ইতোমধ্যে সবার অগোচরে একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে। ঘানা'র সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধী'র স্টাচ্যু অপসারণ করা হয়েছে। অভিযোগ বর্ণবাদ। গান্ধী বর্ণবাদি মানুষ ছিলেন।
আসলেই কি শুধুই গান্ধী। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি ঘরই বর্ণবাদের সূতিকাঘার। আর সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের আগাগোড়া মানচিত্রটাই হলো ফেয়ারন্যাস ক্রীমের সবচেয়ে বড় বিলবোর্ড । কী ভয়ঙ্কর নাম ফেয়ারনেস ক্রীম !! মানে- গায়ের রং ফর্সা হওয়াটাই ফেয়ার আর বাকি সব আনফেয়ার। সিলেটের প্রচলিত কথা- মেয়েটির গায়ের রং ময়লা। ময়লা মানে আবর্জনা।
একবার এক অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার বাংলাদেশ ঘুরে আমার বাসায় এসেছিলেন। বলেছিলাম- আমাদের দেশে কী দেখে সবচেয়ে ভালো লাগলো?
উনি বলেছিলেন- ভালো অনেক কিছুই লেগেছে। তবে অবাক হয়েছি- বিশাল বিলবোর্ডে মানুষকে ফর্সা করা ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখে।
বিউটি বিষয়ক একটা অনুষ্ঠানে এক বড় সেলেব- ছেলেদের পাত্রী দেখার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন- মেয়েদের প্রথমে মুখ না দেখে পা দেখার। কারণ-মুখ ম্যাকআপ করে ফর্সা করলেও -বেশিরভাগই পা ফর্সা করেনা। তাই, বিয়ে করার পর-আর পস্তাতে হবেনা। পাত্রী পছন্দের প্রথম ইশতেহার হলো - রং ফর্সা। বুঝুন বর্ণবাদ শুধু চোখের দেখায় নয়-মানুষের মগজে মগজে পৌঁছে গেছে।
ভারতের অনেক ধনী অধিবাসীরা- ফর্সা দেবীর আর গরীবরা কালো দেবীর উপাসনা করে। খ্রীষ্টানদের অবস্থা আরো গুরুতর। এখন চলছে-খৃসমাস মৌসম। পূণ্যার্ত বয়ে আনা ওদের স্বর্গীয় দেবতা শান্তাক্লস একেবারে ধবধবে ফর্সা। কারণ - শুধু রক্ত মাংসের নারী না দেবতারও কালো হওয়া পাপ।
কয়েকদিন আগেই একটি বিয়ে বাংলা ফেসবুকের দুনিয়া তোলপাড় করেছে। কারণ- পশ্চিমের এক শ্বেত ললনা বাংলার এক কালো আদমিকে বিয়ে করেছে। কালো কোনো পশ্চিমা ললনা যদি এই কালো আদমিকে বিয়ে করতো তাহলে হয়তো এতো তোলপাড় হতোনা। সাদারা আমাদের যতনা ঘৃণা করে-আমরা কালোদের তারচেয়েও বেশী ঘৃণা করি। বর্ণবাদ আমাদের মগজে মগজে, ধমনীতে ধমনীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
বর্র্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি মার্টিন লুথার কিং এর শহর আটলান্টার ফোবানা আসরে- শিল্পী মমতাজ গান ধরেছেন। "আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেলোরে- মরার কোকিলে"। গানের ফাঁকে ফাঁকে উনার আবার আলাপন করার অভ্যাস আছে। পাশে ছিলো এক কালো সিকিউরিটি অফিসার। উনি কালো লোককে দেখিয়ে বললেন- আমাদের দেশের কোকিল -এই কাইল্লার চেয়েও কাইল্লা। বাংলাদেশের আইন প্রণেতা মমতাজের বোধের বাইরে- বর্ণবাদের শাস্তি এই দেশে কতটা ভয়াবহ। মমতাজ বেঁচে গেছেন। কালো সিকিউরিটি অফিসার উনার কথা সেদিন বুঝতে পারেন নি। নাহলে বিশাল একটা বেইজ্জতি হতো।
কালো মানুষদের আমরা অতি তুচ্ছার্থে বলি- কাউল্লা। সেদিন রমজান মাস ছিলো। মসজিদে কালো মানুষের আনাগোনা একেবারে বেশি না হলে, তেমন কমও না। তারপরও নামাজ শেষে জনৈক কালোফোবিয়া অধ্যাপক এক লোককে দেখে বললেন-"এই কাউল্লা এখানে কী করে?'
অধ্যাপকের কথা শুণে লোকটা বিনয়ের সাথে বলেছিলেন- ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বিলাল মসজিদে যাই করে-আমিও এখানে তাই করি।
কাউল্লা শব্দটি আমরা এতো বেশি ব্যবহার করি। অনেক কালো লোকই এখন এর অর্থ বুঝে।
পবিত্র ঘরের চেয়েও সবচেয়ে পবিত্র হলো মানুষর মন। আবার পুঁতি দূর্গন্ধময় নর্দমার চেয়েও নোংরা হলো এই মানুষের মন। রুমি বলেছিলেন- সারা জীবন নিজের চেহারা ঘষেছি। অথচ, একবার আয়নাটা পরিষ্কার করলে- নিজের আসল চেহারাটা দেখতে পেতাম। আয়না-বলতে রুমি নিশ্চয়ই মনের আয়নাই বুঝিয়েছিলেন। মন পরিষ্কার করুন। কালো , ধলো সবাইকেই সুন্দর দেখতে পাবেন। ঘানায় গান্ধীর স্ট্যাচু অপসারণের সাথে সাথে আমাদের মননে বয়ে নেয়া বর্ণবাদের বিষাক্ত বিলবোর্ডও আজ ভেঙ্গে ফেলার সময় এসে গেছে।
“Achievement has no color.” –Abraham Lincoln
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৭:৪৭