somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'যদি' কথন

০৭ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শর্ত, অনিশ্চয়তা, আকাঙ্খা , সম্ভাবনা, বিকল্প ভাবনা; এমন অনেক কিছুর প্রকাশবাহী একটা ছোট শব্দ “ যদি”। এই “যদি” এর শর্তে আমরা অনুপ্রাণিত হই আবার থমকেও যাই। এই শব্দটা আমাদেরকে সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন এবং গ্রহণে সাহায্য করে , আবার একি সাথে “যদি” এর আধিক্য আমাদেরকে সিদ্ধান্তহীনতার গোলকধাঁধাতেও নিক্ষেপ করতে পারে । অর্থাৎ সম্ভাব্যতা কে আমলে রেখে বিকল্প পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত নেবার কাজে “ যদি” যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি ; শঙ্কা আর সম্ভাবনার দোলাচল- উচ্ছ্বাস প্রকাশেও “যদি” পারঙ্গম । লটারি নামক ভাগ্যের খেলায় আমরা তাই অতি পরিচিত এক স্লোগান শুনতে পাই; “ যদি লাইগা যায়!” । আবার প্রেমে হতাশ মানুষের মুখে গানও শুনতে পাই; “ আগে যদি জানতাম তবে মন ফিরে চাইতাম!” । এভাবে করে সংশয় ও সম্ভাবনা কেন্দ্রিক যুক্তি- তর্ক, কল্পনা এবং দর্শন বিনির্মাণেও এই “যদি” এর ভূমিকা ফেলনা নয়।

মানবজীবনে অনেক মত, অনেক পথ, অনেক গন্তব্য । আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়; কখন কোন পথে যাবো, কোন মতে থামবো, কোন গন্তব্যের ট্রেন ধরবো। অনিশ্চয়তাবাচক বৈশিষ্ট্য থাকবার ফলে, এই “যদি” শব্দটা অনেকের কাছে তাই অনেকক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে অনাকাঙ্খিত । নিশ্চয়তার আকাঙ্খায় থাকা মানুষেরা এই যদি দিয়ে উৎপন্ন অনিশ্চয়তার আস্ফালন কে সহ্য করতে পারেনা । এটি তাঁদের মনে তৈরি করতে পারে গভীর উদ্বেগ। তাই অনেক মানুষ চেষ্টা করে এই শব্দটি জীবনে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবার। আবার এর ঠিক উল্টোটিও আছে; যদি এর ঐ অনিশ্চয়তায় অনেকেই খুঁজে নিতে চায় নতুন সম্ভাবনা, নতুন পথ, নতুন উদ্যম। ‘যদি’ আছে বলেই জীবন তাঁদের কাছে এক আনন্দের বিষয়, সব কৌতূহলের কেন্দ্রস্থল। তাই ‘যদি’ এর সীমানা ডিঙিয়ে যাবার ‘সংকল্প’ ফুটে ওঠে কবির কাব্যে;
“আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে”


তো গণিতের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে , “যদি” শব্দে যে শর্ত, বাধা বা আকাঙ্খাগুলো থাকে তা সাধারণত চলক রাশি; ধ্রুব নয় । আমরা জানি, চলক রাশি পরিবর্তনশীল; ফলে অপরিবর্তনীয় ধ্রব রাশির বিপরীতে পরিবর্তনশীল চলক রাশির বিষয়ে দ্রুত সুনিশ্চিত কোন মীমাংসায় আসাটা দুরূহ কাজ। চলক রাশির চলমানতা কে বুঝবার কিংবা তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রয়োজন হয় ধৈর্য, মেধা, অধ্যাবসায়, আন্তরিকতার মত নানা মানবিক গুণের প্রয়োগ ও বিকাশ । অমন দূরহ কাজ নিষ্পন্ন করার চাইতে বরং ধ্রব রাশির অপরিবর্তনীয় অদৃষ্টে বিশ্বাস স্থাপন অপেক্ষাকৃত সহজ ও মানসিকভাবে স্বস্তিকর কাজ ।
“তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।“
রবীন্দ্রনাথের এই গান গেয়ে গেয়ে এক নিরুপদ্রপ, ঝুকিহীন, চেষ্টাহীন, নিরাপদ জীবন ভেসে ভেসে পাড় করে দেয়ার বাসনা তাই হতেই পারে অনেকের।

তবে দুরূহ কাজকে বাস্তবায়িত করাটাও মানুষের আরেক বৈশিষ্ট্য, তাই সভ্যতার এক পর্যায়ে মানুষ গণিতের জগতে আবিষ্কার করলো ক্যালকুলাস নামক এক অস্ত্রের ; যার দ্বারা পরিবর্তনশীল চলক রাশির ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র পরিবর্তনের নিখুঁত বিশ্লেষণ করতে সে সক্ষম হল । ফলে গণিতের চলক রাশির অতীতের মতো নিজেকে অনেকটা অস্পৃশ্য - অনিশ্চিত করে রাখবার সেই ক্ষমতা অনেকটাই যেন খর্ব হল । ক্যালকুলাসের উপর ভর দিয়ে গণিত ও ফলিত বিজ্ঞান মানব সভ্যতা কে এগিয়ে নিয়ে গেলো আরো বহু দূর । আবার অর্থনীতিতে ‘যদি’ ভিত্তিক অনিশ্চয়তা থেকে অর্থনীতিবিদরা ব্যাখ্যা করলেন সুযোগ ব্যায় ধারণার; যা কোন উৎপাদনকারী কখন কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদন করবেন কিংবা করবেন না এমন বিষয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে । তাতে ক্যালকুলাস এবং সম্ভাব্যতা সংক্রান্ত গণিতের প্রয়োগ, অর্থনীতির সেই ধারণাগুলোকেও পরিপুষ্ট করতে সাহায্য করলো। অন্যদিকে কম্পিঊটার প্রোগ্রামিং এ এই “যদি” এর প্রয়োগ ঘটানো হয় if-else স্টেটমেন্টের মাধ্যমে ; এটিও প্রায়োগিক ভাবে সহায়ক হয় কম্পিঊটার তথা মানুষকে নানারকমের নির্ভুল কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে । বিপুল পরিমাণ তথ্য রাশিকে সহজে বিশ্লেষণ করার কম্পিঊটারের দক্ষতাই অধুনা বিগ ডাটা এনালাইসিস কিংবা ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন যুগের সূত্রপাত করলো। আধুনিক সময়ে সকল শিক্ষিত মানুষকে নানা কাজে নানাভাবে কম্পিঊটারের শরণাপন্ন হতেই হয়, অবশ্য যদি তিনি চাচা চৌধুরী না হয়ে থাকেন আরকি।*
(*কারন চাচা চৌধুরীর মগজ কম্পিঊটারের চেয়েও প্রখর। প্রচারে: ডায়মন্ড কমিকস)

মোদ্দা কথা, ব্যাক্তি এবং গোষ্ঠী জীবনে যেকোন সংশয় - অনিশ্চয়তা অস্বস্তিকর, ক্ষেত্র বিশেষে ভীতিকরও বটে। কিন্তু মানুষ নামক বুদ্ধিমান, গল্পপ্রিয়, স্বপ্নবাজ, অধ্যাবসায়ী প্রানী অনিশ্চয়তাজাত এই অস্বস্তির প্রকোপ কে কমিয়ে আনার নানা পন্থাও বের করতে জানে । মোটাদাগে তাঁর কিছু পন্থা মূলত সামাজিক ও মনোজাগতিক আর কিছু পন্থা বাহ্যিক ব্যাবহারিক । সামাজিক ও মনোজাগতিক পন্থায় মানুষ নিয়ে আসলো দর্শন, নীতিশাস্ত্র, ধর্ম, জ্যোতিষ, লোকায়ত গল্প, সঙ্গীত ইত্যাদির আর আশ্রয় নিতে থাকলো এসবের ভেতর । অন্যদিকে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে মানুষ চর্চা করতে লাগলো গণিত, পরিসংখ্যান, অর্থ, আইন ও চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদির । এসব কিছুর একটা অলিখিত লক্ষ্য যেন জীবনের অনিশ্চয়তার প্রকোপ কে কমিয়ে এনে মানুষ তথা মানব সভ্যতাকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা; জীবনে স্বস্তি বৃদ্ধি করে জীবন কে উপভোগ্য ও সুখী করে তোলা। তবে সুখ যে কি জিনিস সেটাই আবার আরেক দার্শনিক বিতর্ক নাম । স্কুল জীবনে সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ পড়ানো হতো যেখানে তিনি মানব জীবনের চাহিদা গুলো কে দুই তালা দালানের সাথে তুলনা দিয়েছিলেন । এক তালায় ক্ষুধা, দারিদ্র নিবারণের মতো অতি জৈবিক - ব্যবহারিক বিষয়, আর দোতালায় সংস্কৃতি চর্চা ও রুচির উন্নয়নের মতো কিছু আত্মিক বিষয় । এক তলার ভিত্তি শক্ত না হলে শুধু কল্পনাতে বানানো দুই তালা স্থায়ী হয়না। সম্ভবত তার সেই লেখার প্রেরণা ছিলো ম্যাস্লো সাহেবের হায়ারারকি অফ নিডস। নোবেল জয়ী বারট্রান্ড রাসেলের The Conquest of Happiness নামক বইটির বাংলা অনুবাদও তিনি করেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘সুখ’ ।

যাই হোক, সপ্তদশ শতাব্দীকে গণিত ও বিজ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির এক শতাব্দী হিসেব গণ্য করা হয় । গ্যালেলিও, দেকারত, বেকন, নেপিয়ার, নিউটন, লিবনিজ, ডি ফেরমা, প্যাস্কেলের মতো বিবিধ চিন্তাশীল গবেষকদের দ্বারা পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি ও গাণিতিক মডেলিং এর প্রভূত উন্নয়নের সাথে সাথে সেই শতকেই জন্ম ও বিকাশ শুরু হয় লগারিদম, সম্ভাব্যতার তত্ব এবং ক্যালকুলাসের । সেই ধারাবাহিকতায় আধুনিক সম্ভাব্যতার সূত্র দিয়ে সাজানো পরিসংখ্যান ,ক্যালকুলাস, আর নানা গাণিতিক মডেলিং আজকের একবিংশ শতাব্দীর তথ্য বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপণা বিজ্ঞান, অর্থনীতি, একচুয়ারিয়াল সাইন্স, মেশিন লারনিং, আরটিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স ইত্যাদির মেরুদন্ড রূপে কাজ করছে । দৈব অনিশ্চয়তার প্রকোপ দক্ষতার সাথে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার জন্য এখন পুরো পৃথিবীতে বিভিন্ন রকমের প্রতিষ্ঠান তথ্যভিত্তিক কার্যকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বার্থে জ্ঞানের এই সকল শাখার বাস্তবিক প্রয়োগ করে চলেছে । ফলে প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি উভয় লাভবান হচ্ছে এবং ‘যদি’ এর তৈরি করা সংশয় অনেকক্ষেত্রেই তাঁর ধার হারাচ্ছে।

কিন্তু এগুলো তো গেলো ব্যবহারিক পন্থার কথা । গত তিনশো - চারশো বছরে যেভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানব জীবন ও সভ্যতায় প্রবল অবদান রেখে নিজ প্রভাব বলয় তৈরি করে যাচ্ছে, এই একই সময়ে কি সেই মাত্রায় সামাজিক ও মনোজাগতিক পন্থাগুলোও তা করতে পারছে ? অর্থাৎ গত তিনশো – চারশো বছরে দর্শন , ধর্ম, নীতিশাস্ত্র; এসবেরও কি প্রভূত রকমের উন্নতি ও বিকাশ হয়েছে ঠিক যেভাবে হয়েছে গণিত, বিজ্ঞান, আইন বা চিকিৎসা শাস্ত্রের ? বাস্তব জীবনে পরিবর্তনশীল পৃথিবীর অনিশ্চয়তা মোকাবিলার এ দুরকম পন্থার মাঝে কোনটি বেশী সফল ? আমরা কি গণিত ও বিজ্ঞানে বেশী ভরসা রাখবো নাকি দর্শন ও নীতি শাস্ত্রে?

এগুলো তর্কের বিষয় । অনেকে তো বলেই বসেন; “ বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ” । তখন আবারো প্রশ্ন জাগে; আবেগ কি আসলে বিজ্ঞান কেড়ে নিচ্ছে নাকি আবেগ কলুষিত হচ্ছে কারন দর্শন , ধর্ম, নীতিশাস্ত্র এখন তুলনামূলক অনগ্রসর সে কারনে ? যদি তাই হয় তবে সেই দায় কি বিজ্ঞানের নাকি মানুষের? বিজ্ঞানের তো আর আবেগের ঠেকা নেবার কথা নয়, বিজ্ঞানের কাজ সত্যের নৈর্ব্যক্তিক অনুসন্ধান আর প্রাপ্ত জ্ঞানের সম্প্রসারণ । নাকি আসলে দর্শন , ধর্ম, নীতিশাস্ত্র এসব বিষয়ে অনগ্রসরতা বলে কিছু নেই? এগুলো সব অনড় অপরিবর্তনীয় চিরন্তন বা ধ্রুব/ ধ্রপদী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে?

ব্যাপারটা হয়তো অন্যভাবেও ভাবা যায় । ধরুন, খনার বচনের যতই ঐতিহাসিক,সাহিত্যিক, লোকায়ত বা আবেগীয় মূল্য থাকুক; প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাংলার কৃষক কি আজ খনার বচন মেনে চলে বেশী উপকার পাবে নাকি হাতের মোবাইলের থেকে পাওয়া প্রায় নির্ভুল আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে বেশী উপকৃত হবে? যা কিছু পরিবর্তন বা সংস্কারের আওতায় পড়েনা ( যেমন খনার বচন) সেটাই শুদ্ধ, পবিত্র ও সঠিক? অর্থাৎ যার হালনাগাদ বলে কিছু নাই এবং যার বাস্তব প্রয়োগে সুফলতা অপ্রতুল; সেটাই কি তবে মহান কিংবা ধ্রুপদী ?

এই মহান, চিরন্তন বা ধ্রুপদী প্রসঙ্গে আরেকবার বিংশ শতকের অগ্রভাগে ঢাকার যুক্তিবাদী আন্দোলন “ শিখা গোষ্ঠীর” অন্যতম ব্যাক্তি; সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কাছে একবার যাই । তাঁর “সংস্কৃতি কথা” প্রবন্ধে তিনি বলছেন ;

“ সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতার কোনো পার্থক্য নেই। যা সভ্যতা তা-ই প্রগতি, অথবা যা প্রগতি তা-ই সভ্যতা। কিন্তু কালচার্ড লোকেরা তা স্বীকার করে না। উভয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বন্ধে তারা সচেতন। প্রগতি তাদের কাছে মোটের উপর জ্ঞানের ব্যাপার। কেননা, জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়। তাই জ্ঞান, বিশেষ করে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানপ্রসূত কল্যাণকেই তারা প্রগতি মনে করে। প্রকৃতিবিজয়লব্ধ সমৃদ্ধির সার্থক বিতরণই তাদের কাছে প্রগতি। কিন্তু সভ্যতা শুধু প্রগতি নয়, আরো কিছু। প্রগতির সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না। আর সৌন্দর্য ও প্রেমের ব্যাপারটা তথা শিলেপর ব্যাপারটা—কেননা শিলপ, সৌন্দর্য ও প্রেমেরই অভিব্যক্তি—চিরন্তন ব্যাপার, প্রগতির ব্যাপার নয়। চিরন্তনকে স্পর্শ করতে না পারলে সভ্যতা সৃষ্টি করা যায় না। কেননা, সভ্যতা ভ্যালুর ব্যাপার, আজ নিউভালু বলে কোনো চিজ নেই। জীবনে সোনা ফলাতে হলে প্রগতিকে চলতে হবে সভ্যতার দিকে মুখ করে, নইলে তার কাছ থেকে বড়কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আজকাল প্রগতি কথাটা যত্রতত্র শুনতে পাওয়া গেলেও সভ্যতা কথাটা একরকম নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। লোকেরা কেবল প্রগতি-প্রগতি করে, সভ্যতার নামটিও কেউ মুখে আনে না। “

অর্থাৎ তিনি সৌন্দর্য ও প্রেম নামক বিষয়গুলোকে শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করছেন এবং শিল্পকে চিরন্তন ঘোষণা করছেন । শিল্পবিহীন মানব সভ্যতাকে তিনি সভ্যতা নয় , তা শুধু প্রগতি হতে পারে বলে উল্লেখ করছেন , কেননা পরিবর্তনশীলতা শুধু জ্ঞানের জগতের বিষয় , কিন্তু সৌন্দর্য ও প্রেম তথা শিল্প চিরন্তন বিষয় । কথাগুলো শুনতে পড়তে ভালোই লাগছে , কিন্তু বাস্তবতা কি সম্পূর্ণ তাই? শিল্প কিংবা শিল্প চর্চার কি উন্নতি, অবনতি নেই? শিল্প, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি যদি সংস্কৃতির উপাদান হয় তবে কি এসব কিছু নিয়ে সংস্কৃতি একটি বহতা নদী নয় ? সৌন্দর্য ও প্রেম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এসব কি সময়ের সাথে তাঁর রূপ ও প্রকাশ ভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়না? সৌন্দর্য ও প্রেমের বোধ আমাদের আবেগের সাথে জড়িত, যদি সেই আবেগকে কেড়ে নেওয়া যায় বা আবেগ কলুষিত হয় বলে মেনে নিই তাহলে চিরন্তন আবেগ বা শিল্পবোধ আমরা কাকে বলবো? চিরন্তন কি তবে এখানে শুধু একটি আদর্শের নাম? কোন প্রিয় স্মৃতির নাম যা ফিরে ফিরে আসে কেবল কিন্তু আদতে যা স্থায়ী নয়? এমন চিরন্তন শিল্প বোধের সাথে জীবনের সংশয় বা অনিশ্চয়তা বোধের সম্পর্কটিই বা কি?

অন্যদিকে, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রিয় দার্শনিকদের একজন, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম পলিম্যাথ বারট্রান্ড রাসেল তার “Mysticism and Logic” প্রবন্ধে বিজ্ঞান ও আধ্যাতিকতা প্রসঙ্গে দর্শনের মেটাফিজিক্স শাখার কথা উল্লেখ করছেন এভাবে;
“Metaphysics, or the attempt to conceive the world as a whole by means of thought, has been developed, from the first, by the union and conflict of two very different human impulses, the one urging men towards mysticism, the other urging them towards science. Some men have achieved greatness through one of these impulses alone, others through the other alone: in Hume, for example, the scientific impulse reigns quite unchecked, while in Blake a strong hostility to science co-exists with profound mystic insight. But the greatest men who have been philosophers have felt the need both of science and of mysticism: the attempt to harmonise the two was what made their life, and what always must, for all its arduous uncertainty, make philosophy, to some minds, a greater thing than either science or religion

তারমানে কিছু মানুষের কাছে দর্শন হচ্ছে বিজ্ঞান ও ধর্মের চাইতেও ব্যাপক একটি বিষয় যেখানে পৃথিবীর মহত্তম অনেক দার্শনিকেরা আধ্যাতিকতা ও বিজ্ঞান এই দুইয়ের সমন্বয় সাধন করাকেই জীবনের ব্রত করে তুলেছিলেন, এই দুইয়ের মাঝে কোন প্রতিযোগিতা না খুঁজে । তাতে করে কি বাস্তব জীবনে মানুষের অনিশ্চয়তা বোধের একটা গতি হবে? বাস্তব জীবনে মানুষের জীবনে দর্শনের ভূমিকা কি এমন প্রশ্ন করা হলে রাসেল বলেন;
“One has in practical life to act upon probabilities, and what I should look to philosophy to do is to encourage people to act with vigor without complete certainty.”

তারমানে রাসেল বলতে চান মানুষের বাস্তব জীবনে সম্ভাব্যতার আলোকে কাজ করে যাওয়াই -ই মুখ্য । অন্যদিকে দর্শন অনিশ্চয়তার বিলুপ্তিতে নয়; দর্শনের মূল ভূমিকা অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করেও মানুষকে প্রবল উদ্যমে কাজ চালিয়ে যাবার বিষয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাওয়া ।

যদি ভিত্তিক আরো একটা প্রশ্ন রেখেই তাহলে এবার ইতি টানি;
যদি আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাজ মানুষের আবেগ কলুষিত হবার কারন হয়, লাখো প্রায়োগিক উপকার থাকা সত্ত্বেও
তবে চিরন্তন/ বর্তমান শিল্প,সাহিত্য, সংগীত, দর্শন, ধর্ম বা সভ্যতা কি পারছে সে আবেগকে বিশুদ্ধ করে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে?



ছবি © স্থিতধী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ৭:৩৭
১৫টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×