somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপারেশন মিডনাইটঃ যেভাবে মুক্ত করা হয় শাপলা চত্ত্বর

০৫ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সোমবার।
রাত সোয়া ২ টা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শেখ মারুফ হাসান হ্যান্ডমাইকযোগে ঘোষণা দেন- হেফাজত ভাইয়েরা আপনারা সসম্মানে এখান থেকে চলে যান। আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না। জোর করে আমরা আপনাদের উঠাতে চাচ্ছি না। চারদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আপনাদের ঘিরে রেখেছেন। আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের কেউ গুলি করবে না। আর যদি যেতে না চান তাহলে জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন চালানো হবে।

এই ঘোষণার আসার পর হেফাজত ইসলামের মঞ্চ থেকে মাইকে পাল্টা ঘোষণা দেন নেতাকর্মীরা। আল্লাহ ও রাসুলের (সঃ) জন্য আমরা শহীদ হতে প্রস্তুত আছি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে শাপলা চত্বর অবস্থান করছি। এখান থেকে যাব না। পাল্টাপাল্টি ঘোষণা আসার পর দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। পুলিশ তাদের শক্তি বাড়াতে এলিট ফোর্স র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বিজিবিকে তলব করে। অল্প সময়ের মধ্যেই র‌্যাবের প্রায় সহস্রাধিক সদস্য মতিঝিল থানার সামনে চলে আসে। দৈনিক বাংলার সামনে প্রায় ৩২ প্লাটুন বিজিবি সদস্য অবস্থান নেয়। টানটান উত্তেজনা পুরো মতিঝিলে। ‍পুরো এলাকা তখন অন্ধকারাছন্ন। পুলিশ ও র্যাবের গাড়িতে লাল রঙের আলো জ্বলছে। পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা বাঁশি বাজাচ্ছেন। যুব ভবনের সামনে একটি ও থানার সামনে আরেকটি আর্মড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) প্রস্তুত করা হয়।


তার পাশাপাশি থানার নিরাপত্তা দিতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়। থানার ছাদের দুই পাশে শক্তিশালী দুটি স্টেনগান বসানো হয় । এবং ছাদে চারজন পুলিশ সদস্যকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। থানার দুই পাশে প্রায় ৩০ জন দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সবার হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ও অতিরিক্ত রাবার বুলেট।
বিপরীত দিকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা জিকির-আজগার করতে থাকেন। আর ব্লগার ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। মাইকে বলতে থাকেন, পুলিশ ভাইয়েরা আপনেরা আমাদের ভাই। আমরা মুসলমান। আপনারাও মুসলমান। আমাদের এখানে কোনো দুর্বৃত্ত অবস্থান করছে না। হেফাজতের কোন নেতা কর্মী ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত না। আমাদের উপর হামলা চালালে আমরাও পাল্টা জবাব দিব।
রাত ২ টা ২০ মিনিট।
প্রথমবারের মতো অপারেশন চালানোর চেষ্টা করলে হেফাজতের নেতাকর্মীরা আগুন জ্বালিয়ে ‘আল্লাহু আকবার-হে আল্লাহ তুমি আমাদের রক্ষা করো’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অপারেশন না চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরে স্তব্ধতা চলে আসে এলাকায়। সংবাদকর্মীরাও প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ সময় মনে হয়েছিল কোন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।

রাত ঠিক ২ টা ৩১ মিনিট।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে উঠেন ‘ফায়ার’। পরে শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি টিয়ার শেল ও হ্যান্ড গ্রেনেডের আওয়াজ। অপর দিক থেকে মাইকে বলা হচ্ছে - জীবন বাঁচাতে প্রতিরোধ করুন। হেফাজতের নেতাকর্মীরা পুলিশ ও র‌্যাবকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। তবে পুলিশ টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে বিপরীত দিকের বাতাসের কারণে পুলিশ ও র্যাবই কাবু হয়ে যায়। পরে তারা পিছু হটে। পুলিশ ও র্যাব আরও শক্তি বাড়িয়ে আবারও অপারেশন চালায়। এখানে নেতৃত্ব দেন যুগ্ম কমিশনার,র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসান, র্যাব ৪- এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান, ডিবির এডিসি মশিউর রহমান প্রমুখ ।

হেফাজতের কিছু কর্মী থানার উত্তর দিকে জড়ো হয়ে পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় মতিঝিল জোনের এডিসি মেহেদি হাসান নেতৃত্ব দেন। পুলিশ হ্যান্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে নেতাকর্মীদের অনেকটা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একই সময় শাপলা চত্বরের পূর্ব পাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে কমান্ডো স্টাইলে পুলিশ হেফাজতের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেন। তাছাড়া নটরডেম কলেজ ও ইত্তেফাকের মোড় থেকে পুলিশ-র‌্যাবের একাধিক টিম হেফাজতকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। নেতাকর্মীরাও সর্বশক্তি দিয়ে পুলিশ-র‌্যাবকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু চারদিক থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা নির্বিচারে গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসসহ অপারেশন চালালে হেফাজতের নেতাকর্মীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। হেফাজতের সমাবেশ থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

পুলিশ গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালে এলাকাটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। এক পর্যায়ে হেফাজতের হাজার হাজার নেতাকর্মী আত্মরক্ষার জন্য মঞ্চ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। দৌঁড় ও ছোটাছুটি শুরু হয়। বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ প্রায় ১০০ গজ দূর থেকে আস্তে আস্তে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তবে তাদের গুলি করতে দেখা যায়নি। মাত্র আধ ঘন্টার ব্যবধানে পুলিশ ও র্যাব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় হেফাজতের মঞ্চ।

পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের আঘাতে নেতাকর্মীরা রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। আবার অনেক পুলিশ সদস্যকে দেখা গেছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকা নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করছে।

রাত ৩ টা ১০ মিনিট,
দিলকুশা এলাকায় হেফাজতের কিছু নেতাকর্মী স্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ সেখানে অ্যকশনে যায়। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হলে র্যাব ও পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করে। শাপলা চত্বরের দক্ষিণ পাশে অলি গলির ভবনের ছাদ ও বাথরুম এবং সোনালী ব্যাংকের ভেতর ও ছাদে আশ্রয় নেওয়া হেফাজতকর্মীদের বের করে এনে নিরাপদে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে র্যাব-পুলিশ। তাদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধকে রক্তাক্ত অবস্থায় আনা হয়। উদ্ধার হওয়া কর্মীদের প্রথমে আটক করলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের লাইন করে সেনা কল্যাণ ভবনের সামনে দিয়ে পার করে দেয়া হয়। ত্রিমুখী অভিযানের মুখে হেফাজতের নেতাকর্মীরা মতিঝিল, ইত্তেফাক, টিকাটুলি, যাত্রাবাড়ীর দিকে চলে যাওয়ার সময় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মসজিদে ফজরের আজান হওয়ার সময়ও গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। সকাল ছয়টার দিকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত হয়। যবনিকা ঘটে শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশন মিডনাইটের।

তথ্য ও ছবিসূত্রঃ
১-যুগান্তর।
২-প্রথম আলো।
৩- বিডিনিউজ২৪।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১০
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×