somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জামায়াতের জঙ্গিবাদের দলিল এবং শাহরিয়ার কবিরের প্রামাণ্যচিত্র - জোট সরকারের আমলনামা- ৭

১৬ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ওয়াজিবুল কতল’- এর ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় মানুষ হত্যার রাজনীতি। এই রাজনীতি চলছে এখনো। চলবে হয়তো সামনের দিনগুলোতেও। অন্তত সরকার বা প্রশাসনের আচরণে সে রকমই মনে হয়। এখন পর্যন্ত জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে কোনো সরকারেরই কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। গণমাধ্যমে অনেকদিন প্রচার-প্রকাশের পর সরকার কিছু গ্রেপ্তারের নমুনা দেখায়। এরপর আর কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। চলে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, চলে জঙ্গিদের উন্মত্ততা।
ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়া প্রচার করে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। প্রকাশ্যে তারা ওয়াজ বা বক্তৃতায় এসব ফতোয়া দেয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের ওয়াজগুলোতে রাষ্ট্রবিরোধী অনেক বক্তব্যও পাওয়া যায়। এসব সরকারের খুব একটা নজরে আসে না। ওয়াজ বলেই হয়তো সরকার এটাকে আমলে নেয় না। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওয়াজের মাধ্যমেই গড়ে উঠছে বিশাল নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী তার বাকপটুতা দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে টেনে আনছে ধর্মীয় রাজনীতির কাতারে। এই ধর্মীয় রাজনীতির দোহাই দিয়েই তৈরি হচ্ছে জঙ্গি, রক্তাক্ত হচ্ছে দেশের জনপদ, লেখা হচ্ছে খুন ও লোমহর্ষকতার ইতিহাস। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে অসংখ্যবার সংবাদ হয়েছে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে। আদতে কোনো কার্যকর ফল হয়নি। কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি ও কিছুদিন পর পর কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেই বিষয়টিতে যেন তুষ্ট থাকছে সরকার।
নির্বাচনের আগে জঙ্গি নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। জঙ্গি নিধনে কার্যকারিতা দেখা যায়নি, দেখা যায়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। আলোচনা হয়েছে বিস্তর। শীর্ষ জঙ্গি মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই তথ্য ধরে অগ্রগতি হবার কথা ছিল অনেক, হয়নি কিছুই।
জঙ্গিবাদ সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে গত জোট সরকারের সময়ে। জামায়াত জঙ্গিবাদকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে দাবি করলেও পরে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতেরই সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। জামায়াত জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, বিএনপি-জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এভাবেই এগিয়ে চলছে জঙ্গিবাদ। মুফতি হান্নানের জবানবন্দি থেকে জানা যায় বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির এক কালো অধ্যায়ের কথা। ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা নিয়ে হাওয়া ভবনে মিটিংয়ের কথা, জড়িতদের কথা। এসব অস্বীকার করছে বিএনপি। বিভিন্ন প্রমাণাদি এখন বেরিয়ে আসছে, বিএনপির তাই অস্বীকারের উপায় নেই। শুধু জোটের রাজনীতি ধরে রাখার জন্যই বিএনপি জড়িয়ে যাচ্ছে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে, জড়িয়ে যাচ্ছে জামায়াতের ফাঁদে। গত নির্বাচনে বিএনপি এর সমুচিত জবাব পেয়েছে ভোটারদের কাছ থেকে। তাতে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি বিএনপির রাজনীতিতে। বরং বিএনপিতে প্রতিক্রিয়াশীলদের আধিপত্য বাড়ছে, বাড়ছে জামায়াতনির্ভরতা। এভাবে চলতে থাকলে বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনি ভেবে দেখা দরকার। জামায়াতী গ্রাস মুক্ত হতে না পারলে বিএনপির অস্তিত্ব নিয়েই সামনে হুমকি আসার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে জড়িত জামায়াতে ইসলামী। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর। মূলত জামায়াতী জঙ্গিবাদের বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল নিয়েই নির্মিত হয়েছে ‘জিহাদের প্রতিকৃতি শাহরিয়ার কবিরের এই প্রামাণ্যচিত্রটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৬০ মিনিট। মাত্র ৬০ মিনিটেই তথ্য-প্রমাণসহ জঙ্গিবাদের বিস্তৃত বিবরণ আছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। তথ্য-প্রমাণের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎকার। আছে সমাজ ও ধর্ম গবেষকদের বিশ্লেষণ। আছে জঙ্গিবাদের নমুনা... জঙ্গিদের বর্বরতা... আক্রান্তদের আহাজারি... স্বজনদের কান্না...
প্রামাণ্যচিত্রটি ইতোমধ্যেই কয়েকটি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শিত হয়েছে। দেশেও দু’দফা প্রদর্শিত হয়েছে। আগামী মাসে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হবে, তারপর ডিভিডি হয়ে আসবে বাজারে। সাপ্তাহিক তার পাঠকদের জন্য পুরো প্রামাণ্যচিত্রটির ধারা বিবরণী তৈরি করেছে। এতে কোনো ধরনের পরিবর্তন না এনে একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। গ্রন্থনা করেছেন
মহিউদ্দিন নিলয় ও আব্দুল্লাহ্ নূহ

বাংলাদেশ। ২১ আগস্ট ২০০৪. দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভা শেষ হওয়ার মুহূর্তে আরম্ভ হলো সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড-বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণ। মুহূর্তের ভেতর টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া আর আহতদের আর্তচিৎকারে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আকাশ আচ্ছন্ন হলো। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ আহত হলেন ৩ শতাধিক।

শেখ হাসিনা
২১ আগস্ট আমাদের যে র‌্যালি ছিল তা ছিল শান্তির জন্য এবং গ্রেনেড হামলার বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, আমরা যেখানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে র‌্যালি করলাম সেই র‌্যালিটাকে আক্রমণ করা হলো গ্রেনেড দিয়ে। প্রায় ১ ডজন মতো গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। আমরা এটা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি সেদিন একটু দেরিতে পৌঁছেছি। সকলের বক্তব্য প্রায় শেষ। তাদের একজন থাকতেই আমি রওনা হলাম, গিয়ে পৌঁছলাম এবং পৌঁছেই আমি বক্তব্য রাখতে শুরু করলাম। কিছু বোঝা বা বলার আগেই হঠাৎ আওয়াজ, গ্রেনেডের। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সবাই তাড়াতাড়ি বসিয়ে দিল নিচে। আমার সামনে একটা টেবিলও ছিল। বসে পড়লাম। একটার পর একটা গ্রেনেড হামলা হয়েই যাচ্ছিল।

তখন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকার। এই গ্রেনেড-বোমা হামলার জন্য যথারীতি আওয়ামী লীগ ও ভারতকে দায়ী করলেও জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের দাবি এই হামলা তারাই করেছে।

টিভি প্রতিবেদন
গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে প্রথম জবানবন্দি দেন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান।

হরকাতুল জিহাদের গ্রেপ্তারকৃত নেতা মুফতি হান্নান বলেছেন কীভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শীর্ষ নেতা, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু হরকাতুল জিহাদ ও ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে বসে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।

মুফতি হান্নান : প্রথম মিটিং হয় ১৪ তারিখে, মিটিং ছিল হাওয়া ভবনে। সে হাওয়া ভবনে বিভিন্ন আলোচনা হয়। ওই হাওয়া ভবনের মিটিংয়ে শরিক ছিল তারেক জিয়া, আলী আহসান মুজাহিদ সাহেব, হারিছ চৌধুরী, আব্দুস সালাম পিন্টু সাহেব এবং হরকাতুল জিহাদের আমির, মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেব, শেখ ফরিদ সাহেব এবং আল মারকাজুল ইসলামের নায়েবে আমির মুফতি আব্দুর রশিদ সাহেব। সেখানে তারেক জিয়া সাহেব আলোচনা করেন যে, বর্তমান অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা এদেশে অরাজকতা সৃষ্টি করছে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এরপর আলী আহসান মুজাহিদ সাহেব বললেন যে, আপনার কথা সত্য। শুধু তাই নয়, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সাহেব বললেন যে, কথাগুলো সবই সত্য এবং পরিষ্কারভাবে আপনারা বলেন কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার?
তিনি বললেন যে, এখানে দুটা পদক্ষেপ। হয়ত এদেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের ব্যাপক রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা দরকার নচেৎ তাকে এদেশ থেকে চিরবিদায় করে দেয়া দরকার অর্থাৎ তাকে শেষ করে দেয়া দরকার।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর নূর, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি মেজর নূরও উপস্থিত ছিলেন। তাকে তিনি বললেন যে, আপনি কিছু বলেন। তখন মেজর নূর বললেন, আপনারা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবেন এটা আমি জানি। আমি তো রাজনীতি করি না কিন্তু আমি জানি তার মোকাবেলা করতে হলে তিনটা পদক্ষেপ নিতে হবে। একটা হলো, তার বাড়িতে আক্রমণ করতে হবে, অথবা তার আসা-যাওয়ার পথে তাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলতে হবে নচেৎ তার কোনো মিটিংয়ে আক্রমণ করে তাকে শেষ করতে হবে


টিভি প্রতিবেদন
মুফতি হান্নান জানিয়েছেন ২০ আগস্ট সকাল ১১টায় পিন্টু তার ভাই তাজউদ্দিন, হরকাতুল জিহাদ নেতা আবু তাহের জান্দাল ও কাজলের উপস্থিতিতে ১৫টি গ্রেনেড দেন শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য।


আপনাদের এই অপারেশন ব্যর্থ হলো এটা কখন জানতে পারলেন আপনারা?
মুফতি হান্নান : আমরা তখন অফিসে ছিলাম। অপারেশন হওয়ার পর ওরা মোবাইল করে জানায় যে, এ ধরনের অবস্থা হয়েছে এবং এ কারণেই হয়েছে। কোনো ডিসিপ্লিন ছিল না এবং স্টেজ কখন কোথায় হবে এ ব্যাপারে জানা ছিল না। হঠাৎ করে স্টেজ হয় এবং মানুষজনের খুব ভিড়ের কারণে এরা পশ্চিম দিকে এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থান করে এবং অন্যরা, জামায়াতে ইসলামীর যারা লোকজন ছিল তারা প্রায় ১৫ জন। তারা কে কোথায় অবস্থান নিয়েছে, কেউ কাউকে খুঁজে না পাওয়াতে। হঠাৎ করে ওরা বলল যে, দক্ষিণ দিক থেকে একটা গ্রেনেড আসে। আসার পরই মানুষ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরে যারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে তারা ওপরের দিকে নিক্ষেপ করেছে এবং ওপরেই গ্রেনেডগুলো ফেটেছে। ওরা বলেছে প্রায় ২০ থেকে ৩০টা গ্রেনেড ওপরে ফেটেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় ফেটেছে। ফলে মানুষ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ওই সময় ওরা গুলি করেছে। ওরা বলল যে, রাইফেলের গুলি আসছে কিন্তু শেখ হাসিনার কোনো সমস্যা হয়নি। এবং ওরা ফিরে আসছে। তখনই আমরা যাই।

শেখ হাসিনা
আমার ওপর অনেক বারই আক্রমণ হয়েছে। যে কারণে আমাদের সরকার থাকতে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে একটা আইন করেছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পরই সে আইনটা প্রত্যাহার করে নেয়। এবং প্রত্যাহার করে নেয়ার পর পরই কিন্তু এ আক্রমণটা হয়। এর সঙ্গে যে তদানীন্তন জোট সরকারের একটা মদদ ছিল তা কিন্তু পুলিশ বা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সবার আচার-আচরণ থেকে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাদের একটা যোগসাজশ নিশ্চয় ছিল।

বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে অভ্যুদয় ঘটেছে শতাধিক জঙ্গি-মৌলবাদী সংগঠনের। হরকাতুল জিহাদসহ এসব সংগঠনের লক্ষ্য সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত ও কোরআনের আইন কায়েম করা। (প্রথম পর্ব জিহাদের ডাক, জিহাদ কি ও কেন? বইয়ের প্রচ্ছদ) কারা এই হরকাতুল জিহাদ? বাংলাদেশে আমরা তাদের শেকড় অনুসন্ধান করেছি।

হাসান রফিক
হরকাতুল জিহাদের প্রাক্তন কর্মী
হরকাতুল জিহাদ যেদিন প্রতিষ্ঠিত হয় সেদিন ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল। জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে বলা হয়েছিল হরকাতুল জিহাদ এমন একটা প্ল্যাটফরম যেখানে বাংলাদেশের যত মুজাহিদ আছে, আফগান ফেরত যত সশস্ত্র যোদ্ধা আছে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা প্ল্যাটফরম। তাছাড়া সমগ্র বিশ্বে যারা জিহাদভিত্তিক কাজ করে যেমন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম, আল আলামী, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ইসলামী হরকাতুল জিহাদ, আল কায়েদা এবং আল উখওয়ানুল ইসলাম মিসর। সবার মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইসলামী শাসন করার ইচ্ছা ছিল হরকাতুল জিহাদের।
আমি ১৯৯১ সালে গিয়েছিলাম আফগানিস্তানে এবং ১৯৯২ সালে ফিরে আসি। প্রথমে পটিয়া মাদ্রাসায় ট্রেনিং করেছিলাম। বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ নিয়েছি, অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছি আরাকান পাহাড়েÑ প্রায় ৬ মাস। পাহাড়ে কীভাবে উঠব, কীভাবে নামব। শরীরের মধ্যে প্রায় ৬/৭টা ইট দিয়েছে। হাত উঁচু করে তাতে অস্ত্র ধরে পানির মধ্যে সাঁতার কেটেছি।

মুফতি হান্নান
৮৭ সালের শেষ দিকে আমি পাকিস্তান যাই। পাকিস্তানের করাচিতে জামিয়া ইউসুফ নিউ টাউন মাদ্রাসায় মুফতি অর্থাৎ ডিগ্রি পড়ার জন্য আমি যাই। ভর্তি হওয়ার পর আমি যখন তৃতীয় বছরে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে হামলা করে। আমাদের বাংলাদেশি মাওলানা আব্দুর রহমান শহীদ (রঃ) এবং আরো অনেক পাকিস্তানি ওলামায়ে একরাম, মুজাহিদরা নিউ টাউন মাদ্রাসায় আসে। ওখানে বক্তৃতা হয়, জিহাদী আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা আফগানিস্তানে যাই। আফগানিস্তানের খোস্ত শহরে ইয়াবাহ্ ট্রেনিং সেন্টারে প্রথম প্রশিক্ষণ নিই।

মুফতি ওবায়দুল্লাহ
কর্মী, লস্কর-ই তৈয়বা
হরকাতুল জিহাদুল ইসলামী আলামী পাকিস্তানÑ এটা হলো সংগঠনের নাম। ওই সংগঠনের মাধ্যমে নুরুল কবির আমাকে এখান থেকে বলে যে, আপনি লাহোরে চলে যান। লাহোরে হরকাতুল জিহাদের অফিস আছে মুজাহিদদের। একটা চিঠি আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই চিঠিটা আপনি দেখাবেন। এরপর আপনার আর চিন্তা করা লাগবে না। তারাই সব নিয়ে যাবে।
লাহোরে গেলাম। সেখানে যাবার পর ওরা আবার আমাকে তাদের লোক দিয়ে পেশোয়ারে পাঠিয়ে দিল। পেশোয়ারে মুজাহিদীনদের অফিস আছে। ওখানে যাবার পর ওরা আবার চেক করে। ভারতীয় মানুষ হলে আবার বেশি চেক করে, কারণ ভারতের সঙ্গে ওদের একটু শত্রুতা আছে। তারপর আমাকে যখন দেখল যে, ভালো তখন আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। গাড়িতে করে নিয়ে গেল খোস্ত শহরে। সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছি। প্রায় এক মাস। ওই এক মাসে আজ এক রকম অস্ত্র, কাল আরেক রকম অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

হাসান রফিক : বাংলাদেশ হরকাতুল জিহাদ জেলাভিত্তিক, থানাভিত্তিক যারা কমান্ডার ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ওরা একদিন আমাদের মাদ্রাসায় এলো ছাত্রদের হরকাতুল জিহাদের দাওয়াত দেয়ার জন্য। তারা যখন বলল যে, হরকাতুল জিহাদ এমন একটি প্ল্যাটফরমের নাম যাদের সঙ্গে থাকলে খুব সহজভাবে বেহেস্তে যাওয়া যায়। আমরা এখানে শুধু জিহাদের কাজ করব। আমরা দেশে ইসলাম কায়েম করব। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করব।

প্রতিবেশী বার্মা থেকে আরাকানের মুসলিম যুবকেরা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এসেছে জিহাদের প্রশিক্ষণের জন্য।

মোহাম্মদ শাকিল জিহাদি
প্রাক্তন কর্মী, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)
২০০০ সালে এসে সাডিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি, ওখানেই ট্রেনিং নিয়েছি। এক বছর পর হাটহাজারী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি। তিন বছর পর লিবিয়ায় যাই লেখাপড়া করার জন্য। ওখানে দু’বছর লেখাপড়া করার পর বাংলাদেশে চলে আসি।

হাসান রফিক
আমাদের ব্যাচে ছিল প্রায় ৩০০ জন। যেগুলো ছাত্র শিবিরের ছিল, হরকাতুল জিহাদে ছিল, রোহিঙ্গা অর্থাৎ আরএসও ছিল, আইটিএম বা ইতহাদাতুল মুসলিম ছিল। সে সময় তো ওখানে জোরেশোরে জামায়াতে ইসলাম এবং হরকাতুল জিহাদ, আরএসওÑ সবাই মিলে আরাকানে ইসলাম কায়েম করার জন্য জিহাদের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল।

মুফতি হান্নান
হরকাতুল জিহাদে থেকে আফগানিস্তানে জিহাদ করেছি এবং চেচনিয়ার ভেতরে অনেক সাথী ছিল এবং ফিলিস্তিনে গিয়েছি। আর কাশ্মীরে গিয়েছে আমাদের মাওলানা মঞ্জুর হাসান। উনি ওখানে শহীদ হয়েছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অনেকে কাশ্মীরে যাতায়াত করেছে।

বাংলাদেশের মোট কতজন আপনারা আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন?
মুফতি ওবায়দুল্লাহ (কর্মী লস্কর-ই তৈয়বা) : পাঁচ হাজারের ওপর গিয়েছে।
প্রশিক্ষণ কে দিয়েছে?
উত্তরদাতার ছায়া : ওখানে আরএসও, তারপর আইটিএমের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতারা, জামায়াতের নেতারা আমাদের প্রশিক্ষণ দিত।
মুফতি ওবায়দুল্লাহ : আমার অধীনে ৪-৫ হাজার জন প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে লাখের ওপরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম স্থান হলো চট্টগ্রাম এবং দ্বিতীয় স্থান সিলেট


হাসান রফিক
প্রথমে আমরা জিহাদের যে বাস্তব পাঠ নিই সেটা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, যিনি জামায়াতের একজন এমপি, তার ওয়াজ থেকে।

দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
‘ইসলাম হচ্ছে একটি বিপ্লবী মতবাদ। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আর এই জীবন ব্যবস্থাকে যারা দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেই রেভুলিউশনারি পার্টির নাম হচ্ছে ইসলাম।’

হাসান রফিক
দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী একেবারে আমাদের অন্তরের ভেতরে গেঁথে দেন। একটা হচ্ছে নিজে পাঠ করা আর আরেকটা হচ্ছে অন্যে বলার পর সেটা দিলের ভেতর ঢুকে যাওয়া। যেটা আমাদের দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ শুনে আমাদের হৃদয়ে রেখাপাত করত যে জিনিসটা। দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর মাহফিলে যাওয়াটা একটা বাধ্যতামূলক পাঠ।

দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
‘আমি আল্লাহ্র দিন কায়েম করতে চাই। এই আন্দোলনকে পরিচালিত করতে গিয়ে যদি সশস্ত্র হামলার মোকাবেলা করতে হয় তাহলে সশস্ত্রভাবেই মোকাবেলা করাটাই হচ্ছে জিহাদের চূড়ান্ত রূপ। ইমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে পৃথিবীর বুকে। সেজন্য সংগ্রাম করতে হবে। সে সংগ্রাম যত প্রকারেরই হোক সব জিহাদের অন্তর্ভুক্ত
।’

সাইফুল্লাহ
প্রাক্তন কর্মী, ইসলামী ছাত্রশিবির
আমরা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ শুনতে যেতাম। ওনার ওয়াজ আমাদের খুব ভালো লাগত।

উত্তরদাতার ছায়া : সাঈদী সাহেব জিহাদ সম্পর্কে যা বলতেন তা আমার ভালো লাগত।

সাইফুল্লাহ
প্রাক্তন কর্মী, ইসলামী ছাত্রশিবির
দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জামায়াতের অন্যান্য নেতা আমাদেরকে সব সময় বলতেন যে, তোমরা মাদ্রাসায় যাও, জিহাদে যাও। কিন্তু তার ছেলেমেয়েরা কখনো মাদ্রাসায়ও যায়নি, জিহাদেও যায়নি


দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
মোনাফেক তো সহজেই চেনা যায় না। কয় যে হুজুর এই যে বার বার জিহাদ, এই মারামারি, এই ঠেঙ্গাঠেঙ্গি এগুলো আছে নাকি ইসলামের মধ্যে? কোথায় আছে যে মারামারি করা লাগবে, মিছিল করা লাগবে, ধর্মঘট করা লাগবে? এ ধরনের জিহাদে অংশ নিতে হবে। এগুলো কি? এগুলি বাদ দিয়ে শান্তভাবে যদি করা যায়। অল্প অল্প, ছোট ছোট দোয়া শিক্ষা দেন, যাতে করে সহজে বেহেস্তে চলে যাওয়া যায়। আমি বলছি ভাই, রসুলুল্লাহ্ আমাদেরকে এ রকম শেখান নাই যে, এ রকমের চোরাগলি বেহেস্তে যাওয়ার জন্য আবিষ্কার করে দেব, ছোট্ট একটা দোয়া পড়বেন আর আপনারা বেহেস্তের বারান্দায় গিয়েই কলা খাওয়া শুরু করলেন! এত সহজে বিষয়টা আসবে না। বিষয়টা খুবই কঠিন।’

একটি আরবি পত্রিকায় দেখা যায় পর্দায় এবং কথা শোনা যায়
এখানে যে একটি পত্রিকা দেখা যাচ্ছে এর নাম হলো ‘জরবে মোমিন’। এ পত্রিকাটা আন্তর্জাতিক হরকাতুল জিহাদ ইসলাম অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে এই পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে বের হয়। সারা বিশ্বে যারা হরকাতুল জিহাদ করে তাদের জন্য একটা মুখপত্র হিসেবে এটা ব্যবহার করা হয়। আমাদের বাংলাদেশেও যারা হরকাতুল জিহাদ করে তাদের হাতেও চলে আসে।’

হরকাতুল জিহাদসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ জঙ্গি, মৌলবাদী সংগঠন ইসলামের নামে নরহত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে সৌদি ওহাবীবাদের অনুসারী মওলানা মওদুদী ও তার দল জামায়াতে ইসলামীর অন্যান্য নেতার বই পড়ে, কিংবা ওয়াজ শুনে। কি আছে এসব জিহাদী বইয়ে?
সাইফুল্লাহ
(ওয়াকাতিলুফি ছাবিলিল্লাহিল্লাদি ওকাতিলুনাকুম ওয়ালা তায়াবাদু ইন্নালাহা আলা লিমুন ) কতল কর আল্লাহ্র রাহে তাদের বিরুদ্ধে, যারা লড়াই করে তোমাদের বিরুদ্ধে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি কর না। তাদেরকে হত্যা কর, যেখানে পাও সেখানেই। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা করজোড়ে জিজিয়া প্রদান না করে।

আরাকানের শাকিল জিহাদীকে না পেলে আমরা জানতাম না যে, লিবিয়ায় এখনো বিভিন্ন দেশের জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়।
উত্তরদাতার ছায়া : লিবিয়াতে এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সেখানে প্রশিক্ষণ চলাকালীন অবস্থায় আমার হাঁটু ভেঙে যায়। এরপর বাংলাদেশে চলে আসি।

আরাকানে জিহাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছে হরকাতুল জিহাদের মীর আহম্মদ। তার পিতার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমরা গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক দুর্গম গ্রামে।
আহমেদ হোসেন
হুজির ‘শহীদ’ মীর আহম্মদের বাবা
আমার ছেলে মীর আহম্মদ তালীমুদ্দীন মাদ্রাসায় পড়ত। (আল-জামিয়াতুল ফোরকানিয়া তা’লীমুদ্দীন) মাদ্রাসায় গিয়ে আমি ওদেরকে জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের কাছে আমার ছেলের কোন খোঁজখবর আছে কি না? তখন ওরা আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে যে আপনি শহীদের আব্বা। আপনার ছেলে শহীদ হয়েছে। কোথায়? বলে, আরাকানে, বার্মায়। যাওয়ার পথে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে সে শহীদ হয়েছে। তারা তিনজন শহীদ হয়েছে। একজন ঢাকার কাজী কাওসার, আরেকজন সিলেটেরÑ আমি তার নাম ভুলে গেছি।
১৯৯৬ সালের আগেই মাসিক দাওয়াত নামে মুফতি জয়নাল ইসলাম একটা পত্রিকা বের করেছিল। লাদেনের সঙ্গে কি কি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তা ছবিসহ এ পত্রিকায় বের হয়েছে।
মুফতি জয়নাল কোথায় জিহাদ করেছে?
মীর আহম্মদের বাবা : সে কিসের জিহাদ করেছে? সে শুধু মাদ্রাসার ছেলেদের নিয়ে জিহাদে পাঠিয়ে দিত। তার ছেলেকে করাচি পড়াচ্ছে। মানুষের ছেলেদের বয়ান করে, কুরআন হাদিস দিয়ে বয়ান করে, আতঙ্কিত করে জিহাদে পাঠিয়েছে।
আপনি কি খুশি যে, আপনার ছেলে আরাকানে গিয়ে শহীদ হয়েছে?
মীর আহম্মদের বাবা : খুশি কি আর অখুশি কি? সে শহীদ হয়ে গেছে। আমার তো আর বলার কিছু নেই। কাকে বলব? আল্লাহকে বলছি।
আপনি কি চেয়েছিলেন যে, আপনার ছেলে এভাবে শহীদ হোক?
মীর আহম্মদের বাবা : না। আমি আমার ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছি। সে শহীদ হবেÑ আমার কি ভালো লাগছে? মনটা কি ভালো আছে?

মীর আহম্মদ শহীদ হবার পর তালীমুদ্দিন মাদ্রাসা থেকে শুধু এই সনদটি দেয়া হয়েছে তার পিতা আহম্মদ হোসেনকে।
মীর আহম্মদের বাবা : আর কিছুই দেয়নি। না, টাকা পয়সা, অর্থ সাহায্যÑ কিছুই করেনি। দেখতেও আসেনি। মুফতি ইজহার দেখতেও আসেনি। আমি অনেক আলেমকে বলেছিÑ কিয়ামতের ময়দানে, হাশরের ময়দানে মুফতি ইজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেব আল্লাহর দরবারে। তখন বহু আলেম আমার ওপর রেগে যায়। কেন তুমি অভিযোগ দেবে?
আমাদের হযরত ওমর (রাঃ) জিহাদে লোক পাঠিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ মারা গেছেÑ শহীদ হয়েছে। ওদের বাড়িতে আটার বস্তা মাথায় নিয়ে হযরত ওমর রুটি বানিয়ে খাইয়েছেন। কিন্তু মুফতি ইজহার আমাকে দেখতেও আসেনি। আমার বিবিকেও দেখতে আসেনি। আমরা কোন অবস্থায় আছি।

স্যার আপনার গবেষণায় জঙ্গি মৌলবাদীদের সঙ্গে জামায়াতের কি সম্পর্ক প্রমাণ হয়েছে?
ড. আবুল বারকাত (অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) : গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজারের ওপর জঙ্গি বিভিন্নভাবে গ্রেপ্তার হয়েছে। এবং যেসব জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছিল তাদের শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্র অবস্থায়, যদি ছাত্র হয়ে থাকে অথবা গ্রেপ্তারকৃত অবস্থায় হয় জামায়াতের রাজনীতি অথবা জামায়াতের রাজনীতির যে ছাত্র সংগঠন তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।

হাসান রফিক
আগে ছাত্রশিবিরের একটা স্লোগান ছিল জিহাদ, জিহাদ, জিহাদ চাই, জিহাদ করে বাঁচতে চাই। আমি হরকাতুল জিহাদ করেছি ঠিকই, আজও পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের সঙ্গে আমার খুব একটা ভালো সম্পর্ক। সে সময় আমি ছাত্রশিবিরও করতাম, হরকাতুল জিহাদও করতাম। হরকাতুল জিহাদ থেকে জাগো মুজাহিদ পড়ে আমরা জিহাদের উৎসাহ নিতাম আর শিবিরের বইতে তো জিহাদের কথা আছেই।

ড. আবুল বারকাত : যারা ধরা পড়েছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, গত নির্বাচনের সময় তারা কার জন্য কাজ করেছে? সেখানে স্পষ্টভাবে তাদের প্রথম চয়েস ছিল জামায়াতের সরাসরি প্রার্থী যদি থেকে থাকে সেটা অথবা জামায়াতের সঙ্গে যে চারদলীয় জোট, সে জোটের পক্ষে তারা কাজ করবে।

কীভাবে সাহায্য করত তারা?
মুফতি ওবায়দুল্লাহ : টাকা দিয়ে, সাহস দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করত তারা।
কোন নেতা আসত?
মুফতি ওবায়দুল্লাহ্ : আমি শাহজাহান চৌধুরীকে (জামায়াতের এমপি) দেখেছি।
কোথায়?
মুফতি ওবায়দুল্লাহ্ : মাদ্রাসায়।
কি কারণে গিয়েছিল?
মুফতি ওবায়দুল্লাহ্ : প্রশিক্ষণ দেখতে এসেছিল। প্রশিক্ষণের সময় আলাপ-আলোচনা করত, বাংলাদেশে যেভাবে নাস্তিক, মুরতাদ, ইহুদী নাসারারা যেভাবে জাল বুনছে, সেই জাল থেকে যেন আমরা পরিত্রাণ পাই। সে জন্য আমরা ছাত্রদের গড়ে তুলি। টাকার মাধ্যমে, অস্ত্রের মাধ্যমে। কারণ হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ইসলাম টিকিয়ে রাখার জন্য যদি নাচ দেশে দিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে হয় তোমরা চীনে গিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে আস। মানে ইসলামের স্বার্থে

হাসান রফিক
জামায়াতে ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ আরএসও ওদের যে কি সম্পর্ক তা যদি আমি মৌখিকভাবে বলি তবে তা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু আমার প্রমাণ আছে আরএসও-র একটা মুখপত্র আরবিতে বের হয়। আরেকটা বাংলা। আরবিটার নাম হলো ‘আল তাদাম’। ১৯৯১ সালে ও আল তাদাম পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদনে বের হয়েছে যে, জামায়াতের চৌদ্দগ্রামের এমপি ড. আব্দুল্লাহ্ মোঃ তাহের, তিনি ১৯৮৭ থেকে ৮৯ পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিল। আরেকজন- আমীরুল ইসলাম বকুল ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এরা দু’জন সেখানে ভারি অস্ত্রই কেবল নয়, একে ফোরটি সেভেনসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র যা চিহ্নিত করতেও অনেকের হিমশিম খেতে হবে এবং আইআইএফএসও অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট। যেটা সারা বিশ্বে যারা ইসলামিক রাজনীতি করে এবং জিহাদভিত্তিক কাজ করে এটা তাদের একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ সংস্থার মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামের ছাত্রশিবিরের আব্দুল্লাহ্ মোঃ তাহের ঠিক করতে হবে কি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, কি অস্ত্র আনতে হবে সবকিছু তত্ত্বাবধান হতো।

মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী
চেয়ারম্যান, ইসলামী ঐক্যজোট
১৯৭৭ সালে শিবির বিভক্ত হওয়ার পর আলবদর বাহিনীর সদস্য মীর কাশেম আলীকে কান্ট্রি ডিরেক্টর করে দেয়া হলো। এই যে ফান্ডটা এসেছে, সবটুকুই শুধুমাত্র জামায়াতের দলীয় ফান্ড হিসেবে পরিচিত হয়েছে, আর কোনো খাতেই ব্যবহার হয়নি।

ড. আবুল বারকাত : এটা একটা ত্রিভুজ। এই ত্রিভুজের মাথায় রয়েছে হেডকোয়ার্টার। প্রকাশ্য একটি সংগঠন যা এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আর অন্য দুই ভুজের মধ্যে এক বাহুতে আছে ওই উগ্র ধর্মীয় ১২৫টা জঙ্গি গ্রুপ। এবং এই জঙ্গি গ্রুপের আর্থিক যে লেনদেন সেই লেনদেনের জন্য ইসলামী ব্যাংককে কিন্তু একবার এবং বাংলাদেশের একটি ব্যাংকই এ পর্যন্ত মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে শাস্তি পেয়েছিল। যদিও শাস্তি তেমন কিছু নয়, এক লাখ টাকা জরিমানা মাত্র। কিন্তু সেটা হয়েছিল জঙ্গিদের সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণেই।
জঙ্গিরা যখন চারদলীয় জোটের আমলে ধরা পড়ে তখন তাদেরকে ছাড়ানোর জন্য জামায়াতের দুইজন মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং মুজাহিদ হেন কাজ নাই যা তারা করেনি। এবং ছাড়াতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে তখনই শুধুমাত্র বলেছে যে, এদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

২০০৪ সালের ১ এপ্রিলে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের যে বিশাল চোরাচালান ধরা পড়েছে তার সঙ্গে চারদলীয় জোট সরকারের নেতৃবৃন্দসহ বাংলাদেশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যুক্ত ছিল বলে জানিয়েছেন এই মামলার গ্রেফতারকৃত বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

ড. আবুল বারকাত : চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র যে জেটিতে ভিড়ল এই জেটিটা কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় ছিল। শিল্পমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বা জানা ছাড়া অস্ত্র চট্টগ্রামের জেটিতে ভিড়তে পারে এটা হতে পারে না। আর তখন শিল্পমন্ত্রী হলেন জামায়াতে ইসলামের মতিউর রহমান নিজামী

মুফতি হান্নান : এরা হচ্ছে মাফিয়া চক্র। যারা স্মাগলিং করত তারা ভারতে উলফাদের এবং কাশ্মীরীদের মাল দেয়। এখানে যারা সরকার ছিল তাদের সঙ্গে একটা চুক্তির মাধ্যমে এবং বিভিন্ন জায়গায়- আর্মি, বিডিআর, নৌবাহিনীকে টাকা পয়সা দিয়ে এগুলো নেয়া হতো। কিন্তু হঠাৎ করে কিছু মাল চলে গেছে এবং কিছু মাল গ্রেপ্তার হয়েছে। এই মালগুলো দেশের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে জামায়াতের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আপনার গবেষণায় কি পেয়েছেন?
ড. আবুল বারকাত : জামায়াত ইসলাম ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতাটা দখল করতে চায় এবং এটা নতুন কোনো পরিকল্পনা না। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা ধর্মের যে বিষয়াদি আছে তার সঙ্গে বাস্তব জীবনÑ এ দুটোকে এক জায়গায় করে শক্তিশালী অর্থনীতিভিত্তিক একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তারা চালু করতে চেয়েছে। যেটার সমান্তরাল কোনো প্রক্রিয়া বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।


মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী
এখন বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব অনেক সোর্স আছে। কিন্তু প্রথম তারা টাকাটা আনে তিনটা কথা বলে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব তাদেরকে বেশি টাকা দিয়েছে। সৌদি আরব সরকারের যিনি ধর্ম (?) ছিলেন, আব্দুল ওহাব তার লেখা-লেখনি আর মওলানা মওদুদীর লেখালেখনি খুব কাছাকাছি। উনার এই লেখালেখির সুবাদে সৌদি সরকার জামায়াতের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক রাখতে চাইত।
এই সুযোগটায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এমন একটা প্রচার তারা করলেন যে, আমাদের দেশে একটা মসজিদও আর অবশিষ্ট নেই। তখন সৌদি দূতাবাসও এখানে ছিল না। যে মসজিদগুলো সব মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙে দিয়েছে। এখানে যে মক্তবগুলো ছিল যেখানে কোরআন পড়ানো হতো, মাদ্রাসাগুলো ছিল যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো- সব তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। সব আলেম ওলামাকে জেলে নিয়ে দেয়া হয়েছে।
সৌদি আরবের ধর্মের আবেগটাকে তারা কাজে লাগিয়ে প্রথম ‘মসজিদ নির্মাণ করতে হবে, সংস্কার করতে হবে, মাদ্রাসাগুলোকে খুলতে হবে, কোরআন শরীফ মানুষকে পুনর্বণ্টন করতে হবে’ এগুলো বলে একটা টাকার উৎস তারা তৈরি করে।

ড. আবুল বারকাত
ওই একটা সেক্টরে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন গত ৩৫ বছর ধরে এবং মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ রকম যে, এই সেক্টরগুলো যে তারা চালান, এখানে কিন্তু কর্পোরেট যে ব্যবস্থাপনা সেটা, খুব বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনাটা আছে। কিন্তু পরিচালিত হয় একটা মতাদর্শ থেকে।
যারা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছেন তাদের প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ওই রাজনীতির সঙ্গে আছেন বা অতীতে ছিলেন।
দ্বিতীয় যেটা দেখা যায় সেটা হল যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমার হিসেবে বর্তমানে বছরে ১৫শ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়। এই টাকার শতকরা ২০ শতাংশ অর্থাৎ তিন শ কোটি টাকা তারা তাদের ফুল টাইমার বা রাজনীতিতে পূর্ণকালীন সদস্য পোষার জন্য ব্যবহার করেন।
মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী : ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াতের হাজার কোটি টাকার ওপর ইনকামের সোর্স। আমরা যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বলব তার সম্পর্ক নাই এটা তো একটু দুর্বল মনে হয়। আমি যদি বলি ওগুলো জামায়াতের প্রজেক্ট নয় জামায়াত ক্ষমা চাইতে বলতে পারে তবে আমি হাত জোড় করে তাদের কাছে ক্ষমা চাব। এই প্রজেক্টগুলো জামায়াতে ইসলামীর। এর একটা বড় অংশ জামায়াতের ওই যে নেতারা আলবদর বাহিনীতে ছিলেন। সরাসরি অধ্যাপক গোলাম আযমের সঙ্গে। এরকম ১২-১৪ জন বার বার পরিচালক, এমডি, চেয়ারম্যান। সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তারা, ইসলামিক ব্যাংক তারা, ইবনে সিনা তারা, ইসলামী ব্যাংক হসপিটাল তারা, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন তারা। এদের বাইরে আপনি তালিকা নিয়ে দেখুন যে আর কেউ পরিচালনায় আছে কি না?

হাসান রফিক
বাংলাদেশ হরকাতুল জিহাদের একাউন্টে যত টাকা আসত, এমন কোনো সংগঠন পৃথিবীতে নেই যার মধ্যে জঙ্গিবাদের টাকা নেই। কিন্তু এ বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ সরাসরি হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের নামে এবং বাংলাদেশ জাগো মুজাহিদ পত্রিকার নামে ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট করেছে। বোমা মারামারির আগ পর্যন্ত তা সচল ছিল।

জামায়াত ও মৌলবাদীরা বিদেশি এনজিওর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে কয়েকশ ইসলামী এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছে জঙ্গিদের মদদ দেয়ার জন্য। ২ অক্টোবর ২০০৫ এশিয়া টাইমসের সূত্র মতে ইসলামী এনজিওকে অর্থ সরবরাহকারী মধ্যপ্রাচ্যের ১০টি দাতা সংস্থা হলো- রাবেতা আল ইসলামী, রিভাইভাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি, সোসাইটি অব সোশ্যাল রিফর্ম, কাতার চ্যারিটেবল সোসাইটি, আল মুনতাদা আল ইসলামী, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল-ফোরকান ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশন, কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি, মুসলিম এইড বাংলাদেশ।
শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইউরোপ থেকে পাঠানো দাতাদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে মসজিদ ও মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে জঙ্গির গ্রোথ অব্যাহত রয়েছে। ব্রিটিশ ইসলামী এনজিও গ্রিন ক্রিসেন্টের অর্থ সাহায্যে ভোলার এক মাদ্রাসায় ২০০৯ এর ২৪ মার্চ র‌্যাব খুঁজে বের করেছে এক বিশাল অস্ত্র ভা-ার।



দ্বিতীয় পর্ব (জিহাদের লক্ষ্য)

হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা বাংলা ভাষার বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার জন্য হামলা করেছিল ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি

মুফতি হান্নান : কবি শামসুর রাহমান। শুনেছি যে, ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বই-পুস্তক লিখেছেন। আজান সম্পর্কে কটূক্তি করে বলেছেন যে, আজানটা হলো পতিতালয়ের ডাক। এ ধরনের কথা শোনার পর কিছু মুজাহিদ অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে মারার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার লেখা পড়িনি।
জাগো মুজাহিদ পত্রিকাতে তো আপনারা শামসুর রাহমানসহ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীকে নাস্তিক-মুরতাদ এগুলো বলেছেন?
মুফতি হান্নান : যদি কেউ, যে কোনো অবস্থায় ইসলামের বিরুদ্ধে বলেছে তবে তার বিরুদ্ধে আমরা লেখনী করেছি।
মুরতাদের শাস্তিটা কি?
মুফতি হান্নান : মুরতাদের শাস্তি হলো, যদি মুসলমান হয় তবে ইসলামের দৃষ্টিতে ওয়াজিবুল কতল (মৃত্যুদণ্ড দেয়া ওয়াজিব)।

আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠস্বর : ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক ও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছিল হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা।

হুমায়ুন আজাদ
প্রথাবিরোধী বলতে আমি যা বুঝি তা হচ্ছে গত চার হাজার বছর ধরে যে বিশ্বাসগুলো, যে বিধি-বিধানগুলো আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং যেগুলোকে সত্য, তুল্য, অবশ্য মান্য বলে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বলা হয় এগুলো কিন্তু আমি গ্রহণ করিনি। সেটা ধর্মের ক্ষেত্রে তো আমি বিন্দুমাত্র গ্রহণ করিনি, সমাজের ক্ষেত্রে গ্রহণ করিনি।

তলোয়ারের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে এই প্রতিবাদী লেখকের সারা শরীর। হামলার ছয় মাস পর তিনি জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন।

দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
মুক্তচিন্তার নামে আল্লাহ্ এবং রাসুলের নামে আজেবাজে কথা বলতে পারবে না। তাহলে ইমান আর এই দুনিয়াতে থাকল না। এ রকম একটা লোক ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, আল্লায় তারে বিদায় করি দিছে। আমরা ওইটার নাম নিলাম না পবিত্র মাহফিলে। দেশে মরলে খুবই অসুবিধা হইত। আল্লাহ্ শয়তানেরে বিদায় করছে। ওর কবরে আগুন জ্বলুক কেয়ামতের আগে পর্যন্ত।

হাসান রফিক
আমি সে সময় জামায়াতে ইসলামীর একটা মাদ্রাসায় ছিলাম। ওই মাদ্রাসায় আমার সহকর্মী যারা ছিল শিবিরের ওদের কাছে গিয়ে বললাম, হুমায়ুন আজাদ তো মারা যেতে পারে। তো তারা বলল, ‘ওই একজন নাস্তিক মারা গেলে তোমার অসুবিধা কি? তুমি এর ভালোটা কি করে বুঝবে? নাও মিষ্টি খাও।’ ওরা আমাকে মিষ্টি খাওয়ালো।

শুধু হুমায়ুন আজাদ নয়, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, মানবাধিকার নেত্রী জাহানারা ইমাম, অধ্যাপক আহমেদ শরীফ, লেখক তসলিমা নাসরিন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক আবুল বারকাতসহ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সকল ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী জঙ্গি মৌলবাদীদের বিবেচনায় নাস্তিক ও মুরতাদ অর্থাৎ হত্যার যোগ্য

তসলিমা নাসরিন
ওরাই তাহলে পৃথিবী শাসন করুক। ওদেরই তাহলে স্বাধীনতা দেয়া হোক। ওদের জন্যই খুলে দেয়া হোক অতঃপর অস্ত্রাগার। তলোয়ারগুলো তুলে নিক, কোমরে গুঁজে নিক পিস্তল, হাতে হাত বোমা। দারুল ইসলামের মন্ত্র মাথায় নিয়ে ওরা না হয় বেরিয়ে পড়–ক। যেদিকে যত মুরতাদ পাক মুণ্ডু কেটে নিক। মেয়েদের মারুক, মেরে ফেলুক। নত মস্তক নারীদের গায়ে বোরখা চাপিয়ে দিক, ঘরবন্দি করুক। ঘন ঘন পুত্র পয়দা করতে ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলুক। পৃথিবীর যত পুরুষ আছে একযোগে সবাই না হয় তালেবান হয়ে যাক। আর্জেন্টিনা থেকে আইসল্যান্ড, মালদ্বীপ থেকে মরক্কো, বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন ওদের দখলে চলে আসুক। ইসলামের পবিত্র জমিতে পরম শ্রদ্ধায় মাথা ঠেকাক আমাদের জননেতাগণ। মুকুট পরিয়ে দিক একেকটা জঙ্গির মাথায়। কৃতকর্মের জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করুক জননেতাগণ। ধর্মান্ধের পা ধোয়া পানি পান করে পুণ্যবান হোক আমাদের জননেতাগণ।

মৌলবাদীদের হুমকির কারণে প্রতিবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল থেকে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।

তসলিমা ফিরে এলে কি আপনারা কতল করবেন তাকে?
মুফতি হান্নান : কতল তো তসলিমার জন্য ওযাজিব হয়ে থাকবে। যদি রাষ্ট্র তাকে আহ্বান জানায়, যদি সরকার এ আহ্বানকে সাড়া না দেয় তাহলে তার ওপর কর্তব্য আসবে যে সে নিজেই এটাকে পদক্ষেপ নেয়।

তসলিমা নাসরিন
আমি নিজের জীবনের কথা ভাবি না। আমি দেশটার কথা বেশি ভাবি। যখন দূর থেকে খবর পাই দেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তখন খুব কষ্ট হয় যে, এই দেশের স্বপ্ন কি আমরা দেখেছিলাম?

১ বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। ৩০ কোটি বাঙালির প্রাণের প্রিয় উৎসব। মৌলবাদীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য, ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনায় ভাস্বর বাঙালি সংস্কৃতি। মৌলবাদীরা বারবার হামলা চালিয়েছে ছায়ানট ও উদীচীর অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হরকাতুল জিহাদ এবং অন্যান্য জঙ্গিদের হত্যা ও বোমা হামলার খতিয়ানে আমরা পাই ৬ মার্চ ১৯৯৯-তে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা বিস্ফোরণ, সেখানে নিহত হয় ১০, আহত শতাধিক। ৯ অক্টোবর ১৯৯৯ খুলনায় আহমদীয়া মসজিদে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭, আহত ৫০। ২০ জুলাই ২০০০তে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা স্থাপন সভা আরম্ভের পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী এই বোমা অকেজো করে দেয়। ২০ জানুয়ারি ২০০১-এ ঢাকার পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭, আহত শতাধিক। ১৪ মার্চ ২০০১ রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা নব বর্ষবরণ অনুষ্ঠানো বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১১, আহত শতাধিক। ৩ জুন ২০০১-এ গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরের গির্জায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১০, আহত ৩০। ১৭ জুন ২০০১ নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ২১, আহত শতাধিক। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০১ বাগেরহাটে আওয়ামী লীগের নির্র্বাচনী প্রচার সভায় বোমা বিস্ফোরণ। নিহত হয় ৯, আহত শতাধিক। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আলোচনা সভায় বোমা বিস্ফোরণ। সেখানে নিহত হয় ৪, আহত ১৫। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০২-এ সাতক্ষীরার গুরপুকুরের রক্সি সিনেমা হলে এবং সার্কাস প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে নিহত হয় ৩, আহত ২শ। ৭ ডিসেম্বর ২০০২ ময়মনসিংহের তিনটি সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত হয় ১৯, আহত ৪৫। ১৭ জানুয়ারি ২০০৩-এ টাঙ্গাইলের সখীপুরের ফালুচাঁদ ফকিরের মাজারের মেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে নিহত হয় ৭, আহত হয় ৮। ১ মার্চ ২০০৩ খুলনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলা হয়। তাতে নিহত হয় ১, কিছু সংখ্যক আহত হয়। ১২ জানুয়ারি ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত হয় ৭, আহত ৭০। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ খুলনায় সাংবাদিক মানিক সাহা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়। ২১ মে ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর আর্জেস গ্রেনেড হামলা হয়। তাতে নিহত হয় ২, হাইকমিশনারসহ আহত হয় ৭০। ২৭ জুন ২০০৪ খুলনায় দৈনিক জন্মভূমির অফিসে বোমা বিস্ফোরণে সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু নিহত হন। ৭ আগস্ট ২০০৪ সিলেটে গুলশান হোটেলে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৪০ আহত হয়। ২১ আগস্ট ২০০৪ আওয়ামী লীগের জনসভায় আর্জেস গ্রেনেড ও বোমা হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪, শেখ হাসিনাসহ আহত হয় ৫শ’র অধিক। ১৬ নবেম্বর ২০০৪ মৌলভীবাজারে যাত্রা প্রদর্শনীতে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ১০ জন। ১৭ জানুয়ারি ২০০৫-এ গোপালগঞ্জে এনজিও ‘ব্র্যাক’-এর অফিসে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ২১ জন। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ খুলনা প্রেসক্লাবে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ১ জন সাংবাদিক। আহত হন ৩ জন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। আহত হয় ৮ জন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আলোচনাসভায় বোমা বিস্ফোরণ ২০০৫-এর ১৭ আগস্ট জঙ্গিরা সারা দেশের তেষট্টিটি জেলায় একসঙ্গে পাঁচ শ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তারা কত শক্তিশালী। ৩ অক্টোবর ২০০৫ সালে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং চট্টগ্রামের কোর্টে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৩ জন, লক্ষ্মীপুর কোর্টের ১ জন বিচারকসহ আহত হন ৩৮ জন। ১৪ নবেম্বর ২০০৫ সালে ঝালকাঠি জেলা কোর্টে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, সেখানে নিহত হন ২ জন বিচারক, আহত হন ৩ জন। এভাবে ২৯ নবেম্বর ২০০৫, ১ ডিসেম্বর ২০০৫, ৮ ডিসেম্বর ২০০৫ এর তিনটি বোমা হামলায় নিহত হন ১৯ জন আর আহত হন ১৫৮ জন।

দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
জাতীয়তাবাদ কার তৈরি- আল্লাহর না মানুষের? পুঁজিবাদ কার তৈরি- আল্লাহর না মানুষের? সমাজতন্ত্র কার তৈরি- আল্লাহর না মানুষের? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কার তৈরি- আল্লাহর না মানুষের? মানুষের তৈরি করা এসব মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারাই সংগ্রাম করে, যারাই লড়াই করে আল্লাহ্পাক বলেছেন তারা লড়াই করে শয়তানের পথে।

বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
সভাপতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ক নাগরিক কমিশন
বাংলাদেশের জনগণ একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার লক্ষ্যে ১৯৫২ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছে। এবং তারই ফলশ্রুতিতে ৭২-এ সংবিধান হয়। এ বাহাত্তরের সংবিধানকে অস্বীকার করা মানেই হলো বাংলাদেশকে অস্বীকার করা, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা।

আয়েশা খানম
সভানেত্রী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
ওরা কোন ধরনের মুক্তচিন্তা পছন্দ করে না এবং সেদিক থেকে মুক্তচিন্তার মানুষ, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী সংগঠনগুলো এবং মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, রাজনীতিবিদ, নারীকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক বাংলাদেশে তো সবাই এদের আক্রমণের শিকার।

অধ্যাপক অজয় রায়
ওদের বিশ্বাসের বাইরে সে হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিস্টান হোক তাদের মতকে তারা সহ্য করবে না। (ফ্ল্যাশব্যাকে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী : আমাদের দেশের রেডিও এবং টেলিভিশনে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়া হয়। তারপর বলে, ‘বিশ্বের সকল সৃষ্টির মঙ্গল হোক। ওং শান্তি, ওং শান্তি’। আমি বলেছি এভাবে যদি কেউ ‘ওং ওং’ করতে করতে রক্তবমিও করে তবুও শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।) এবং মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে একটা তালেবানি ধরনের রাষ্ট্রে পরিণত করা। যেখানে নন-মুসলিম থাকলেও তারা একটা নির্জীব, ক্লিব হয়ে থাকবে। তাদের কোনো মত থাকবে না, পথ থাকবে না। আমরা যেটা বলে দেব বা স্টেট যেটা বলে দেবে সেটাই মানতে হবে। এদের কোনো রাষ্ট্রীয় অধিকার থাকবে না, নাগরিক অধিকার থাকবে নাÑ এটাই তারা চায়।

দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
যদি শান্তি পেতে হয় তবে খ্রিস্টান আর ইহুদিদের জাতিসংঘের মুখে লাথি মেরে মুসলমানদের জাতিসংঘ করতে হবে।
রাজশাহীতে জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই সর্বহারা ও মাওবাদী কমিউনিস্টদের দমনের জন্য শরিয়া আদালত গঠন করলেও তার বাহিনী যাদের হত্যা ও নির্যাতন করেছে তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী সংগঠনের কর্মী ও সমর্থক। রাজশাহীর নওগাঁ জেলার হামির কুৎশা গ্রামের এই বাড়িতে বাংলা ভাই তার শরিয়াহ্ আদালত বসিয়েছিল। যে বাড়ির মালিক ’৭১-এর রাজাকার রমজান কয়া।
রমজান কয়া : বাংলা ভাই এখানে থাকত। কয়েকবার এসেছিল। আসার পর বলল, তোমরা সরে যাওÑ ধানের কামলাদের বলল, আমি বুঝতে পারিনি...
একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা : আমাকে প্রকাশ্যে এই রমজান কয়া এখানে নিয়ে এসে তিনটি বাঁশের খুঁটিতে আমার দুই পা রশি দিয়ে বেঁধে টানিয়ে আমার দুই পা, ডান হাতের কব্জি, হাতের আঙ্গুল এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে মারাত্মকভাবে মারপিট করে, হাড়গোড় ভেঙে ফেলে।
একজন স্থানীয় : আমার এই বাড়িতে একদিন বাংলা ভাই প্রায় এক দেড় শ লোক সঙ্গে নিয়ে এসে আমার বাড়ি ভেঙে ফেলে। আমার অপরাধ যে, আমার ছোট ছেলে সিরাজ ইফতেখার মিঠু যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। বিপুল এবং বাংলা ভাইয়ের ক্যাডাররা সাত্তার মাস্টারের নেতৃত্বে শিকাদারি জামে মসজিদে ট্রেনিং দিচ্ছিল। সেখানে আমার ছেলেটা বিরোধিতা করেছিল বলে তারা আমার ছেলেকে হত্যা করার জন্য ধরেছিল। আমার ছেলেটা জানে বেঁচেছে কোনোরকমভাবে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার অপরাধে আমার বাড়িঘর এবং সব আসবাবপত্র যা কিছু কিছু সব ভেঙে শেষ করে দিয়েছে। এই নৃশংসতা যা এখানে হয়েছে, আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগেও বোধহয় এ রকম হয় না। সেই অত্যাচার তারা করেছে। রাজশাহীর মানুষ জানে যে, বাংলা ভাই কি নৃশংস অত্যাচার করেছে এ অঞ্চলে।

বাংলা ভাই কি রকম লোক ছিল?
রমজান কয়া : ভালো লোক ছিল। ভালো না হলেÑ সর্বহারারা মানুষ জবাই করত। বাংলা ভাই আসার পর আর একটা মানুষও জবাই হয়নি।
ও জবাই করেনি মানুষ?
রমজান কয়া : না, দেখিনি।

মোহাম্মদ মুসা
নিহত সিপিবি কর্মী আব্দুল কাইয়ুম বাদশার ভাই
ঘটনাটা ১৯ মে ২০০৪ সালের। তারা মাইকিং করে যে, বাদশাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে বিচার করে জবাই করা হবে। আপনারা উপস্থিত থাকবেন। আমরা খবর শোনার পর প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলি। প্রশাসন তখন বলে যে, এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে। এটা খুব হাইলি পলিটিক্যাল একটা বিষয়, রাজনৈতিক হাইকমান্ডের নিষেধ আছে। ২০ মে নন্দীগ্রাম উপজেলার ক’জন সাংবাদিক নওগাঁয় ফোন করে জানায় যে, এখানে বামুনগ্রাম নামে একটি গ্রামে একটি লাশ ঝুলানো আছে, এটা আপনাদের নিখোঁজ বাদশার লাশ হতে পারে। নওগাঁর সাংবাদিকরা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যায়। যাওয়ার পর তারা উল্টো করে ঝোলানো লাশের ছবিটা তুলে নিয়ে আসে। আনার পর আমাদেরকে দেয়। আমরা তখন চিহ্নিত করি যে, এটা আমার ভাই বাদশা।

কোহিনূর বেগম
নিহত জানবরা সরদারের স্ত্রী
আমার স্বামী ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। আমার স্বামীকে জেএমবির লোকরা খোঁজাখুঁজি করে। আমি আমার স্বামীকে লুকিয়ে রাখি। ১টার দিকে খবর আসে দীপশংকর মারা গেছে। সন্ধ্যাবেলা সেই লাশ দেখতে যখন সবাই গেছে তখন আমার স্বামী বিলের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যায়। আজ দীর্ঘ তেইশ মাস হচ্ছে, সে কোথায়, কীভাবে আছে বলতে পারব না। তারপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। আমি তার খবর জানি না।
তার চলে যাওয়ার পর বাংলা ভাইয়ের লোকজন আমার বাসায় আসে সব ভেঙেচুরে দিতে। তখন আমি আমার সন্তানদের তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে বলি, দেখুন, আমার স্বামী কোনো অন্যায় করেনি। তিনজন বিএনপি প্রার্থী আছে, সে একা আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আওয়ামী লীগ করা যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে তবে তার সাজা আইনের হাতে হবে। তার জন্য আইন আছে, আপনারা আইনের আশ্রয় নেন। আপনারা এসব কি করছেন?
তখন তারা বলে, আইনের আশ্রয় নেয়া যাবে না। ও কোথায় আছে বের করে দাও। তখন আমি বলি, ভাই ও কোথায় আছে তা আমি বলতে পারব না। তখন দুই দিন ধরে আমার বাড়ি লুট করে। বাড়িতে যা ছিল সব নিয়ে যায়।

রেবেকা সুলতানা
নিহত আওয়ামী লীগ কর্মী খেজুর আলীর স্ত্রী
বাংলা ভাইয়ের লোক তাকে রামদা দিয়ে মাথায় আঘাত করে। ওই রক্তাক্ত অবস্থায় তার হাত-পা বেঁধে তাকে প্রচ- মারে। উপুড় করে ফেলে রেখে মারে আর আমার শাশুড়িকে বলে যে, আপনার ছেলেকে শেষবারের মতো দেখে নেন, তাকে উপরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওকে জবাই করা হবে, আর ফেরত পাবেন না। তারপর হাত-পা বেঁধে ভ্যানে করে নিয়ে যায়। ৮ দিন পর আমরা খবর পেলাম যে, বিএটি ক্যাম্পে একটা লাশ পুঁতে রাখা হয়েছে, কিন্তু কার লাশ তা বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
আমরা সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি চার টুকরো করে তাকে মাটির নিচে রাখা হয়েছে।

রাবেয়া বেওয়া
নিহত আবু তালেবের মা
আমার দিকে কেউ দেখে না বাবারে...। এখন আমাকে কে দেখবে? আমার ছেলেটি বেঁচে থাকলে কত কিছু করত, আমাকে দেখাশোনা করত। আমার বাছাকে এত শাস্তি দিয়েছে- এত মেরেছেÑ একটু পানিও খেতে দেয়নি।

দ্বিজেন্দ্রনাথ সাহা
নিহত দীপশঙ্কর সাহার পিতা
আমার সন্তানকে ওরা মেরে ফেলেছে।

জঙ্গি-মৌলবাদীদের হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ সব সময় সোচ্চার ছিল। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা রোকা ঢাকা এসে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে সরাসরি বাংলা ভাই সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন।

ক্রিস্টিনা রোকা : অবশ্যই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।

মতিউর রহমান নিজামী : বাংলা ভাই সম্পর্কে, তথাকথিত বাংলা ভাই সম্পর্কে আমি এ্যাড করছি। এ সম্পর্কে আমি পরিষ্কার বলেছি যে, এটা সম্পর্কে আমার কোনো কিছু জানা নেই। এ লোককে আমি চিনি না, আমার দলও চেনে না। এটাকে পত্র-পত্রিকায় বেশি ফলাও করে বলা হয়েছে। এর তেমন কোনো ভিত্তি নেই। এখানে সন্ত্রাসের ঘটনার সঙ্গে মূলত জড়িত হলো বামপন্থী, চরমপন্থী কিছু দল। যেটার একটা সর্বহারা নামে পরিচিত, আরেকটা জনযুদ্ধ নামে পরিচিত।

হাসান রফিক
শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই, সানি, আব্দুল আওয়াল ওরা সবাই একসময় ছাত্রশিবির করত। ছাত্রশিবির থেকে ওরা পরবর্তীতে শায়খ আব্দুর রহমানকে নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। তাও সেটা জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে মদীনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য। মদীনা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অনুমতি লাগে। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর যারা বড় পদে কাজ করে তাদের।

ড. মুনতাসীর মামুন
ইতিহাসবিদ, লেখক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে এসেছে তখন জঙ্গি-মৌলবাদের বিস্তার ঘটেছে। জনমতের চাপে বাংলা ভাই এবং আরো দু-একজনকে ফাঁসি দিতে বাধ্য হয়েছে বটে এবং অনেকে মনে করেছিলেন যে, তাতে বোধহয় জঙ্গিবাদের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু আমরা সব সময় বলে এসেছি এ জঙ্গিবাদের সমাপ্তি এখনো ঘটেনি।

একুশে টেলিভিশনে জেএমবির এই জঙ্গির সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে ২০ মে ২০০৯ তারিখে।
‘আক্রমণ হবে কমান্ডো স্টাইলে। সেটা হতে পারে হঠাৎ গুলিবিনিময়, গ্রেনেড-বোমা, মাইন বিস্ফোরণ, আত্মঘাতী গাড়ি আক্রমণ, আত্মঘাতী ও গুপ্ত হত্যা। আর সেজন্য অর্থপ্রাপ্তির জন্য বিদেশি দাতাগোষ্ঠীসহ দেশীয় আনসার সদস্য এবং মোহাজির গ্রুপ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে শহীদী গ্রুপে। সরকারকে বাধ্য করা হবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে।
আমাদের পরিকল্পনার আংশিক জানিয়ে দিয়ে সরকারকে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, আমীরুল মুজাহিদীন শায়খ আব্দুর রহমান ও অন্য নেতৃবৃন্দের শাহাদৎ বরণের মধ্য দিয়েও আমাদের শক্তির অবস্থান কোথায়?

আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠস্বর : বাংলাদেশে জামায়াত ও তার সহযোগী মৌলবাদীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। (ফ্ল্যাশব্যাকে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজÑ গোলাম মোহাম্মদ কাদিয়ানী কাফের আর তার অনুসারীরাও কাফের। সুতরাং বাংলাদেশে যত কাদিয়ানী আছে সমস্ত কাদিয়ানীই কাফের।

মাওলানা আব্দুল আউয়াল খান চৌধুরী
নায়েবে আমির, আহমদিয়া মুসলিম জামাত বাংলাদেশ
যারা মুসলমান তাদের মূল সংজ্ঞা হচ্ছে নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করতে হবে, পবিত্র কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহতে বিশ্বাস করতে হবে। যারা এ সংজ্ঞার অধীনে আসবে তারা আল্লাহ এবং রাসুলের প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী মুসলমান। তাদেরকে কাফের বলতে পারে এ রকম কেউ এ জগতে নেই। জামায়াতে ইসলামী ইসলামের নাম ভাঙিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে বিশ্বাস করে। অথচ ইসলাম এ ধরনের কোনো বিশ্বাস আমাদের সামনে উপস্থাপন করে না।

দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ
রাসুল (সাঃ)-এর পর যদি কেউ নব্যুয়াতের দাবি করে তবে সে কাফের। তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। তার বিরুদ্ধে লড়াই করা ওয়াজিব।
আহমদিয়া মুসলিম জামাতের ওপর মৌলবাদীদের হামলার খতিয়ান
২৯ অক্টোবর, ১৯৯২ ঢাকার বখশীবাজারে আহমদিয়া মসজিদে হামলা। আহত ৩৫।
২৭ নবেম্বর ১৯৯২ রাজশাহীর আহমদিয়া মসজিদ ও মিশন ধ্বংস।
৮ অক্টোবর ১৯৯৯ খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা। নিহত ৭, আহত ৫০।
২১ অক্টোবর ২০০৩- ৩১ নবেম্বর ২০০৩ কুষ্টিয়ার ভেড়ামার গ্রামে আহমদিয়া পরিবারদের বিরুদ্ধে সামাজিক অবরোধ।
৩১ অক্টোবর ২০০৩ যশোরের ঝিকরগাছায় আহমদিয়া মসজিদের ইমাম শাহ আলম হত্যা।
২১ নবেম্বর ২০০৩ ঢাকার নাখালপাড়ায় আহমদিয়া মসজিদে হামলা।
৮ জানুয়ারি ২০০৪ আহমদীয় প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা।
১৯ মার্চ ২০০৪ বরগুনার খাকদান আহমদিয়া মসজিদে হামলা।
১২ মে ২০০৪ পটুয়াখালীর আহমদিয়া মসজিদে হামলা, আপত্তিকর সাইনবোর্ড উত্তোলন।
২৮ মে ২০০৪ চট্টগ্রামের আহমদিয়া মসজিদে হামলা।
১৩ আগস্ট ২০০৪ খুলনার আহমদিয়া মসজিদে হামলা।
২০ আগস্ট ২০০৪ ঢাকার কেন্দ্রীয় আহমদিয়া মসজিদে হামলা।
৮ অক্টোবর ২০০৪ নারায়ণগঞ্জের আহমদিয়া মসজিদে হামলা।
২৮ অক্টোবর ২০০৪ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর মসজিদে হামলা। আহত ১১।
১১ মার্চ ২০০৫ বগুড়া আহমদিয়া মসজিদে হামলা এবং পুলিশ কর্তৃক বেআইনি সাইনবোর্ড স্থাপন।
১৭ এপ্রিল ২০০৫ সাতক্ষীরার সুন্দরবন আহমদিয়া মসজিদে হামলা। নারী এবং শিশুসহ কিছুসংখ্যক আহত।
২৪ জুন ২০০৫ ব্রাহ্মণবাড়িয়া আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা।
২৯ জুলাই ২০০৫ জামালপুরের সরিষাবাড়ী আহমদিয়াদের ওপর হামলা।
১৫ আগস্ট ২০০৫ ভাদুঘর আহমদিয়া আবাসিক এলাকায় বোমা হামলা। এক মহিলা বাম হাত হারান।
২৩ ডিসেম্বর ২০০৫ ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদে হামলা।
১৭-১৮ জানুয়ারি ২০০৬ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহমদীয় বিধবার দাফনে বাধা প্রদান।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ময়মনসিংহের ধানিখোলা মসজিদে হামলা।
২০ মার্চ ২০০৮ দিনাজপুরের বৈরাগী বাজারে আহমদিয়া পাঠাগারে হামলা।

মওলানা আব্দুল আউয়াল খান চৌধুরী
বাংলাদেশে যখনই আহমদিয়া বিরোধী আন্দোলন করানোর চেষ্টা করা হয়েছে মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে, জামায়াতে ইসলামীদের পক্ষ থেকে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যম সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে।
(২০০৫ সালের ২১ এপ্রিল শাহরিয়ার কবির এবং বিচারপতি এম সোবহান সাতক্ষীরার আহমদিয়া জামাতের সদস্য রহিমা খাতুনকে হাসপাতালে দেখতে এসেছেন। এই সাক্ষাৎকারটি ধারণ করেছে ‘এম টি এ ইন্টারন্যাশনাল’।)
রহিমা খাতুন : এই মৌলবাদীরা তো মসজিদে শুধু পোস্টার লাগানোর জন্য যাচ্ছে না, এরা মা-বোনদের ইজ্জত, জানমাল হরণ করার জন্য যাচ্ছে। আমাদের বালবাচ্চা যেন শান্তিপ্রিয়ভাবে এদেশে ইসলাম নিয়ে বসবাস করতে পারে।
শাহরিয়ার কবির : এর বিচার হবে।
রহিমা খাতুন : আমরা তো অনেক ক্ষুদ্র। পিঁপড়ের মতো ওরা পিষে ফেলবে।
শাহরিয়ার কবির : আমরা সারা দেশের মানুষ আছি আপনাদের সঙ্গে। সারা দেশের মানুষ বর্বর হয়ে যায়নি। দুনিয়ার মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছে।

লর্ড এরিক এভবরি
ভাইস চেয়ারম্যান, সর্বদলীয় মানবাধিকার কমিটি, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট
তার পরও আশাবাদী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটা নির্ভর করছে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর। বিশেষভাবে যারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন। আরো নির্দিষ্টভাবে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি যারা বিশ্বাসী। তাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বর্ণবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে লড়বার জন্য। একটু আগে নিচের তলার মসজিদে আমি যেমন বলেছিÑ সকলের জন্য ভালোবাসা, কারো প্রতি ঘৃণা নয়। এটা শুধু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় শিক্ষার ভেতর সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, এ বিশ্বাস সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। আপনারা যদি এ বিশ্বাস ধারণ করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যাবে।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী
বাংলাদেশ যে প্রত্যাশিতভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না তার একটা বড় কারণ হচ্ছে জঙ্গি-মৌলবাদ। এই জঙ্গি-মৌলবাদ নানাদিক থেকে আমাদেরকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের মাদ্রাসায় যেভাবে জঙ্গি-মৌলবাদকে বিকশিত করা হয় সেটা দেশের অগ্রগতির পথে একটা বড় বাধা।

হাসান রফিক
মাদ্রাসা শিক্ষার কারণে আমরা ভীষণ একটা অন্ধত্বের মধ্যে আছি। জীবনের অর্ধেকটা সময়, আমাদের মূল্যবান যৌবনখানা আমি যে শিক্ষার মধ্যে কাটিয়ে দিলাম তাতে কি শিখলাম? প্রথমে ওখানে শিখলাম অন্ধ শিক্ষা। তারপর শিখলাম জিহাদ।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী
আমরা যে শিক্ষানীতি সম্প্রতি প্রণয়ন করেছি তাতে আমরা এই জিনিসটার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা প্রাথমিক পর্যায়েÑ যেটা এখন আছে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কিন্তু আমরা সুপারিশ করছি যে, এটা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নেয়া হবে। এই ধারাতে মাদ্রাসা শিক্ষা বলে কোনো আলাদা রকম কিছু শিক্ষা থাকবে না। এই পর্যায়ে একমুখী শিক্ষা হবে। যার একটা লক্ষ্য হবে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া যায়, একটা বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়া যায়, একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়া যায়।

মুনতাসীর মামুন
উপমহাদেশে জঙ্গি-মৌলবাদের যে বিস্তার আমরা দেখছি তার পেছনে একটি মাত্র দেশই সম্পূর্ণভাবে দায়ী, তার নাম হচ্ছে পাকিস্তান। আমি যদি আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলি তবে বলতে হবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং পাকিস্তানের সমরতন্ত্র। এ দুটো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশে আইএসআইয়ের তৎপরতার কথা আমরা জানি। কেননা, ১৯৭১ সালের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই তারা এ কার্যক্রম শুরু করেছিল। এবং এখানেও আমরা দেখছি সমরতন্ত্রের সঙ্গে জঙ্গিবাদের একটা সংযোগ আছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহজেট সরকারের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্তের প্রতি ১৫ জানুয়ারি ২০১০ ঢাকায় জামায়াত ও সহযোগী মৌলবাদীদের বিক্ষোভ।
জামায়াত নেতা : শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি চলবে, নাস্তিকবাদী রাজনীতি চলবে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতি চলবে আর মুসলমানের রাজনীতি চলবে নাÑ এটা হতে পারে না।
জামায়াত নেতা : এদেশে যতদিন পর্যন্ত মুসলমানরা থাকবে ততদিন পর্যন্ত এদেশে ইসলামী রাজনীতি থাকবে, থাকবে, থাকবে। কোনো শক্তি তা প্রতিহত করতে পারবে না।

হাসান রফিক
ইসলামের রাজনীতি যতদিন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হবে না ততদিন পর্যন্ত এ জিহাদ বা জঙ্গিবাদের নামে জটিলতাগুলো বন্ধ হবে না।

মুনতাসীর মামুন
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্ম এসেছে। ইসলাম এসেছে, খ্রিস্টান ধর্ম এসেছে, বৌদ্ধ ধর্ম এসেছে আর সনাতন ধর্ম তো ছিলই। একেক সময়ে একেক ধর্মের বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু পাশাপাশি সব ধর্মই একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে এবং রাজন্যবর্গেরাও ধর্মের ব্যাপারে সেইভাবে হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু উনিশ শতকের দিকে যখন শুদ্ধিকরণের বিষয়টি এলো এবং সেই ওহাবী আন্দোলনের সূত্র ধরেই কিন্তু এখানে ইসলাম শুদ্ধিকরণের আন্দোলনটা হয়েছে। মজার বিষয় যেটা অনেকে জানেন না যে, এই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের বিপরীতে কিন্তু তৃণমূল পর্যায় থেকে সবসময় প্রতিরোধ হয়েছে।
এমন মানব সমাজ কবে সৃজন হবে, যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে। এমন মানবসমাজ কবে সৃজন হবে...
কুষ্টিয়ার লোকগায়ক নিজামউদ্দিনের গান শুনে মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন আহলে হাদিসের প্রধান তাকে দলে এনেছিলেন জিহাদের গান গাওয়ার জন্য।

ওখানে থাকতে গিয়ে আপনি কি কোনো জিহাদী গান লিখেছিলেন, গেয়েছিলেন?
নিজামউদ্দিন : ওখানে থেকে অনেক গান আমি লিখেছিলাম এবং ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি গান গাইতাম। যেমন : ‘আয় ওরে ছুটে আয়, মুক্তির গান গায়, ছুটে ছুটে আয় ওরে আয় মুজাহিদ আয়।’
কীভাবে আপনি বুঝলেন যে, আহলে হাদিস জঙ্গি সংগঠন?
নিজামউদ্দিন : আমি তাদের যে কার্যকলাপ দেখলাম তাতে তাদের জঙ্গি কর্মকা-গুলো যেন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তারা সঠিক দ্বীন-ই কথা থেকে একটু বাঁকা করে অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। যেমন বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের লোকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেখতে লাগলাম। তখন দেখলাম যে, না এখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। আমি থাকব না।

জঙ্গি- মৌলবাদীদের ইসলামবিরোধী কর্মকা- সম্পর্কে জানতে পেরে নিজামউদ্দিন ফিরে এসেছেন তার মূল জায়গায়, সূফী সাধক লালনের দেশে। যে দেশ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবতার গর্বিত উত্তরাধিকার।
নিজামউদ্দিনের কণ্ঠস্বরে লালনের গান : সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে? সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন বলে জাতির কি রূপ আমি দেখলাম না দুই নজরে, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে...


সপ্তাহের বাংলাদেশ সাপ্তাহিক এ পূর্বপ্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১২ রাত ১১:৩৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×