somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূর্যবন্দী মেঘ...

২৯ শে মে, ২০০৯ রাত ৮:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাথার বাম কোণায় হঠাৎ আলুর মতো গজিয়ে ওঠা মাংসপিন্ড দেখে ভয় পেয়ে গেল বাবা-মা। টিউমার-ফিউমার না তো? এই ডাক্তার সেই ডাক্তার দৌড়াদৌড়ি। তখন বয়স আমার কতো হবে? দশ-বারো দিন...হুমম। এরকমই হবে। ঘন ঝাকড়া চুলের মাথা নিয়ে জন্মেছিলাম। প্রথম প্রথম তাই আলুটা চোখে পড়েনি কারও। মায়ের অবশ্য ভিন্নমত, সেটা নাকি জন্মের কিছুদিন পরেই আস্তে আস্তে গজিয়েছিল। বাবা-মার দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে গেল খালা-মামাদের দুশ্চিন্তা। অমুক ডাক্তার তমুক সার্জনের খবর আনতে লাগলেন নিয়মিত। যাই হোক, খালা-মামাদের ভালোবাসা কিংবা বাবা-মার কোন পূণ্যেই হয়তোবা...মাথার আলুটা আলু হয়েই মাথায় রইলো। বড় কিছু হলো না। সে আলুও আমি চুলের জঙ্গলে দিব্যি আড়াল করে রেখেছি। বলে না দিলে খুব কম মানুষই তার অস্তিত্ব বুঝতে পারে।B-)


শান্ত স্বভাবের জন্য সবাই আমার নাম দিয়েছিল ঠান্ডু মিয়া। ছোট বাচ্চারা যে শান্ত হতে পারে...এটা আজকালের বাচ্চাদের দেখে আমার একরত্তিও বিশ্বাস হয় না/:) । আজকালকার বাচ্চাদের কথা আজ বাদ দেই...আমার কথাই বলি। একেবারে ছেলেবেলার স্মৃতি বলতেই তো কাঠের লাঠিকে টিপু সুলতানের তলোয়ার বানিয়ে দিনমান দৌড়াদৌড়ির কথা মনে পড়ে। সে স্মৃতির সাথে ঠান্ডু মিয়া নাম যায় কিনা তা জানি না। তবে আমার মুড়ি খাওয়ার গল্পটা ঠান্ডু মিয়া নামের সার্থকতা প্রমাণ করলেও করতে পারে। ঘটনাটা এরকম। মা আমাকে আর বোনকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন মুড়ি দিয়ে। বয়স তখন এক কি দেড়। বোনের বয়স তিন-চার। তখনো আমি হামা দিয়ে চলি, হাঁটতে শিখি নি। বোন মুড়ি না খেয়ে সারা ঘরে উড়াচ্ছে। রান্নাঘর থেকে মাও তাই মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এরকমই এক সময় হঠাৎ করেই আমি হারিয়ে গেলাম। আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বোন মুড়ি দিয়ে কদ্দুর ঘর সয়লাব করলো তা দেখতেই মা শোবার ঘরে এসেছিল। তখনই মা আবিষ্কার করলো যে আমি নেই। বাজারে যাবার আগে মনভুলো বাবা বাইরের দরজা খুলে রেখে গেছে, মায়ের ধারণা আমি হামা দিয়ে বাইরে চলে গেছি। বাসায় হুলস্থূল পড়ে গেল। বাবা বাইরে খুঁজে এলো। মা সারা ঘর খুঁজে বেড়াল। তারপরে এই নিয়ে চললো বোনকে জিজ্ঞাসাবাদ...বোন কিছুই বলতে পারলো না। মাথা ঠান্ডা করে কিছুক্ষণ পর সবাই ভাবতে বসলো, আমি বিছানা থেকে আসলে নামলাম কিভাবে? সবশেষে সার্চ অপারেশন শেষ হলো তখন, যখন আমাকে খাটের নিচে পাওয়া গেল। আগেকার আমলের উঁচু খাট, সেখান থেকে আছাড় খেয়ে আমি টু শব্দও করি না। খাটের নিচে টিনের চিপায় হামা দিয়ে ঢুকে খেলছিলাম। আশেপাশের চেঁচামেচি গায়েই লাগেনি!:P


জন্মের পরে সব শিশুই কিছুটা গাবদুগুবদু থাকে। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। সেই সাথে আমার শরীরের হাড় ছিল খুবই নরম। সব মিলিয়ে তুলতুলে পুতুল আর কি! তাই আমাকে কোলে নিতে সবাই উৎসুক। আমিও সব বুঝতে পেরে সেই বয়সেই নিজের দাম বাড়িয়ে ফেললাম;)। মার কোলে বাদে কারও কোলে যেতাম না। খালাতো-মামাতো বোনেরা কোলে নিতে আবদার করতো। আর আমি তাদের কোলে উঠা মাত্রই আমার ঠান্ডু মিয়া নামকরণের ব্যর্থতা প্রমাণ করে বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার শুরু করতাম। আরেকবার মামাতো এক বোন আদর করতে গিয়ে হাত যেই না মুখের কাছে আনলো, সাথে সাথে আঙ্গুলে বসিয়ে দিলাম কচ্ছপ কামড়। বেচারি এখনো সেই স্মৃতির দাগ বহন করছে:|। এমনি করে ঠান্ডু মিয়া তকমা এড়াতে বেশি সময় লাগেনি।

আরেকটু বড় হতেই আমি এটা সেটা ধরার বায়না ধরতাম। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আমার মা বেশ কড়া মানুষ ছিল...বিশেষ করে সন্তান লালন-পালনে। একদিন আমাকে টেবিলে বসিয়ে মা ইস্ত্রি করছেন। এইসময় আমি বায়না ধরলাম ইস্ত্রি ধরবো। এ বায়নাটা আমি প্রায়ই ধরতাম। মায়ের মাথায় ঢুকলো, যে কখনো অসতর্ক মুহূর্তে গরম ইস্ত্রি যদি আমি ধরে ফেলি! নিদেনপক্ষে ঠান্ডা ইস্ত্রিও পায়ে পড়ে ক্যাঁচা খেতে পারি! তাই ইস্ত্রি ধরার জন্য সেদিন আমি ইস্ত্রির দিকে হাত বাড়াতেই মা গরম ইস্ত্রি হাতে লাগিয়ে দিলেন।:| সেদিনই বুঝে গেলাম...ইস্ত্রি আসলে আমার ধরার জিনিস না! :((

এখন এই বয়সে এসে ভুলে যাওয়া শৈশবের গল্প শুনে নিজেকে মেলাই। এই আমি কি সেই আমি? এখনও আলুটা মাথার কোণে আছে, খুলির একটা এক্সটেনশন হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু সেই ঝাকড়া চুল আর নেই। কলেজ পর্যন্তও ছিল...ইদানিং গণকযন্ত্রকে মন্ত্র পড়াতে পড়াতে মাথার জঙ্গলের আয়তন ঠিক থাকলেও ঘনত্ব কমে যাচ্ছে। হাড় এখনো আগের মতোই নরম, তর্জনী উলটে বাঁকিয়ে হাতে লাগাতে পারি।B-)
পরিচিত কেউ আর ভুলেও ঠান্ডু মিয়া নামটা মনে করে না। বোনেরা কৃত্তিম ঝাঁঝে বলে," কেন কোলে আসতি না? তোরে খাইয়া ফেলতামX((" ? আমিচুপচাপ শুধু হাসি। মাঝে মাঝে মামাতো বোনের হাতে আমারই কচ্ছপ কামড়ের চিহ্ন দেখি আড়চোখে, কিছু বলি না।
ছোটবেলায় ভুলে যাওয়া শৈশবের গল্প বলার সময় মা বলেছিল, "ইস্ত্রি দেখলে খালি হাত বাড়াইতি, তাই গরম ইস্ত্রি লাগায় দিসি। তারপর থেকে আর হাত বাড়াস নাই।" মাকে মাঝসাঝে জিজ্ঞেস করি, "এতো নিষ্ঠুর কেমনে হইলা? গরম ইস্ত্রি লাগায় দিলা? :( " এখন মা বলে, "বেশি গরম ছিল না তো...কুমকুমা গরম।" আমি আবারও স্বস্তির হাসি হাসি। :D


এমনি করে শৈশবের অনেক গল্প বলা যেতে পারে...এ গল্পগুলো শেষ হবে না আসলে। স্মৃতিচারণের গল্প শেষ হয় না। নিজের স্মৃতিতে প্রিয় শৈশবের প্রায় সবটুকু আছে। যেটুকু শৈশবের স্মৃতি থাকার কথা না, তা আশেপাশের মানুষগুলো যত্ন করে মনে রেখেছে, মাঝেসাঝে শুনিয়ে যায়, স্মৃতিকাতর করে দিয়ে যায়। আমি অবাক হই...আমার মতো অভাগার জন্য তারা তাদের কিছু স্মৃতি বরাদ্দ রেখেছে। এ ভালোবাসাও কম নয়। সূর্যবন্দী মেঘের গল্পটুকু সেই ভালোবাসার মানুষদের জন্যই।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৪
৫২টি মন্তব্য ৫১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×