প্রচন্ড রোদ। সেদিনের গরমও বাবা। প্রায় সাড়ে পাঁচটার পড়ন্ত বিকেলেও যেনো টিএসসি কাকফাটা রোদে তাতিয়ে আছে। তার উপর চলছে আবার ফিলিংসের হ্যাং ওভার(দুষ্টু গিয়াস লিটন আর টেটনা মিম মাশকুর ছাড়া এ কথার শানে নুযুল এবং ফজিলত কারও বোঝার কথা না অবশ্য)। ঘামে চুপচুপা হয়ে বসে আছি 'ডাস'এর বিপরীত পার্শ্বের টিএসসি ভবনের সঙ্গে লাগোয়া নব নির্মিত যাত্রী ছাউনিতে। সাধারণত তৎকালীন 'মোস্ট সিনিয়র'(আদু ভাই!!) আমাদের আড্ডা ছিলো 'ডাস'এর অপর পাশের রোকেয়া হলের দেয়াল লাগোয়া যাত্রী ছাউনীতে। কিন্তু সেদিন অন্যপাশে আলাদা বসবার কারণ ছিলো সদ্য আগত চাঁটগা'র কিছু 'উটকো' বন্ধুবান্ধব। উটকো বলার কারণ হলো কোন এক কুক্ষনে হয়তো কারও মাধ্যমে 'হাই-হ্যালো' হয়েছিলো ব্যাস হয়ে গেছি ওদের 'জানের জান' 'হরিহর আত্মা'। ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করার এই হলো জ্বালা। 'ঘেট' কিংবা 'নাঙ'এর অভাব হয়না। কোত্থেকে কোত্থেকে যে পিলপিল করে আসে এরা! আর এলে যাওয়ার নাম নেই। 'হল' হয়ে যায় এদের স্থায়ী 'আপন নিবাস'। এই টোকাইয়ের দলরা সবার প্রথমে বন্ধুত্ব করবে ক্যান্টিনের বয় বেয়ারাদের সাথে। তারপর হলের মামাদের সাথে। এই পরিচিতি পেতে পেতে এক সময় কি করে যেনো হলের পরিচিত মুখ হয়ে যায়! নেতাদের পা-চাটা উঠাবসার কারণে অনেকেই এদেরকে হলের হোমড়াচোমড়া ভাবতে শুরু করে! এদের কুকীর্তির শুরু হয় হলের আশেপাশের টঙ দোকানের বাকী খাওয়া দিয়ে। ধীরে ধীরে এদের ডানা গজাতে শুরু করে। ডানা ঝাপটানোর রেশ শেষমেষ এ্যালিফেন্ট রোড, ঢাকা কলেজের মার্কেট পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। আর কিছু কিছু তো উড়তে উড়তে মাশাল্লাহ শীর্ষ টোকাই সন্ত্রাসীই হয়ে উঠে! ক্যাম্পাসের সমুদয় কুকীর্তির বারো আনা সংঘটিত হয় এদেরই দ্বারা। অযথা মিছেই রাবার টানছি। যাই হোক সেদিন এমনি কিছু অনাহুত 'টোকাই' অতিথি নিয়ে বসে আছি টিএসসিতে। কুলুকুলু ঘামছি। হ্যাঙ ওভারের বিস্বাদ বিরক্তি নিয়ে ভকভক ধোঁয়া ছাড়ছি আর চুকচুক 'দুধচিনি ডাবল' চা খাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা চাঞ্চল্য তৈরী হয়েছে। টিএসসি'র রাস্তায় গাড়ীঘোড়ার ছুটোছুটির হিড়িক পড়ে গেলো। মাইক্রোবাসের সংখ্যা বেশী। আবার সিএনজি'র ছুটোছুটিও লক্ষণীয়। কিছু কিছু মাইক্রোর চালকের পাশে বসা ব্যক্তিটি জানালায় গলা বাড়িয়ে বাঁশী বাজিয়ে কিংবা কাপড় নেড়ে রাস্তা ফাঁকা করার সংকেত দিচ্ছে। কিছুক্ষন লক্ষ্য করতেই চোখে পরলো রক্তাক্ত আহত সব শরীর। অনেক গাড়ীতে মহিলাও দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ গাড়ী ছুটছে পিজি হসপিটালের দিকে। আবার কিছু বা বাঁয়ে বাঁক নিয়ে ছুটছে এ্যালিফ্যান্ট রোড জেনারেল হসপিটালের দিকে। চিৎকার-গোঙানী-আতঙ্ক মিলেমিশে এক ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরী হয়ে গেলো নিমিষে। বোঝে গেলাম আজ বিরোধীদলের ঘোষিত সমাবেশে খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। হঠাৎই ফোন এলো জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাইনুদ্দিন বাবু ভাইয়ের। সমাবেশে নাকি গ্রেনেড হামলা হয়েছে! তিনি সুস্থ আছেন কিন্তু প্রচুর লোক নাকি নিহত হয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু ভাইয়ের(বর্তমানে এমপি) অবস্থা নাকি শোচণীয়। হয়তো বাঁচবেন না। নেত্রীর খবর কেউ জানেনা! তার উপর নাকি গুলি বর্ষনও হয়েছে!
রোকেয়ার লাগোয়া ছাউনীতে বসা ছিলো বন্ধু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সূর্যসেনের সভাপতি টিটু, এফ রহমানের সভাপতি আজম, এসএম হলের সভাপতি লিঙ্কন এবং আরও অনেকে। সবাই ছুটলাম ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে আহতদের রক্ত দিতে। ঢাবি'র ছাত্রসমাজের এই কালচারটি অসাধারণ। যে কোন দুর্যোগে আমরা এক হয়ে যেতাম। অবশ্য এখন কি হাল জানি না। যাই হোক, চাঙ্খারপুল বাবুবাজারের মোড়ে গিয়ে আটকে গেলাম। রাস্তা বন্ধ। মানুষ আর মানুষ। সবাই বিক্ষুদ্ধ। হঠাৎ দেখি বিক্ষুদ্ধ জনতা পুলিশকে ধাওয়া করছে। এই প্রথম সচক্ষে দেখলাম পুলিশকে প্রাণ ভয়ে পড়ি কি মরি ছুটতে। 'খোদার কসম' এই স্প্রিন্ট দক্ষতা অলিম্পিকে প্রদর্শিত হলে ট্র্যাক এন ফিল্ডের সমস্ত রেকর্ড আর পদকের গর্বিত মালিক হতো বাংলাদেশ পুলিশ। একটা পুলিশ ছুটতে ছুটতে আমাদের সামনে পরে গেলো। তার চোখেমুখে যেনো মৃত্যূভয়। ছুটন্ত তাকে পালাতে আমরা সরে জায়গা করে দিলাম। সঙ্গে থাকা সেদিনের এক চাঁটগার হারামী দিলো পা'খানি বাড়িয়ে। সেই পুলিশ হুঁচোট খেয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে না হলেও বিশ হাত সামনে গিয়ে পরলো!! কোনমতে হাঁচড়ে পাচড়ে উঠে তার বন্দুক ফেলেই দে দৌড়! সেই হারামী বন্ধু(!!) এবার গেলো বন্দুক ধরতে! সাহস কাহারে কয়!! রাম ধমকে রঙবাজি ছুটালাম। হেঁটে হেঁটেই পৌছেছি মেডিকেলে। এত বেশী উৎসাহি ডোনারের ভীড় ছিলো যে রক্ত দেয়ার সুযোগ হয়নি। অনেক ছাত্রলীগের বন্ধুর সাথে দেখা হলো। সূর্যসেনের এক্স ছাত্রলীগ ক্যাডার বন্ধু মোমিন(মাগুরা) আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কাঁদলো। ফোঁপাতে ফোঁপাতে চাক্ষুষ দর্শনের যে ভয়াবহ বর্ণনা দিলো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো মাইরি। বন্ধুর কান্নায় নিজেদের চোখও কেমন ভিজে উঠছিলো বারবার। এত রক্তাক্ত আহত শরীর সহ্য করতে না পেরে বন্ধু সূর্যসেনের সাগর হড়হড়িয়ে বমি শুরু করলো। এ এক অন্যরকম আবহ। ভাষায় অপ্রকাশ্য শব্দহীন ভিন্নতর কোন অনুভূতি। সেদিনের যে দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছি, দেখেছি রক্ত, বিভৎসতা, পুলিশের প্রাণভয়ে দৌড়, দেখেছি গণরোষ আর পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা- সেই স্মৃতি কখনও ভুলার নয়। মারুফা আক্তার পপি আপা আহত হয়েছিলেন। আমার দুই বন্ধু আহত হয়েছিলো (প্রায় মৃত্যূর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলো, আজও ওদের শরীরে স্প্লিন্টারের চিহ্ন)। এক বন্ধুর মা আইভী আপার সাথে শাহাদাত বরন করেছিলো। বাংলাদেশের রাজনীতির সে ছিলো এক ন্যক্কারজনক অধ্যায়। কত জল ঘোলা হলো, রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টেছে, হিসেবের ব্যাখ্যা বদলেছে, তবু পাওয়া হয়নি সেদিনের সেই সংঘটিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত বিচার। জানা হয়নি ঘটনার প্রকৃত কারণ।
কেনো জর্জমিয়া নাটক?
কেনো প্রশাসনের একাংশের নিষ্কৃয়তা?
কেনো নির্ধারিত সময়ের মাত্র পনেরো মিনিট পূর্বে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন হলো?
কেনো সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে যেতে দেয়া হয়নি আহত বিরোধীদলীয় নেত্রীকে দেখতে?
কেনো আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল পরেরদিনই চেকাপের জন্য ছুটলেন ভারত?(সারা বছর যেখানে যেতেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ)
আওয়ামীলীগের সময়ও কেনো বারবার বিচার কার্যক্রম প্রলম্বিত হচ্ছে?
প্রশ্ন অনেক। প্রকৃত সত্য একদিন বেড়িয়ে আসবেই। সেদিন ইতিহাস হয়তো অনেককেই ক্ষমা করবে না, আবার অনেককেই হয়তো মিথ্যা অভিযোগের দায়ভার থেকে নিষ্কৃতি দেবে। তবে যে রক্ত ঝরেছে আর এই রক্তের যেই চড়া মূল্য জাতিকে আজও দিতে হচ্ছে সে ক্ষতি আদৌ কতদিনে পূরণ হবে সময়ই বলে দেবে।
সেদিনের একুশে আগষ্টের সেই রক্তাত্ত স্মৃতি আজও ভাবায়, পোড়ায় আর তাড়িত করে। জাতির জীবনে এমন কালো অধ্যায় আর রচিত না হোক।
২১শে আগষ্টের সকল নিহত আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০২২ সকাল ৭:৩৯