“ফরমান আলী দেখেছেন এবং দেখে দুঃখ পেয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধর্মীয় আচরণ করে ঠিকই, কিন্তু রাজনীতির ব্যাপারে তাঁরা সেকুলার । সংস্কৃতিতে ভাষার গুরুত্ব বিষয়ে তিনি সচেতন ; তবে শহীদের মাজারে মিলাদ, মোনাজাত এসব না করে হিন্দুরীতিতে ‘ ফুল দিয়ে পূজা করা’ দেখে তিনি ক্ষুব্ধ।“
২০১৭ সালের একুশে বইমেলাতে প্রকাশিত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত “একাত্তরের যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের পরীক্ষা” বইটি মূলত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ বনাম বাঙালী জাতীয়তাবাদ এর ভিত্তিতে রচিত, যেখানে অবাঙালি পাকিস্তানপন্থী ও বাঙালি পাকিস্তানপন্থী এ দু ধরণের লোকদের একাত্তর পূর্ববর্তী ও একাত্তরের যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড ও তাঁদের মনোভাব কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে । পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহীনির ডেপুটি মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর এবং গভর্নরের সিভিল এফেয়ারস উপদেষ্টা ; রাও ফরমান আলির প্রসঙ্গটিও তাই চলেই এসেছে একজন অবাঙালি পাকিস্তানপন্থী হিসেবে ১৯৭১ এ তাঁর বাঙালি গণহত্যা, বিশেষত বেছে বেছে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে । এই রাও ফরমান আলির ১৯৭১ পরবর্তীতে লেখা একটি বই র্য়েছে যেটার বাংলা অনুবাদে নাম হচ্ছে “ ভুট্টো শেখ মুজিব বাংলাদেশ” । উপরের প্রথম প্যারাগ্রাফটি লেখক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ফরমান আলির সেই বইটির লেখার উপর ভিত্তি করেই লিখেছেন। লেখক জানাচ্ছেন যে, রাও ফরমান আলীর লেখা সেই বইটি পড়লে ফরমান আলীর রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায় যা কিনা ডানপন্থী জামায়াতঘেষা চিন্তাধারা।
১৯৭১ এর পর পাকিস্তান এ বিষয়ে হামিদুর রহমান কমিশন গঠণ করে এবং এই কমিশন পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্য দায়ী কিছু মানুষকে চিহ্নিত করে কেবল, সামগ্রিকভাবে এটি যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অন্যায্য অন্যায় পাশবিক আগ্রাসন ছিলো সেটি স্বীকার করেনি। ফলে রাও ফরমানের মতো ধূর্ত পাষণ্ডরা এই কমিশনের কাছে নিজেদের উপর আরোপিত সমস্ত অপরাধ মিথ্যা দাবী করে পাড় পেয়ে গেলেও অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমান জেনারেল নিয়াজী এই কমিশনের চোখে হয়ে ওঠে প্রধান ভিলেন যাকে একজন অদক্ষ, কাপুরুষ ও চরিত্রহীন সেনাপ্রধান রূপে ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু ২৫ মার্চের গণহত্যার পরিকল্পক টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী এভাবে তিরস্কৃত হন না কমিশনের কাছে । উল্টো কমিশন উল্লেখ করে যে রাও ফরমান আলী যুদ্ধকালীন সময়ে গভীর আন্তরিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করেছেন । আরেকটি মজার কিংবা দুঃখের বিষয় হল এই কমিশনের প্রধান ছিলেন জাতে একজন বাঙালী যিনি অবাঙালি পাকিস্তানি কর্তাদের আস্থা অর্জন করে পাকিস্তানি সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন।
যারা নিয়াজীর “বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান” বইটি পড়েছেন তারা জেনে থাকবেন নিয়াজী এই কমিশনের উপর কতটা ক্ষুব্ধ ছিলো এবং তাঁর দাবী অনুযায়ী পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা ১৯৭১ এর অনেক আগেই আসলে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে আশা ছেড়ে দিয়ে, কোন রাজনৈতিক সমাধানে না পৌছানোর চেষ্টা করে শেষমেশ সেনাবাহীনিকেই সব বদনামের দায় নেবার জন্য সামনের দিকে ঠেলে দেয়। তাঁর দাবী অনুযায়ী রাও ফরমান আলী ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে ছিলো । কারন সে জানতো যেহেতু সে প্রচুর বাঙালী হত্যার মূল পরিকল্পনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাই পূর্ব পাকিস্তানে সে অবস্থায় বাঙালিদের হাতে রাও ফরমানের জীবন একদম নিরাপদ নয়। তাই সে নিয়াজিকে তখন অনুরোধ করে তাঁর পোস্টিং তখন পশ্চিম পাকিস্তানে করে দেবার জন্য। অন্যদিকে রাও ফরমান আলী উল্টো নিয়াজীকে একজন ছিঁচকাঁদুনে জেনারেল হিসেবে আখ্যা দেয় যে কিনা ৭ ডিসেম্বর থেকেই বাঙালী যোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের ভয়ে মেয়েদের মতো কান্নাকাটি করতো প্রায় ই।
পাকিস্তানি ঐ কমিশন যাই জানাক কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে ১৯৭১ আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার প্রধান কারিগর এই রাও ফরমান আলি। সে সময়ে সিভিল এফেয়ারসের একক উপদেষ্টা হিসেবে যুদ্ধে প্যারা মিলিটারি ভলান্টিয়ার বাহিনী গঠণ করার পরিকল্পনা তাঁর ই ছিল; যার অর্থ যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা রাজাকার, আল বদর ও আল শামস, শান্তি কমিটি এগুলো সব তাঁরই ব্রেইন চাইল্ড । যুদ্ধের শেষে তাঁর অবস্থান থেকে তাঁর যে ডায়রী টা উদ্ধার হয় সেখানে একটি লিস্ট পাওয়া যায় বিভিন্ন বাঙালি বুদ্ধিজীবির নামের । সেই তালিকার বেশীরভাগ কেই ধরে ধরে হত্যা করা হয় , বেঁচে যাওয়াদের কেউ কেউ বাঁচেন ভাগ্যের জোড়ে কেউ কেউ নানা সম্পর্কের জোড়ে। যেমন আলতাফ গওহর, যাকে আইউব খানের আত্মজীবনী “ প্রভু নয়, বন্ধু” এর মূল লেখক হিসেবে মানা হয়; তিনি জানান যে রাও ফরমান আলির ডায়েরি তে একটা হিট লিস্ট ছিলো যেখানে তাঁর এক পরিচিত বাঙালি বন্ধুর নাম ছিলো, ফলে আলতাফ তাকে অনুরোধ করেন যেন সেই নামটি বাদ দেয়া হয় । ফরমান আলি সেই অনুরোধ রেখে সেই নামটি তাঁর ডায়রীর লিস্ট থেকে কেটে দেন।
ফরমানের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভাবনাগুলোর প্রতিফলন ঘটে তাঁর ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন কর্মকান্ডে । যেহেতু শহীদ মিনার কে সে বাঙালির হিন্দুয়ানীর প্রকাশ হিসেবে দেখেছে তাই ২৫ মার্চের আক্রমণের প্রথম পর্বেই পাক সৈন্যরা বাংলা একাডেমী ও শহীদ মিনারে মর্টারের গোলা বর্ষণ করে । তারপরেই ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সদস্যরা ভাঙা শহীদ মিনারকে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সেখানে দোয়া মাহফিল বসিয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অনেক শিক্ষকেরা ও তাঁদের অসংখ্য ছাত্ররা ধর্ম নিরপেক্ষতার সমর্থক ও ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চা করতো। ফরমানের মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের তৎকালীন ছাত্রী থাকার কারনে সেই বাস্তবতা তাঁর জানা ছিলো এবং এই বাস্তবতাটিকে সে ঘৃণা করতো । ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের আরেকটি কেন্দ্রে পরিণত হয় ২৫ মার্চের প্রথম পর্বেই । সিরাজুল ইসলাম জানাচ্ছেন যে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনায় রাও ফরমান আলি বিবেচনাতে যে কেবল আওয়ামী পন্থি লোকদের রেখেছে তা নয়, তাঁর সিলেকশনের মূলে ছিলো এমন গুরুত্ব পূর্ণ বাঙালিদের লিস্টে রাখা যারা স্পষ্ট কিংবা সম্ভাব্য রূপে ধর্ম নিরপেক্ষতা অথবা বাম পন্থী ধারার রাজনীতির সমর্থক । এর ই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এর অক্টোবরে ফরমান আলী আওয়ামী লীগের শূন্য ঘোষিত আসনগুলো সব ইসলামী ডানপন্থী দলগুলোকে দান ক্ষয়রাতের মতো বিলাতে থাকেন । ৭০ এর নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়া জামায়াতে ইসলামকে ইনি দান করে দেন পঞ্চাশটি আসন, নেজামী ইসলামকে দিয়ে দেন পাঁচ আসন।
ফরমান তাঁর বইতে স্বীকার করেন যে ৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম পন্থী সব দলগুলোকে সাহায্য করার জন্য শিল্প পতি / ব্যাবসায়ীদের চাপ দিয়ে সেসময় ২২-২৩ লক্ষ টাকার রাজনৈতিক অর্থায়ন করা হয় কিন্তু দুঃখ জনকভাবে তাতে কোন লাভ হয়না কেননা ইসলামপন্থী রাজনীতি তখন ৫-৬ টি দলে বিভক্ত হয়ে ছিলো। আরো জানা যায় যে আইউব খানের আমলেই পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্যর বেতন চালাতো খোদ আমেরিকা । স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতে গিয়ে যে বাঙালি অবাঙালি মিলিয়ে লক্ষাধিক প্রাণের নাশ হয়েছে যুদ্ধের সেই বাস্তবতাও ফরমান স্বীকার করেছে । এক পর্যায়ে ২৫ শে মার্চের মধ্যরাতের কথা লিখতে গিয়ে সে লেখে;
“ এর পরে কারবালা কাহিনী । … ইস্রাফিল যেন হুংকার দিয়ে উঠলো । ভুট্টো ইয়াহিয়ার চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে আমাদের নেমে পড়তে হলো । পাকিস্তান রক্ষার নামে আমরা দ্রুত অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম এবং দীর্ঘ নয় মাস আমরা অসংখ্য প্রাণ সংহার করেও নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারিনি। শতাব্দীর কান্না বিজড়িত একটি মুহূর্তে জেগে উঠলো একটি জাতি। “
জেগে উঠলো একটি জাতি! হ্যাঁ, ঠিক তাই । গণহত্যার পরিকল্পক , রাজাকার আল বদরের নির্মাতা অবশেষে মেনে নিতে বাধ্য হলো যে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা পাকিস্তানি নয়, তাঁরা আদতে বাঙালী জাতি, যে জাতি তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। সিরাজুল ইসলাম বলছেন যে তাঁর এই স্বীকারোক্তির ব্যাখ্যা কি? ব্যাখ্যা এটাই যে পাকিস্তানি ইসলামি আদর্শপন্থী রাও ফরমান আলীর ভেতরে একটি বাস্তববাদী সত্ত্বা বিদ্যমান। ফলে আদর্শপন্থী তাঁর তথাকথিত আদর্শ রক্ষায় জঘন্যতম পদক্ষেপ গুলোকে বেঁছে নিতে কোন দ্বিধা না করলেও পরবর্তীতে বাস্তব পন্থী সত্ত্বা সময়ের বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেনি। এই বাস্তববাদী সত্ত্বাটি ই তাঁর বুদ্ধির ব্যাবহার করে ১৯৭১ এ বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করতে নারাজ ছিলো। কারন সে জানতো মুজিবকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করার অর্থ দাঁড়াবে পূর্ব পাকিস্তানিদের অপমান করে আরো ক্ষেপিয়ে তোলা যা তাঁদের প্রতিরোধ আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিবে। সে কারনেই পাকিস্তানি সিদ্দিক সালিকের লেখা বইয়ের বরাতে জানা যাচ্ছে যে , ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া যখন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে তখন রাও ফরমান আলি পিন্ডিতে গিয়ে ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্যে কি কি মূল পয়েন্ট রাখতে পারে সেটার একটা খসড়া করে ইয়াহিয়াকে দেয় । সেই পয়েন্ট গুলোর মধ্যে ছিলো যে, শেখ মুজিবকে কোনভাবেই দেশ দ্রোহী হিসেবে প্রচার করা যাবেনা, বলতে হবে যে তিনি চরম পন্থীদের ফাঁদে পড়ে যাওয়া এক দেশপ্রেমিক নেতা যাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনি প্রটেক্টিভ কাস্টডিতে নিয়েছে কেবল, তাকে তাঁরা গ্রেপ্তার করেনি। সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানকে ছয় দফার ভিত্তিতে কতটুকু ছাড় দেয়া যেতে পারে সেটার সম্ভাব্যতা নিয়ে কিছু কথা থাকতে হবে। রাও ফরমানের সেই খসড়া বক্তব্যর একটি পয়েন্ট কেও মেনে চলার কোন প্রয়োজনই যে বোধ করেনি ইয়াহিয়া; সেটার সাক্ষী ইতিহাস।
বাস্তবিক ভাবেই রাও ফরমান শেখ মুজিবর রহমান কে একজন পাকিস্তানি দেশপ্রেমিক মহান ত্যাগী নেতা হিসেবে গণ্য করতো । তাঁর বিবেচনায় আওয়ামী লিগের কিছু চরমপন্থি যেমন তাজউদ্দীন আহমেদ ও পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাকে ভুল পথে ধাবিত করে পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার পরিস্থিতি টি সৃষ্টি করে । সেই সাথে সে পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোর অনেক জঘন্য রাজনৈতিক চালকেও পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার জন্য দায়ী করে । সে বিশ্বাস করতো তাজউদ্দীন আহমেদের পূর্ব পুরুষ হিন্দু আর তাই সে ভারত পূজারী ,অন্যদিকে লীগের খন্দকার মোস্তাক পাকিস্তানের সাথে আপোস পন্থী, পাকিস্তান ভাঙন পন্থী নয় । পাকিস্তানের এক নায়ক আইউব খানকেও সে পছন্দ করেনি কারন সে ইসলাম অনুসারী রাষ্ট্র নায়ক ছিলোনা । সম্প্রতি বাংলাদেশের ডিবিসি চ্যানেলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিবের যে সাক্ষ্যাতকার প্রচারিত হয়েছে সেখানে তাঁর বক্তব্যের সাথে এই রাও ফরমান আলীর ধ্যান- ধারণা, চিন্তা- চেতনা ও বিশ্বাসের বেশ কিছু মিল লক্ষ্য করা যায় । ইহা বোধকরি কোন চমকপ্রদ বিষয় নহে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:১৭