somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আশালতা বৈদ্যঃ মহান মুক্তিযুদ্ধের এক দুর্ধর্ষ নারী কামান্ডার..

১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে জানা গেলো গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা তাদের নিজের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বন্দি হয়ে আছেন।


কয়েকদিন পরই তাদের উদ্ধারে অভিযান চালালো এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল। সেখানে থেকে তাদের উদ্ধার করে গেরিলা কামান্ডার তাকে নিয়ে গেলেন শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এবং নিজ উদ্যোগেই সেখানে তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন।
সেই দুর্ধর্ষ গেরিলা দলেরই কামান্ডার ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র নারী কামান্ডার আশালতা বৈদ্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশের টানে যুদ্ধে চলে যান আশালতা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। এ ছাড়া ৩৫০ জন নারীকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। অথচ স্বাধীনতার মাত্র ৫২ বছরেই আমরা ভুলে গেছি তাকে, ভুলে গেছি তার অবদানের কথা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকাররা তাদের বাড়িতে এসে বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে কয়েক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে আশালতা ও তার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। এই অবস্থায় হরিপদ বাবু মেয়েদের রক্ষায় সপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করেন। এই ঘটনার আদ্যপ্রান্ত কানে যায় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের। তিনি আশালতাকে দেশত্যাগ না করে দেশ রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেন।


আশালতা বৈদ্য সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। শুধু তাই নয়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার নিজ এলাকার সাহসী ৪৫ মেয়েকেও আশালতা উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের নিয়ে গঠন করেন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা দল।
আশালতা বৈদ্য ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল জীবনেই দেশের জন্য কিছু করার তাগিদে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেন।
মে মাসে এ দল পুরোপুরি সংগঠিত হলে তিনি তাদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হেমায়েত বাহিনীর তত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের হেরেকান্দি হাইস্কুলে ও লেবুর বাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। প্রশিক্ষণ হয় রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড চার্জসহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার। স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণে আশালতা বৈদ্য অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধকৌশলের উপর আশ্চর্যজনক পারদর্শিতা লাভ করেন। যে কারণে আরো ৩০০ জন মেয়েসহ মোট ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয় তাকে।
বিশাল এই নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব পেয়ে আশালতা বৈদ্য দায়িত্ব পালনে দুঃসাহসিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন। এবার যুদ্ধে গেরিলা অপারেশন শুরু হওয়ার পালা। ১৯৭১ এর ২৪ জুন কোটালীপাড়া, হরিণাহাটি, ঘাঘর বাজার, শিকের বাজার ও রামশীলে খান সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এই বীর নারী।
এই যুদ্ধে আশালতা বৈদ্যের দুঃসাহসিকতা, সুনিপুণতা, দক্ষতা রূপকথাকেও হার মানায়। সে দিন তার বাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং বন্দি হয় ২৫ পাকিস্তানি সেনা। বন্দি পাকিস্তানী সেনাদের ধরে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে তাদের বিচার করা হয়। বিচারকদের একজন ছিলেন আশলতা বৈদ্য স্বয়ং। বিচারে তাদের সবাইকে হত্যার রায় হয়। আশালতার নির্দেশে সে রায় কার্যকর করা হয়। সকল বন্দী পাকসেনাকে হত্যা করা হয়।
রামশীল নদী পাড়ে একদিন রাজাকাররা লঞ্চে করে কয়েক হাজার পাকিস্তানি সেনাকে সাথে নিয়ে আসে। সেখানে পাকসেনাদের সঙ্গে আশালতা বৈদ্য এবং তার সহযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ সময়ের মধ্যে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকার নিহত হয় মাত্র কয়েক’শ মুক্তিযোদ্ধার হাতে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর ৯টি মাসের ১টি দিনও তার যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের পরিকল্পনা ছাড়া কাটেনি। এই ৯ মাস দেশের জন্য যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় ক্ষণিকের জন্যও আসে নি।
মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে ৩৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব দিয়ে ৮ এবং ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে গোপালগঞ্জে ছোটোখাটো অনেক গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও ২২টি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেন। অনেক পাকিস্তানি সেনাকে নিজ হাতে হত্যাও করেন।
তিনি শুধু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন নিজে। সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সহযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলে তাদের সঙ্গে নিয়ে আবার যুদ্ধে গেছেন। এই অপ্রতিরোধ্য নারী যোদ্ধা যুদ্ধকেই যেন ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে ফেলেছিলেন।


দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আবার পড়াশুনা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। গত শতকের ৮০’র দশকে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘সূর্যমুখী সংস্থা’। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বার বার।
আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এছাড়া তিনি শ্রেষ্ঠ নারী সমবায়ের প্রেসিডেন্ট স্বর্নপদক, রোকেয়া পদক, প্রশিকা মুক্তিযোদ্ধা পদকসহ অনেক পুরষ্কার লাভ করেছেন।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এত অবদানের পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো রাষ্ট্রীয় উপাধি পেতে লেগে গেলো ৫১ বছর। এজন্যই প্রজন্মও মনে রাখে নি বাংলা মায়ের এই বীরকন্যা আশালতা বৈদ্যকে

তথ্যসূত্র ও ছবিঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৯:৫২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×