্থান থেকে অনেকেই নিত্য-নতুন (ধর্ম থেকে রোগ-শোক পর্যন্ত) জিনিস এনে চালু করেছেন এবং সেগুলো অধিকাংশ েক্ষত্রই মার-মার কাট-কাট জনপ্রিয় হয়েছে। (শুনেছি, দেশের কৃষিক্ষেেত্রর অন্যতম এক জঞ্জাল কচুরিপানাও নাকি কোন মহামতি সুদূর ব্রাজিল থেকে এই আজন্ম দুঃখপীড়িত দেশে এনেছিলেন। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য খাতের আরেক গর্ভ-যন্ত্রণা আফ্রিকান মাগুরের কথাও মনে করা যায়। এর বাইরে বার্মা থাইল্যান্ডের ইয়াবা আর ভারতীয় ফেন্সিডিলের কথা না হয় নাই বললাম।
তবে কচুরিপানা আর আফ্রিকান মাগুর কিংবা হেরোইন-ইয়াবা-ফেন্সিডিল সবগুলোই নেগেটিভ বিষয় ছিল আমাদের জন্য। এই হিসেবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে সে রকম কিছু যে না এটা অন্তত পক্ষ-বিপক্ষ সবাই স্বীকার যাবেন।) যাহোক, এর মধ্যে যায় যায় দিনের ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তা অর্থাৎ জনপ্রিয়তা (দৈনিক নয়, সাপ্তাহিক), অনেকটাই বলা যায় ইতিহাস। তবে শফিক সাহেব তার দু'একটি ব্যর্থতা (যেমন দৈনিক যায় যায় দিন, বিটিভি'র ঈদ আনন্দ মেলা) বাদে যতগুলো সাফল্য অর্জন করেছেন তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে এদেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবসের প্রচলন ঘটানো (এমনকি তার চার চারটে টিকেটে/মতান্ত ের ৫িট) বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টকাণ্ডের পরও)। জ্বী, এই কৃতিত্বের একমাত্র, ওয়ান এন্ড অনলি দাবিদার স্রেফ শফিক ব্রাদার।
আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে ১৪ ফেব্রুয়ারি যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিবস তা শফিক রেহমানের আগে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আর কেউ দেখিয়ে দেয়নি এই হাবাগোবা আর মরমর পান্তাখেকো জাতিকে। এর আগে এদেশের প্রেম-পাগল কপোত-কপোতিরা হালহীন-পালহীন তরীর মত দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রোমান্স সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছিল। অনেকটা জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক রিলিজ হওয়ার পর যেমন অনেক ভেঙ্গে যাওয়া বা ভাঙ্গি ভাঙ্গি করছে অবস্থার নড়বড়ে প্রেম আবার জোড়া লেগেছিল, তেমনি এদেশে শফিক রেহমান সাহেবের প্রচলিত ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র কল্যাণে অনেক বিচ্ছেদায়িত প্রেমও জোড়া লেগেছে।
তবে এর বিপরীতে অনেক সুপার গ্লুতে (মতান্তরে ফেভিকলে) আটকানো প্রেমও ভ্যালেন্টাইনের গন্ধম 'মইন-মিলা' টাইপ ধাক্কায় তচনচ হয়েছে বলে শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে অনেকের অভিযোগ, বাংলাদেশে যেমন তথাকথিত নিষ্ঠাবান এবং অতি অবশ্যই ধনবান মুসলমানরা সারা বছর আশপাশের অভুক্ত অভাবী মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে রমজান মাসে জাকাত-ফেতরা হিসেবে দানের জন্য টাকা-পয়সা নিয়ে বসে থাকেন, তেমনি এদেশের আজকালকার আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকারা নাকি ওই ১৪ ফেব্রুয়ারির 'ডি-ডে'র জন্য সারা বছরের ইশক-ভালোবাসা তাদের স্বার্থের মৌচাকে সঞ্চিত করে রাখেন। ওদিকে বছরের বাদবাকি ৩৬৪ বা ৩৬৫টা দিন একটু ভালোবাসার অক্সিজেনের জন্য চাই তার 'জান' বা 'জানু' লাল-নীল-বেগুণী হয়ে মারা যায়, যাক। কুচ্ পরোয়া নেই! স্বার্থের সেই জন্মান্ধ মৌচাকে হাজার ঢিল মারেন, কিন্তু লাভের ল-টাও হওয়ার নয়।
যাহোক, ভুলে যাওয়ার আগে আজকের এই (েয েকান ১৪ েফব্রুয়াির) মহতি দিনে বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে'র শিকার ওইসব 'বলির পাঁঠা' প্রেমিক-প্রেমিকাদের ( জানি না এদের মাঝে শফিক সাহেবের সেই এক কোটি তরুণ ভোটার আছেন কীনা) প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি রইলো আমার। সেই সঙ্গে জনাব শফিক রেহমান সাহেবকে এদেশে এমন চমৎকার একটি দিবসের প্রচলন ঘটানোর জন্য মস্ত (আই মি বিগ বিগ) সব শুভেচ্ছা রইলো। আজকের দিনে বাংলাদেশের প্রেমিক-প্রেমিকারা যখন প্রিয় আর প্রিয়া সান্নিধ্যে তৃপ্টির ঢেঁকুর তুলছেন, তখন দয়া করে মাঝখানে শফিক ভাইয়ের কথাটা একবার হলেও সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
শেষ কথা: একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপল্েক্ষ্য প্রচারিতব্য েস্পশাল অনুষ্ঠানের ট্রেলর চলছিল টিভিতে। তাতে একপলকের জন্য অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে দেখা গেল শফিক রেহমান বলছেন, তার ভালোবাসার কথা। এসময় নতুন আসা আধুনিক স্বভাবের কাজের বুয়াটা ঘরে থাকা মেহমানদের জন্য চা দিতে এসেছিলেন। ট্রেলরটা দেখেই বিরক্তিভরে তিনি বলে উঠলেন, এই বুইড়্যা লোকডারে আবার এই জায়গায় আনলো কেডা?
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল- গিলোটিনের যিনি উদ্ভাবক তাকেই নাকি শেষপর্যন্ত গিলোটিনে...
সত্য মিথ্যা জানি না। গল্প তো গল্পই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




