১৮৫৯ সালে প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের On the Origin of Species সমগ্র ইউরোপে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ সৃষ্টির ধর্মীয় দৃষ্টিকোণকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এসময় সাধারণ মানুষের সাথে সমসাময়িক কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা এর বিরোধিতা করলেও কতিপয় মানুষ বিবর্তনবাদকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। এই প্রগতিশীল মানুষেরা এই নতুন তত্ত্বকে নতুন শেখা কৌশলের মত যত্রতত্র ব্যাবহার করতে থাকেন, তার মধ্যে সমাজবিজ্ঞানে এর ব্যবহার ছিল অন্যতম। দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার ডারউইনের তত্ত্বের আলোকে প্রস্তাব করেন যে সমাজও ঠিক একইভাবে বিকশিত হয়; তিনি ডারউইনবাদের মূলমন্ত্র Survival for the fittest- কে সার্বজনীন করে তোলেন। এই সামাজিক বিবর্তনবাদ একটি চিনির দলার মত সমগ্র ইউরোপকে একদঙ্গল ব্যস্ত পিঁপড়াতে পরিণত করে। ইউরোপের সকল ঔপনিবেশিক শক্তি লিপ্ত হয় নিজেদেরকে Fittest প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায়। আর এই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে তারা বেছে নেয় আফ্রিকা ও এশিয়াকে।
১৮৭৭ সালে হেনরী মর্টন স্ট্যানলী নীল নদ ও কঙ্গো নদীর উৎস খুঁজে পাওয়ার দাবি জানালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বেলজিয়াম ইউরোপের ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগটি লুফে নেয়। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড স্ট্যানলীকে তার সাথে ১৮৭৬ সালে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিত আফ্রিকা বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানান। আলোচনায় লিওপোল্ড ইউরোপের অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সর্বাত্মকভাবে আশ্বস্ত করেন যে কঙ্গো পরিচালনায় বেলজিয়াম অগ্রনী ভূমিকা পালন করবে। আলোচনার দুইদিন পর লিওপোল্ডের সভাপতিত্বে আন্তর্জাতিক আফ্রিকান সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে বার্লিন সভায় বেলজিয়াম কঙ্গোর উপর পূর্ণ অধিকার লাভ করে। ইউরোপের অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তি কঙ্গোর উপর বেলজিয়ামে একক আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। বেলজিয়ামের লাভের গুঁড়ে ভাগ বসানোর জন্য নেদারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র কঙ্গোতে মুক্ত বাণিজ্য চালু করার জন্য লিওপোল্ডকে বাধ্য করে। এ উদ্দেশ্যে মুক্ত-কঙ্গো-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্রাজ্যবাদের প্রথম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় রোমান সম্রাট সিজার অগাস্টাস এর ইম্পেরিয়াম রোমানাম থেকে। সিজারের সাম্রাজ্যবাদের মূলনীতি ছিল লুন্ঠন ও ভূমধ্যসাগরীয় আধিপত্য বিস্তার। অর্থনীতি, রাজনীতি ও কৌশলগত লাভের কথা সম্রাট খুব কমই ভাবতেন। রোমান সিনেটে নিজের প্রভাব বজায় রাখা ছিল তার সাম্রাজ্যবাদ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের মূল লক্ষ্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের অর্থনীতি, রাজনীতি ও কৌশলগত আধিপত্য অর্জন। ১৭৮০ সালে শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপ তাদের শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানি ও মুনাফাহীন উদ্বৃত্ত পণ্যদ্রব্য রপ্তানীর জন্য নতুন বাজারের অভাব অনুভব করতে শুরু করে। ইউরোপীয় অর্থনীতি প্রতিযোগীতার বাজার থেকে একচেটিয়া পুঁজিবাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই একচেটিয়া পূঁজিবাদের অপর নামই সাম্রাজ্যবাদ। অপরদিকে অটো ভন বিসমার্ক জার্মানীর শ্রেষ্ঠত্ব অটুট রাখতে ইউরোপের ঔপনিবেশিক প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এদিক থেকে ইল্যান্ড ছিল খুবই হিসেবী- কমনওয়েলথ আফ্রিকাকে ব্যবহার করেছিল অবাধে ভারত যাওয়ার পথ পরিষ্কার রাখতে, সুয়েজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার নৌপথ ফ্রান্সের জন্য অবরুদ্ধ রাখতে যাতে ইংল্যান্ডের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী একে একে তার ভারতবর্ষের উপনিবেশগুলো ছাড়তে বাধ্য হয়।
হার্ট অফ ডার্কনেস- এর প্রধান কাহিনীকার মারলো উপন্যাসের প্রথমে উপরোক্ত দুই রকম সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে পার্থক্য টানে। রোমান সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সে বলে, “ তারা ঔপনিবেশিক ছিলোনা; আমার মনে হয় তাদের শাসন শুধু নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়। তার ছিলো বিজেতা, এর জন্য প্রয়োজন শুধু বর্বরতা- তাতে গর্ব করার কিছুই নেই, এটা সম্পূর্ণই দৈবক্রম যে আরেকজনের দূর্বলতা আপনার শক্তির উৎস...এটা ছিল সহিংস লুন্ঠন ও বড় মাত্রার জিঘাংসা”। মারলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যথার্ততা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও তার মূলনীতি সিজারের থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। যে ‘দক্ষতা’ ও ‘উদ্দেশ্য’ –এর বলে মারলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তার সমসাময়িক প্রতিদ্বন্ধীদের থেকে ভিন্ন বলে দাবি করে তা শুধুই পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকাতে ব্রিটিশ রানীর সুযোগ ও অক্ষমতাকেই নির্দেশ করে। আফ্রিকার এসব অঞ্চলে তাদের ‘দক্ষতা’ ও ‘উদ্দেশ্য’, –এর তেমন কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া না গেলেও ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে তার অভাব নেই। লিওপোল্ডের কূটনীতি ও পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রবল বাঁধাই কঙ্গোতে ব্রিটেনকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ভারতবর্ষ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ব্রিটেনকে কঙ্গো ছেড়ে দিতে হয় ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
আধুনিক ও রোমান সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সংজ্ঞাগত পার্থক্য করা হলেও তার বাস্তব প্রতিফলনে কোনো ভিন্নতা ছিলনা। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদও ছিল বর্বরতা, দৈবক্রম, সহিংস লুন্ঠন ও জিঘাংসার উপর পূঁজি করে গড়ে ওঠা শাসন। কঙ্গো নদীর উৎস আবিষ্কারের পর থেকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো কঙ্গোর মানচিত্রে তাদের সাম্রাজ্য নির্দেশক রঙ স্থাপন করা- “ সেখানে প্রচুর পরিমাণে লাল ছিল...প্রতিযোগিতা করে প্রচুর পরিমাণ নীল, অল্প কিছু সবুজ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কমলা, এবং পূর্ব উপকূলে রক্তিম দাগ” (হার্ট অফ ডার্কনেস, জোসেফ কনরাড), এবং যে যেভাবে পারে কঙ্গো থেকে নিজের আখের গুছিয়ে নেয়া। কঙ্গোর সাম্রাজ্যীকরণে সবচেয়ে তড়িৎ পদক্ষেপ নেয় বেলজিয়াম। রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড কঙ্গোকে নিজের ব্যক্তিগত জমিদারীতে পরিণত করেন। মারলো যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কঙ্গো নদীতে যাওয়ার স্বপ্নপূরণ করে তা লিওপোল্ডেরই ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান। ব্রাসেলস সভায় কঙ্গোকে সভ্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার শাসনামলে লিওপোল্ডের কঙ্গো পরিচালনা ইউরোপের বর্বরতাকেই নির্দেশ করে। সিজারের তুলনামূলক শক্তি যদি হয় দৈবক্রম তাহলে লিওপোল্ডের কুশলীতা তারই আধুনিক রূপ। আর লুন্ঠন ও জিঘাংসার দৃষ্টান্ত দিতে লিওপোল্ডের কোম্পানির কর্মচারীরা কোনো কার্পণ্য রাখেনি।
স্বাধীন-কঙ্গো-রাষ্ট্রে অবাধ বাণিজ্য বজায় রাখতে লিওপোল্ড আদিবাসীদের উপর শ্রমিক কর আরোপ করে। লিওপোল্ড গ্রামপ্রধানদের তার মুৎসুদ্দিতে পরিণত করে গ্রামবাসীকে কৃষিকাজ ছেড়ে সপ্তাহে চল্লিশ ঘন্টা কোম্পানির হয়ে দিনমজুরী করতে বাধ্য করে। আইভরি, রাবার ও রজন সংগ্রহ ছাড়াও কোম্পানির হয়ে আদিবাসীদের বিভিন্ন অর্থহীন শ্রম দিতে হত। আর এসব কাজের দেখভাল করতো সাম্রাজ্যের মিলিশিয়াবাহিনী। মাতাদির প্রথম স্টেশনে পা রেখে মারলো সাম্রাজ্যের অসার কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত হয়। সেখানে সে রেললাইন স্থাপনের বৃথা চেষ্টার নিদর্শন কোম্পানির মহৎ উদ্দেশ্য প্রতিফলিত করে। আদিবাসী আসামীদের জীবন তাৎপূর্যপূর্ণ করার মহতী চেষ্টা, শেকলবদ্ধ করে শৃঙ্খলা শিক্ষা, সামর্থ্যের আধিক ও উপযোগহীন শ্রম, এবং অনাহারে আদিবাসীদের মৃত্যু- সবই আফ্রিকানদের সভ্য করে তোলার মহান উদ্দেশ্যেরই অংশ, অন্তত লিওপোল্ড এভাবেই তার নৃশংসতার যথার্থতা দাবি করেছে। আদিবাসী সমাজে ইউরোপীয় বিনিময় প্রথার পরিচয় ঘটানো এবং নগণ্য বস্তুকে বিনিময় প্রথার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কলুষিত করা সাম্রাজ্যের অগোষ্ঠীকরণ নীতির পরিচয়বাহক যা আদিম সমাজ ব্যবস্থাকে অরাজকতায় ঠেলে দিয়েছিল।
ঔপনিবেশিক দ্বিমূলতত্ত্ব(Binarism): ঔপনিবেশিক-অধ্যুষিত; সভ্য-বর্বর; মানবিক-পাশব; নানান পার্থক্য কঙ্গোর সাম্রাজ্যবাদকে আধুনিক উপনিবেশ উত্তর সমালোচনার যোগ্য বিষয় করে তোলে। কঙ্গো, আফ্রিকা ও এশিয়া তথা সমগ্র প্রাচ্যই ইউরোপীয়ানদের কাছে ছিল বর্বর ভূমি। ইউরোপীয়ানদের কাছে কঙ্গো ছিল অন্ধকার পৃথিবী, আর আফ্রিকানরা কালো, বর্বর ও জন্তুতুল্য। কনরাড তার উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের প্রতি কোম্পানীর কর্মচারীদের আচরণ বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। স্টেশন ম্যানেজারের কাছে কঙ্গোর আদিবাসীরা জলহস্তীদের চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু নয়। মারলো তার গল্পে আদিবাসীদের বর্ণনায় অসভ্য, নিগ্রো, জান্তব এবং আরো বিভিন্ন ধরণের সাম্প্রদায়িক ভাষা ব্যবহার করেছে। নাইজেরিয়ান ঔপন্যাসিক চিনুয়া আচীবির মতে কনরাডের উপন্যাসে আফ্রিকাকে ইউরোপের ফয়েল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একদিকে ইউরোপের শান্ত ও আলোকিত টেমস, অপরদিকে আদিম ও অন্ধকার কঙ্গো; একদিকে টেমসে শান্তভাবে ভ্রমণরত পাঁচজন ইউরোপীয়, অন্যদিকে কঙ্গোর মুখে দাঁড়টানা নৌকায় চিৎকার করে গান গাওয়া কতগুলো কালো শরীর। ভালো-খারাপ, আলো-অন্ধকার এসব স্বকপোলকল্পিত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাই ইউরোপিয়ানদের সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রণোদিত করেছিল।
কিন্তু আফ্রিকার আদিম সমাজের প্রতি ইউরোপীয়দের ভয় ছিলো ছোঁয়াচে রোগের মত। সভ্যতা থেকে হাজার মাইল দূরে যথাযথ সুরক্ষার অভাব আদিম পরিবেশকে ম্যালেরিয়ার মত ভীতিকর করে তোলে। কনরাডের উপন্যাসে কার্টজ এর অধঃপতনের জন্য ইউরোপীয়রা কঙ্গোর অসভ্য, বুনো পরিবেশকেই দায়ী করে। আদিবাসীদের সাথে মেলামেশাই কার্টজের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ স্টেশন ম্যানেজার এরুপ মন্তব্য করে। স্টেশনের বাকি কর্মচারীরা কার্টজ এর মত আদিবাসীদের সাথে মেলামেশা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু কার্টজ এর সফলতার মূলেই হল আদিবাসীদের সাথে তার ওঠা-বসা। গ্রামপ্রধানদের সাথে কার্টজ এর সখ্যতাই তাকে কোম্পানীতে প্রচুর পরিমাণে আইভরির যোগান দিতে সাহায্য করে। ম্যানেজার কার্টজের সফলতায় ঈর্ষাকাতর, সে কার্টজের মত সফল হতে চায়, কিন্তু আফ্রিকার পরিবেশের সংস্পর্শ সে ভয় পায়, ঠিক যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থা। অসভ্যতাকে দায়ী করে ম্যানেজার এড়িয়ে যায় যে কার্টজের লোভই তার অধঃপতনের মূল কারণ। কারণ কার্টজ সমগ্র ইউরোপের প্রতিনিধি, ইউরোপই আধা ইংলিশ ও আধা ফরাসী কার্টজকে জন্ম দিয়েছে।
Survival for the fittest- ই যদি হয় সাম্রাজ্যবাদের মূলনীতি তাহলে কনরাডের উপন্যাসের সবচেয়ে সফল চরিত্র বলতে হবে প্রতিভাহীন ম্যানেজারকে। স্টেশন চালানোর মত বুদ্ধিমত্তা ছাড়া নয় বছর ধরে স্টেশনের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার উপনিবেশের শাসন ব্যবস্থারই পরিচায়ক। টিকে থাকার প্রতিযোগীতায় তার সমতুল্য কেউ নেই, আর সভ্যতা থেকে এতদূরে জঙ্গলে যোগ্যতার তুলাদন্ড নিয়েও কেউ বসে নেই। ঈর্ষা ও ক্ষমতার লোভ- এই দুই চালিকাশক্তি এখনো ম্যানেজারকে অন্ধকার মহাদেশে তার কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।