পরম পূজনীয়া শ্রদ্ধেয়া প্রবাসী কবি শ্রীমতি রাবেয়া রাহীম প্রায়ই বলতেন বদমায়েসিতে আমি নাকি গিয়াস লিটন কিংবা সুফী মিম মাশকুর প্রমুখের চাইতেও দু'কাঠি সরেস! আমি বাপু একেবারেই ভিন্নমত পোষন করি। উনারা গুরু পর্যায়ের। বিশেষ করে গিয়াস লিটনের 'আমার ছেলেবেলা' চর্বিত দুর্ধর্ষ স্মৃতিকথনসমূহ পাঠ করলে নিজেকে পীর-মাশায়েখ স্তরের মনে হয়। তবু মাঝে মাঝে আত্মপীড়নে ভুগি কিছু কিছু অপ্রিয় স্মৃতি যখন বারবার 'রিমুভ' করার পরেও হঠাৎ হঠাৎ 'বিন বুলায়ে মেহমান য্যায়সা' উদয় হয়ে সজোরে ঠুঁয়া মেরে বলে 'পালাবি কোথায়'? এই সন্ধ্যায়ই টিভি'র এক স্ক্রলিং নিউজ দেখে তেমনি এক্ষান ঠুঁয়া খেলেম ফের। গাঁও মানে না আপনি লেখকিয় স্বত্বায় বিরাট তাগীদ অনুভব করলেম দেশ ও জাতির স্বার্থে কিছু একটা লেখা দরকার। এখন এবং এখনই,
সময়কাল সম্ভবত উনিশ শো উননব্বই। আমি তখন বয়ঃসন্ধির কাছাকাছি আপাদমস্তক এক দুরন্ত চ্যাংড়া। চিঠিপত্র লেখার সাহস হয় না কিন্তু প্রেম প্রেম খায়েস ষোলআনা। গিয়াস লিটনের ফ্রায়েড ফিশটি উল্টে না খেতে জানা মাসুম চেহারাখানি ছিলো তার ক্যাপিটাল কিন্তু আমার ট্রাজেডি হলো সেই কুট্টিবেলাতেই 'আই লুকড মোর বদ দ্যান আই ডু'! 'বদখত' ও 'ডাকাবুকা' চেহারার কারণে কলোনীর যে কোন সামাজিক অনর্থ ও বিপর্যয়ে সর্বপ্রথম তলব হতো আমার! কারও জানালার কাঁচ ভেঙ্গেছে-আমার ডাক! বিশ ফেব্রুয়ারী রাতে বাগানের সব গোলাপ চুরি গেছে- আমার ডাক! আজিজ সাহেবের মিচকা ছেলে অভির স্ট্যাম্প বুকের অর্ধেক ফাঁকা-আমার ডাক! পিচ্চি ও অতিশয় বদ নোমানের টেনিস বল পাওয়া যাচ্ছে না-আমার ডাক! এমনি করে আম গাছে আম নাই, বড়ই গাছে বড়ই নাই, মুমুর হাতে চিঠি কেনো? অনি'র মাথা ফাটলো কেনো? সালামতউল্লাহ কান্দে কেনো?
আমার দোষ আমার দোষ আর আমার দোষ!!!
কোন মানে হয়? (তামাম সু-আমলের একমাত্র নেক ভাগীদার আমি সে ভিন্ন প্রসঙ্গ)। ঐসব বিচার সালিশ 'ফেস' করতে করতে কি করে কি করে জানি সেই কুট্টিকালেই আমি শায়মাপু যথা নিপুণ(জায়েদ খান নিপাত যাক) অভিনেতা হয়ে উঠেছি। মানুষ মিথ্যা বলে দিন কে রাত করে, আমি সেকালেই মহানগর গোধূলি-মহানগর প্রভাতী-তূর্ণা নিশিথা-সোনার বাংলা সব সওওওব করতে পারতাম নিমিষে এবং অনায়াসে। কান্ড দেখো! সত্যিই আমার বয়েস হয়েছে। স্মৃতিকথন শুরু করলেই ফ্রি টেস্ট ড্রাইভের সুযোগে গোটা শহর দু'বার চক্কর মেরে আসি। যাগ্যে আবার পথে আসি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তখন দেশের উপ রাষ্ট্রপতি। দুর্দন্ড প্রতাপশালী। তাদের দাপটে সেকালে এদেশে বাইডেন-পুতিন এক ঘাটে জড়াজড়ি করে স্নান করতো। তো ঘটনা হইলো উপ রাষ্ট্রপতি মওদুদ সাহেব নিয়মিত জুমা'র সালাত আদায় করেন পরীবাগ জামে মসজিদ'এ। ঘটনাচক্রে আমরা শাহবাগের বিচ্ছু সমাজও জুমা'র সালাত আদায়ের নামে জমায়েত হই সেই পরীবাগ মসজিদেই। পরীবাগ মসজিদকে বেছে নেবার অবশ্যই অতি যৌক্তিক ন্যায়ভিত্তিক কারণ ছিলো। প্রথমত পরীবাগের সালাত খুব দ্রুত শেষ হয়ে যেতো যা কিনা সময় এবং বয়েসের প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য ছিলো চরম স্বস্তিদায়ক এবং নেয়ামতময়। দ্বিতীয়ত নির্মাণাধীন আড়াইতলা এবং তৃতীয়তলা ছিলো চ্যাংড়াকুলের একক সাম্রাজ্য। সেখানে আমরা মনের সুখে জনসভা, হত্যাযজ্ঞ, ডব্লু ডব্লু এফ, লুটতরাজ, তিল এক্সপ্রেস, পলান টুকটুক, বরফপানি- সমুদয় ত্রাস ও 'মালিকা হামিরা' যজ্ঞ চালিয়েছি নির্বিঘ্নে এবং নিশ্চিন্তে। তিনতলার শূণ্যে ঝুলানো রডে ভর দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে আড়াইতলায় গেছি আবার সিঁড়িবিহীন সেই আড়াইতলার দেয়ালের খাঁজে হাত ঢুকিয়ে তড়তড়িয়ে তিনতলায় উঠেছি ভাবতে নয় কেবল, লিখতে লিখতেই শিউরে উঠছি মাইরি। হাতের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে আমার বউকে জিজ্ঞেস করুন, মাত্রই তাকে দেখালেম সাক্ষী হিসেবে। তবে পরীবাগ মসজিদে যাবার তৃতীয় কারনটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তকর্ষক। সে হলো মসজিদের মিনার। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ ফুট উঁচু মিনারটির গোল গোল প্যাঁচানো সিঁড়ি। একদম চুড়ায় উঠলে তখনকার 'আকাশজঞ্জাল' মুক্ত পুরো ঢাকা শহরটিকেই যেনো দেখা যেতো প্রায়! আর সে কি বাতাস! জেমস ক্যামেরুনের টাইটানিক রিলিজের অন্তত এক দশক আগেই আমরা দুইহাত প্রসারিত করে জ্যাক-রোজের হাওয়া খাওয়ার ফিলিংস নিয়েছি মসজিদের মিনারের চুড়োয়। শোঁ শোঁ বাতাসে মনে হতো মিনারটি দুলছে। হাঁটু দৈর্ঘ্যের রেলিং ঘেঁষে সুউচ্চ মিনারের চুঁড়োয় দাঁড়ানো নিজেকে মোঘল বাদশাহ জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবর মনে হতো। আবারও পশম দাঁড়ালো মাইরি! বিশ্বাস করুন, আমাকে এখন নগদ বিকাশ বা রকেট এক কোটি ক্যাশ আর পরীমনির সাথে দুবাইয়ের দুইরাত তিনদিনের প্লেজাট ট্রিপ ফ্রী অফার করলেও ঐ মিনারে উঠার সাহস আমার হবে নাহহ! সাসপেন্সের একেবারে কিনারায় চলে এসেছি। এদ্দুর পড়লেনই যখন আর একটুশ সবুর করলে কি কেয়ামত হয়?
তো এমনি এক জুমা'র দিনে জামা'তের বহু পূর্বেই সুবোধ মুসল্লীর মতন মসজিদে হাজেরান আমিটা নিবিড় ও নির্ঝঞ্ঝাট একলা একা সেই মিনারের চুড়া থেকে উদাস নীচে তাকিয়ে দেশ ও দশের কোন এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবছিলাম হয়তো। হঠাৎ দেখি এক জীপ পুলিশ কর্ডনে মানণীয় উপ রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের গাড়ী এসে থামলো মসজিদের ভিআইপি গেটে। ফুঁক ফুঁক ঠোলাদের বাঁশীর পর তিনি প্রবেশ করলেন মসজিদে। তাকে নামিয়ে গাড়িটি মসজিদের উত্তরপার্শ্বের দেয়াল ঘেঁষে পার্ক করলো। রাজকীয় গাড়ীর ছাদের শোভা দেখতে দেখতেই হঠাৎ আমার মাঝে উদয় হলো এক অদ্ভুতুরে দুর্দম শয়তানি শক্তি। ভেতরের গিয়াস লিটন বলছে 'একটা কিছু কর রে সোনা একটা কিছু কর'। নিয়তেই বরকত। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে জেগে উঠতে যা দেরী হাতের কাছেই পেয়ে গেলেম একখান আধলা! আধলা মানে 'সাচ মুচ' আধলা। 'ওয়ান টেন ব্রিক' আড়াইইঞ্চি পুরো ইটের ঠিক ঠিক অর্ধেক! অদম্য কৌতুহলের কাছে শোচণীয় পরাস্ত হয়ে আনুমানিক ষাট-সত্তর ফিট উপর থেকে ছেড়ে দিলেম আধলাখানি উপ রাষ্ট্রপতির গাড়ীর ছাদ বরাবর। ধুমমমম,,,ঝন ঝন ঝনননননন। ভোঁ দৌড়ে কখন যে দু'তলার মুসল্লীদের পাশে শামিল হয়ে বসেছি নিজেই জানিনা। চেনা বামনের কি আর পৈতা লাগে? তেমনি আমারও অসচরাচরের দ্বিতল অবস্থান কিঞ্চিত কতিপয়ের এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ির রোল তুলেছে,,,হু কেয়ার্স? আমি তখন তখনই সুবোধ মুসল্লীর রোলে 'পদক অর্জন' সক্ষম অভিনয় করতে শতভাগ ক্যারেক্টারে প্রবেশ করে গভীর মনযোগে খুতবাহ শোনায় বিভোর! কিছুক্ষন পর কিছু পুলিশকে হুড়মুড় করে তে'তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখেছি। সুইসাইডাল স্কোয়াডের বোম্বারদের বুকের ঢিপ ঢিপ আমি সেদিন সেদিনই বুঝেছি। সেদিন এক/দু'তলার মুসল্লীদের ফিসফাস গুঞ্জন আড়াই/তে'তলার চ্যাংড়াকুলের কোলাহলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আর চ্যাংড়াকুল হয়েছিলো পিনড্রপ সাইলেন্ট। মানণীয় 'উপ রাষ্ট্রপতি' মহোদয় নিপাট ভদ্রলোক। তিনি স্মিত হেসে পুলিশদের চলে যেতে বললেন। পরম করুণাময়ের অসীম রহমতে সেদিনের মতন 'ফারা' কেটেছে নির্বিঘ্নে তবে এরপর মেলাদিন আমাদের নির্বিঘ্ন কোলাহল আড়াইতলা/তে'তলায় নিষিদ্ধ ছিলো। এই যে এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনা, চ্যাংড়াকুলের দীর্ঘদিনের সেনসেশন ও ফিসফাস,,,তবু 'স্পিকটি নট' আমিটা এই কথা বউ এবং দু/পাঁচটে গফ ছাড়া সামু'র আগে আর কাউকে বলিনি। পূজনীয়া রাবেয়া খালার দিব্যি।
এরপর বুড়িগঙ্গায় লক্ষকোটি কিউসেক দুষিত পানি প্রবাহিত হয়েছে। আমি লায়েক হয়েছি। গোল্লীফের সাথে রক্তের বেইমানী করে কাপুরুষের মতন বেনসন ধরেছি। মেলা নিষিদ্ধ গলি-ঘুপচি চিনেছি সুফী সম্রাট মিম মাশকুরের মতন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি। পাতিনেতা হয়েছি। সেই সুবাদে অনেকবারই সাধ জেগেছিলো 'ঐতিহাসিক ইভেন্টখানা' শেয়ার করার সুযোগে ঘটনা প্রবাহে তৎকালীন নেত্রীর উপদেষ্টা মওদুদ ভাইয়ের সান্নিধ্য এবং সখ্যতা পাবার। অন্নেকবার খুব কাছে গিয়েও তার রাশভারী প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে আর সাহসে কুলোয়নি এত হালকা আলোচনার। কি জানি, বললেই হয়তো অপরাধবোধ আর থাকতো না। আবার মনে হয় ভালোই হয়েছে বলা হয়নি। ' না বলা' হয়েই মওদুদ ভাই বেঁচে থাকুন হৃদয়ে চির। সে জন্যই হয়তো অন্তরে তার জন্য দোয়ার অযুহাতের পথ খোলা রইলো আজীবন।
ঐ যে বলেছি সন্ধ্যার টিভি'র স্ক্রলিং নিউজ, কোন এক চ্যানেলে দেখেছি আজ ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেবের প্রথম মৃত্যূবার্ষিকী। লেখার তাগীদ অনুভব করেছি কারণ তার মৃত্যূর দিনটিতেই শৈশবের ঘটনাটি সহ উনার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট ও মূল্যায়নভিত্তিক একটি স্মৃতিকথা লেখার ইচ্ছে ছিলো তার স্মরণে, কিন্তু লেখার ব্যপ্তি ও পরিসর অনুযায়ী লৈখিক পরিশ্রমের সেই শারীরিক সক্ষমতা ছিলো না আমার সেদিন।
আজ লিখতে বসে ভাবলাম একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি, তথ্যটথ্য কিছু সংগ্রহ করে তারপর লিখি। আহা বিধি! গুগলমামু বললেন তার মৃত্যূবার্ষিকী ১৬ই মার্চ। আজ নয়! আহা রে মিডিয়া। মিডিয়ার মাম্মি কা ড্যাডি! যাউগ্যা, যা লিখছি লিখছি। কইছি তিরিশ লাখ তো তিরিশ লাখই। যদ্দুর পারি আইজই পুষ্টামু।
মওদুদ ভাই বাংলাদেশের রাজনীতির এক আলোচিত/সমালোচিত রঙ্গীন পুরুষ। যে যার মতন দেখেছেন এবং বলবেন। আমার মতে এখনও তাকে নিয়ে বলার সঠিক সময় আসেনি। ইতিহাস তার কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন অবশ্যই করবে একদিন। আমি যেটুকুন দেখেছি তার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করার মতন। তার জ্ঞাণের প্রখরতা সামনের যে কাউকেই নুইয়ে দিতো অনায়াসে। আর মানুষ হিসেবে সৎ এবং অমায়িক ছিলেন।
আল্লাহপাক মওদুদ আহমেদের সকল সৎকর্ম কবুল করুন, তাকে ক্ষমা করুন, জান্নাতের উচ্চতম মাক্বামে আসীন করুন।
শৈশবের অ-বলা বালখিল্যতার জন্য ক্ষমা চাই নেতা। ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ৯:১৪