''মানুষের জীবনটা একটা দোতলা ঘরের মত। জনৈক লেখক বলেছেন এই ঘরের একতলা বা নিচতলা হচ্ছে জীবসত্তা আর দোতলা বা উপরের তলা হচ্ছে মানবসত্তা। আমার কাছে জীবসত্তা হচ্ছে জীবনের চিরায়িত অবস্থা অর্থাৎ জীবনের যে অবস্থা মানুষ জন্মগত ভাবে লাভ করে আর উপরের তলা হচ্ছে জীবনের কাঙ্ক্ষিত অবস্থা যা অর্জন করতে হয়। পরিশ্রম আর কষ্টই যার পূর্বশর্ত। ঘরের দোতলায় মানুষ যেমন এক লাফে উঠতে পারেনা প্রতিটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উঠতে হয় তেমনি জীবন নামক ঘরটার দোতলায় উঠতে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ঘরের সিঁড়ি তৈরি হয় ইট, পাথর, বালু আর সিমেন্ট দিয়া কিন্তু জীবন ঘরের সিঁড়ি হচ্ছে শিক্ষা, সততা আর পরিশ্রম। আমিও একজন মানুষ। আর আট দশ জনের মত আমারও হৃদয়ে আছে জীবন ঘরের দোতলায় উঠার বাসনা। আমিও চাই জীবনের কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে উঠে আসতে। আর সেই জন্যে বল্গা হরিণের মত ছুটে চলা জীবনে আমারও এই পথ চলা।
আজকের দিনটা আমার জীবনে স্বরণীয় হয়ে থাকবে। আজ আমি জীবন সিঁড়ির আর এক ধাপে পা রাখলাম। জীবনের বিনিদ্রি মুহূর্ত গুলোয় স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠার মত একটা আনন্দ স্মৃতি। এই আনন্দের মাঝে কোথায় যেন একটা দুঃখ হামাগুরি দিচ্ছে। কী সেই দুঃখ? না! আনন্দের দিনে আনন্দ দিয়েই শুরু করি। আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম। কলেজের আঙ্গিনাকে বিদায় জানিয়ে নুতুন ঠিকানা খুজে নিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। একদিন এই ক্যাম্পাস কেও বিদায় জানাতে হবে। আমার বাবা নিজে উচ্চ শিক্ষিত না হলেও সন্তানদেরর উচ্চ শিক্ষিত করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। তিনি সন্তানদের এমন অবস্থানে আনতে চান যেখানে সন্তানদের সাফল্যে বাবার না পাওয়ার গ্লানি ঢেকে যাবে। তাইত বাবা বরাবরই আমাদের লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন অত্যান্ত যত্নবান। বাবা আমাদের নিয়া স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন তার সন্তানদের। বাবার সেই স্বপ্নের রুপকার আমরাও ছিলাম বদ্ধ পরিকর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে। আমি আর আমার একমাত্র সহদর। এই মিলে আমরা। সেও এক এক করে শিক্ষা জীবনের সাতটা ক্লাস অতিক্রম করে এখন অষ্টমে পা রেখেছে।
ছাত্র হিসাবে মাধ্যমিক পর্যায়ে খারাপ ছিলাম না। বরাবরই প্রথম হতাম। একবার দ্বিতীয় হয়েছিলাম। বাবা অনেক রাগ হয়েছিল আবার সান্তনাও দেয়েছিল। মনে মনে একটা ক্ষোভ জন্মেছিল। পরের বছর ঠিকই প্রথম হই। তবুও এত কষ্ট এত স্বপ্ন যেন কোন কাজই আসলো না। একটা প্রবাদের মত সব সাফল্য শেষ ব্যার্থতার চাঁদরে ঢেকে যায়। শেষ ব্যার্থতা! এস.এস.সিতে খারাপ করি। অবশ্য দায়টার সিংহ ভাগ আমার কপালের। পরীক্ষার মাঝে অসুস্থতা সঙ্গী হলো। কী আর করা সেই সঙ্গীকে নিয়েই পরীক্ষা দিলাম। তারপরও ফলাফলে অসুস্থতার কাছে পরাজিত হইনি।
ছোটবেলা থেকে বাবা তার আদরের পাশাপাশি শাসনটা সহ অবস্থানে রাখতেন। আর সেটাই জীবন যুদ্ধের বড় অস্ত্র মনে হয়। বাবা সবসময় চাইতেন তার সন্তান যেন নিয়ম শৃঙ্খলার মাঝে বড় হয়। তাইত শত কষ্ট হলেও সেরকম এক কলেজে আমাকে ভর্তি করতে ভোলেননি। শুরু হলো নুতুন যুদ্ধ। আমি বনাম কান্টপাবলিক কলেজ। বাবা ছিল মিত্র। জেতার স্বপ্ন দেখাতেন। স্বপ্ন দেখাতেন এগিয়ে যাওয়ার। একটু হতাশ হলেই উৎসাহ দিতেন। অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করলাম। আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন প্রদীপ্তের শিখা একটু উজ্জ্বল হল। কিন্তু বাবার সেই স্বপ্ন প্রদীপকে এক দুঃচিন্তের চাঁদর সব সময় ঢেকে রাখত, আবার যদি ভাগ্য আমার প্রতিকুলে যায়? বাবা তার প্রতি মুহূর্ত কঠোর পরিশ্রম করত আমার জন্য। আমার জন্য নিজের সুখ গুলো ছিল তুচ্ছ। আর মা? তার কথা লিখতে শুরু করলে পৃথিবীতে খাতা কলমের সংকট দেখা দিবে। তাছাড়া মায়ের ভালবাসা লিখে পরিমান বোঝানো যাবে না বরং তাতে তাকে অসম্মান করা হবে। তবু মমতাময়ী মায়ের মমতার স্মৃতি সমুদ্রের একটা স্মৃতি আজও হৃদয়ে নাড়া দেয় আর সারা জীবন দিয়ে যাবে।
তখন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বাবা দশ পনের দিন পরপর আমকে দেখতে যেতেন আর সঙ্গে নিয়ে যেতেন নানান খাবার আর নাস্তা। সেবার বাবা যখন আসে তার কয়েকদিন আগে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে মা বুঝতে পারে আমার কাছে টাকা নাই। তো বাবা যখন আসলো বরাবরের মত সাথে খাবারের ব্যাগ। একটা নাস্তার ব্যাগ খুলে দেখি মা মুড়ির সাথে কাগজে মুরিয়ে বেশ কিছু টাকা দিয়েছে। কারন মা জানত বাবা আমাকে হিসাব করে টাকা দিবে। অথচ ভাবিনি মা এভাবে আমার জন্য টাকা পাঠাবে। আমার কোন সাফল্য ছিল বাবা মায়ের কাছে সান্ত্বনার বাণী। ভুলে যেতেন শত কষ্ট। ভাবতেন এবার হয়ত ভাগ্য আমার পক্ষেই থাকবে। অবশেষে বাবার দুঃচিন্তের চাঁদর খুলে স্রষ্টার কৃপায় সুস্থ ভাবে অংশ নিলাম এইচ.এস.সিতে। দেখিয়ে দেলাম নিজের কৃতিত্ব। একটা সন্তোষজনক ফলাফল নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালাম। বাবা অনেক খুশি হল। বাড়িয়ে দিলেন তার উৎসাহের পরিমান। বাবার উৎসাহে নিজের অনুপ্রেরণাও বেড়ে গেলো।
ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে কোচিং শুরু করি। এখনো বাবা সন্তানের সোনালী ভবিষৎ গড়তে করে যাচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রম। আমিও চেষ্টা করি বাবার কষ্টে নিজেকে জড়াতে। খুব ভাল লাগে। মনে হয় মা বাবা আর ছোট ভাইটাকে নিয়েই আমার পৃথিবী। ভর্তি যুদ্ধের শুরুতে ব্যার্থ হই। বাবার মনে দুঃচিন্তার কাল মেঘ ছেয়ে যায়। আমার সন্তান কী জীবন যুদ্ধে হেরে যাবে? এটাই যেন বাবার মনে বারবার ঘুরপাক খায়। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমাকে যে জিততে হবে। নয়ত আমার স্বপ্ন গুলো, বাবার স্বপ্ন গুলো আমাকে ক্ষমা করবে না। বাবার কাছে কোন মুখে দাড়াব?
শেষ পর্যন্ত আমি জিতে যাই। বাবার মুখে হাসি ফোঁটে। ফিরে আছে জীবনের প্রানবন্ততা। হ্যাঁ নিজের পরিশ্রম, বাবার অনুপ্রেরণা আর স্রষ্টার কৃপায় আমি জীবন যুদ্ধের সিঁড়ি খুঁজে পাই। জায়গা করে নেই শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের একজন ছাত্র। আজ আমি গর্বিত। বাবাও আজ বড় সান্তনা পেল তার সন্তান জীবন যুদ্ধের সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছে। এই আনন্দে উদ্বেলিত আমার মন। আর দুঃখ? তাত প্রকৃতির নিয়মের কাছে পরাজিত হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে গত কাল পর্যন্ত নিজেকে কলেজ ছাত্র হিসাবে পরিচয় দিতাম। আজ আমার সেই অধিকার নেই। আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এখন এটাই আমার পরিচয়''।
ধন্যবাদ কষ্ট করে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার লেখাটা পড়ার জন্য।
আমার বাবা মায়ের জন্য দোয়া করবেন।
সবাই ভাল থাকবেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




