আমি জানি মা সবার কাছেই স্পেশাল, কিন্তু আমাদের জীবনে আমার মায়ের ভূমিকা কোনভাবেই বুঝানো যাবে না. এটাও বুঝতে পারব না কেউ কেউ কেন একজীবন তার ছেলেমেয়ের পিছনেই কাটিয়ে দেয়, পারে কিভাবে? কিসের প্রত্যাশায়? আজ যখন, ফিরে তাকায় পিছনে, কখনো কি আফসোস হয়? এই যুগে যেখানে সব কিছুই টাকার অংকে বিচার হয়. কিন্তু মা তোমাকে কিভাবে টাকার অংকে বিচার করবো? তুমি কি মাইন্ড করবেনা এ যুগের ছেলেমেয়েদের অবিমৃষ্যকারিতায়!
আমরা ছিলাম ৬ ভাই ২ বোন (আমার বাবা বোধ হয় জন্ম নিয়ন্ত্রনে বিশ্বাস করতেন না ডাক্তার হওয়া সত্বেও)। এক ভাই তরুণ বয়সে চলে যাওয়ায় আমরা এখন ৫ ভাই ২ বোন। মজার ব্যাপার হলো আমাদের প্রত্যেক ভাই বোনের বয়সের ব্যবধান মাত্র ২/৩ বছরের যার মানে আমার সবচেয়ে বড় ভাই এবং সবচেয়ে ছোট বোনের বয়সের ব্যবধান ২০ বছরের মত।
আজকে যখন আমার ভাবি বা অন্যানোদের ১/২ বাচ্চা নিয়ে সংগ্রাম করতে দেখি তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না মা কিভাবে এই দুই হাতে এতগুলো পিঠাপিঠি ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন, সংসার সামলেছেন। তিন বেলা খাইয়েছেন, স্কুলে পাঠিয়েছেন, গোসল করিয়েছেন, কাপড় চোপড় ধুয়েছেন। যখনি চিন্তা করি তখনি আমার মাথা শ্রদ্ধায় নুয়ে আসে। শুধু তাই না, আমার ছোট ভাই যার ঘর পালানো রোগ ছিল, তার জন্য প্রায় দেখতাম মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন, যখনি সময় পেতেন। কি দেখতেন জানিনা, তবে দেখতাম ডাকলেও উনি আসতেন না, বারান্দায় ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমাদেরকে ঘুমাতে বলে। যার সংসার শুরু হয়েছিল ১৫ বছর বয়সে, যে দুনিয়ার তখনো কিছুই দেখেনি, যার স্বামীর মাসিক উপার্জন ছিল ১৫০০-৩০০০ টাকা (১৯৭৫-৯০) তিনি কিভাবে এই দুই হাতে এত কিছু করেছিলেন আমার কিছুতেই মাথায় আসে না।
বাবা নৌবাহিনী তে নন কমিশন অফিসার ছিলেন। স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে আগেই অবসর নিতে হয় ১৯৮৮ সালে। তখন আমি পড়ি পঞ্চম শ্রেণীতে। আমরা কলোনি তে থাকতাম, আমাদের যাবার কোনো জায়গা ছিল না। মামারা পরামর্শ দিয়েছিলেন গ্রামে চলে যেতে আমরা afford করতে পারব না বলে। এটাও বলেছিলেন আমাকে যেন পড়াশুনা থেকে না ছাড়ায় (কিঞ্চিত বোধ হয় ভালো ছিলাম), হয়তো মনে করেছিলেন বাকি দের দরকার নেই। কিন্তু আমার মা যিনি সারা জীবন শহরে থেকেছেন, যিনি এত কষ্ট করে এতদূর এসেছেন, তিনি রাজি হননি। বাবা কে বললেন আমি যাব না, ছেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে, ওদের পড়াশুনা হবেনা । শুধু মায়ের পিঁড়াপিঁড়িতেই বাবা শহরে থেকে যেতে রাজি হলেন (এর কিছুদিন আগেই বাবা একটা ফার্মেসি দিয়েছিলেন, ঠিক হয়েছিল উনি একাই থাকবেন শহরে বাকিরা গ্রামে চলে যাবে)। এর ফলাফল হলো ভয়াবহ । শুরু হলো মানবতর জীবন যাপন। দুই রুম এর একটা বাসা ভাড়া নেয়া হলো. আমরা দুই খাটে বাবা মা সহ ৭/৮ জন ঘুমাতাম। তখন আমরা সবাই বড় হচ্ছি, আমাদের জামা গুলো ছোট হয়ে আসছে এই অবস্থায় ৫ জন এক খাটে ঘুমানো কি যে কঠিন ছিল তা বুঝানো যাবে না। মাঝে মাঝে মা নিচে ঘুমাতেন (নিচেও তেমন একটা জায়গা ছিল না), অথবা আমাদের পায়ের নিচে ঘুমাতেন. কতবার যে ঘুমের ঘোরে মাকে লাথি দিয়েছি মনেও করতে পারি না।
চলবে