মা যে কিভাবে সংসারটা সামলেছেন জানি না। আমরা কি পরিমান দরিদ্র ছিলাম তার উদাহরণ দেই। আমার মনে পড়ে, আমরা একটা ডিম দিয়ে সবাই মিলে ভাত খেয়েছি, মনে পড়ে মা সবসময় চাল ডালের খাকি প্যা কেট গুলো রেখে দিতেন যাতে ঐগুলা দিয়ে স্কুলের খাতা বেঁধে দিতে পারেন। বলাই বাহুল্য আমরা সব সময় খোলা নিউজপ্রিন্ট কাগজ কিনতাম, সাদা কাগজ বা রেডিমেড খাতা কিনার মত সামর্থ ছিল না। মনে পড়ে কতদিন যে বসে থাকতাম কবে মা চার আনা পয়সা দিবে, আইসক্রিম খাব। নারিকেল ওয়ালা আইসক্রিম খুব প্রিয় ছিল, মা যে কতদিন বলতেন ঐগুলা পচা নারিকেল, আর আমরা মায়ের উপর রাগ করতাম, এখন বুঝি মায়ের হাতে দেবার মত পয়সাই হয়তো ছিল না। আমাদের বাঁধা টিফিন ছিল আটার রুটি (রেশনের) আর চিনি. আমরা লুকিয়ে খেতাম যাতে কেউ দেখতে না পায়।
মা হাতের কাজ খুব ভালো পারতেন। আমাদের বাসার দেয়ালে মায়ের হাতের সূচিকর্ম থাকত, 'মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত' অথবা 'তোমাকে ভালবাসি' আর নিচে ছোট্ট করে লিখা থাকত 'টুনু'....আমার মায়ের ডাক নাম। এত সুন্দর নামে মামারা যখন ডাকতেন তখন কতো যে ভালো লাগতো। আমাদের বেশির ভাগ জামাই মা বানিয়ে দিতেন। ঈদ এর জামা কিনার মত টাকা ছিল না, তাই বেশির ভাগ সময় ঈদ এর আগের রাতগুলো মা জেগে জেগে সেলাই করতেন। কতো ঈদ গিয়েছে আমরা কয়েক ভাই পেয়েছি ঈদ এর জামা, বাকিরা পায় নি। সব কিছু সামলে মা হয়তো সময় করে উঠতে পারতেন না বা হয়তো বানানোর মত কাপড় ছিল না। আমাদের গায়ে দেয়া সব কাঁথার কারিগরও মা। কিন্তু অনেক বড় বড় করে সেলাই করতেন, এত কিছু সামলে সময় পেতেন না। মনে আছে আমি যখন প্রাইমারী স্কুল ছেঁড়ে যখন নতুন স্কুলে গিয়েছি, তখন একটা ব্যাগ সেলাই করে দিয়েছিলেন, টুকরো কাপড় দিয়ে, অনেকেই দেখে ভ্রু কুঁচকে ছিল।
কোনো কিছুই মা ফেলতেন না, কি জানি কখন কি কাজে লাগে। এজন্য আমাদের খাটের নিচ গুলো ছিল অনেক কিছুর গোডাউন। আজকের যুগে রিসাইকেল, রিইউজ এর এত কথা বলা হয় আমার মাকে তার সব কিছুই করতে দেখেছি। এটা বুঝতে পারতাম যে গরিবের সংসারে কোনো কিছুই ফেলতে নাই, এই কথাটি মা শিখেছিলেন। তাই খাটের নিচে পুরানো জিনিসগুলো মা যে কতো কিছু বানাতেন। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতো আমাদের স্যান্ডেল হতো সবসময় এক সাইজ বড়, কখনই ছোট বয়সে পায়ের মাপের ই স্যান্ডেল পড়তে পারি নি। তবে তার চেয়েও মজার ব্যাপার ছিল আমাদের জামা. জামার তুলনায় আমরা বড় হয়ে গেলেও মা কখনো ঐগুলো ফেলে দিতেন না, পাইপলাইনে যে আরো অনেকগুলো আছে। এই ক্ষেত্রে আমার বড় ভাই অনেক ভাগ্যবান ছিলেন। জামা ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত এরকম চলতো। আর অল্প ছিঁড়ে গেলে মা রিপু করে দিতেন, স্যান্ডেল এই জিনিসটা মা খুব ভালো পারতেন। অল্প জিনিস কে কিভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় তা মা ওই বয়সে বেশ ভালোভাবে শিখে গিয়েছিলেন।
চলবে