আমরা বাঙ্গালীরা জাতি হিসেবে দুইটা স্বত্তায় নিজেদেরকে তুলে ধরেছি বিশ্বের কাছে, সবসময়। যখন আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষ হই বা নিজেরাই নিজেদের সাথে বেইমানি করি বা কাপুরুষের মত
ঘরে বসে শুধু নিউজ চ্যানেল পাল্টাই তখন নিজের অজান্তেই কতবার না বলি এই বাঙ্গালের দ্বারা কিচ্ছু হবেনা। ঠিক আরেকটা ভিন্ন রুপের কথা হল, বাহান্ন, একাত্তর বা কোন গণজাগরনের কথা ঊঠলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে শরণ করিয়ে দেয়, বাঙ্গালীরা পারে অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আপোষহীন রাজনীতিতে নিজেদের
প্রতিষ্ঠা করতে।
আমি যুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। বাবা বলতেন "ঠিক যখন লাখো যোদ্ধার রক্তে একটা নতুন মানচিত্র খোদায় করা হল, সেখানে সবুজের সমারোহে তপ্ত বালি ঠাণ্ডা হল। তখন তোর জন্ম।" আমি অনেক নিশ্চিন্ত অনুভব করতাম এই ভেবে যে, আর কখনও এমন দিন আসবেনা যে দিন গুলোর কথা বলতে বলতে বাবার চোখে জল আসত। আমি তখন ছোট ছিলাম। কতটুকুই বা বুঝতাম, যে রাজনীতির খেলা কখনও বন্ধ হয়না। রাতের ঠাণ্ডা বালি
সকালের প্রখরতায় আবার উত্তপ্ত হয়, সবুজ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
বড় হওয়ার সাথে সাথে বাঙ্গালীর দুটা স্বত্তার সাথে পরিচিত হতে থাকলাম। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নিজেকে বীরের সন্তান ভেবেছি, তো কখনও জাতির কলঙ্কিত অধ্যায়ের জন্য "ব্লাডি বাঙ্গালী" গালিটা হজম করে বালিশে মুখ গুজে কেঁদেছি।
আমাকে প্রতিবাদী হতে দেয়নি সেই "দুইটা স্বত্তা", যা নিয়ে আমার কথা শুরু করেছিলাম। আজ বাঙ্গালী তার বাঙ্গালীয়ানা ভাতে আর মাছে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং আরও বিচিত্রতা নিয়ে উত্তর উত্তর বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে নিজেদের। আর সেই বিকাশের পূর্ণ রুপ গুলোর মধ্যে মোটা দাগে বিকশিত হয়েছে নিজেদের মধ্যে লড়াই। আন্দোলনের বৈচিত্র্যতা আরও সভ্য হয়ে রুপ নিয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতায়। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে ইংরেজ তাড়াও নীতিতে লাঠি, কাস্তে আর বন্দুক নিয়ে সহিংস হয়ে ওঠা কতটা নৈতিক অবক্ষয় সে প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়। তর্কের খাতিরে যদিও বা তা মেনে নেই, যে এর বিকল্প বা অদ্বিতীয় কিছু নেই, তবে এইটুকু না বললেই না, যে সাধারন মানুষের জীবন যাত্রায় বাধা দেওয়ার প্রশ্নে, তা কতটুকু সমর্থন যোগ্য। হরতালের আগের রাতে ইচ্ছেমত, রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ি ভাঙ্গা বা তাতে আগুন লাগানো কিংবা এরুপ সহিংসতা সত্যিই কি আমাদের জাতিগত চিত্রকে কলঙ্কিত করেনা? সেই রকম বর্বরতার এক চরম সীমা দেখলাম যুদ্ধ অপরাধীর বিচারের ইস্যুতে, যেখানে কলংকিত একটা অতীতকে প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে শুধরাবার চেষ্টা চলছে। হাস্যকর হলেও সত্য ,সেখানে অনেক বাঙ্গালীরা নাকি মুক্তিযুদ্ধ কালীন অপরাধের কোন অস্তিত্তই খুঁজে পায়না। কেউ আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। কেউ বলে রাষ্ট্র হবে নিরপেক্ষ। আবার কেউ দাবী করে বসে নিরপেক্ষতার শর্ত আমরা বুঝিনা, সংখ্যা গরিষ্ঠের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের ধর্ম নির্ধারন করতে হবে। এই বাঙ্গালীরা দুইটা স্বত্তায় বিভক্ত হয়ে আজ দুইটা অখণ্ড রাষ্ট্রের দাবীদার। একটা মুক্তি যুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আর অন্যরা বিরোধী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে যেন মড়িয়া। ইতিহাসের পাতাগুলোও আজ যথেষ্ট অপরিষ্কার।
ভালো মন্দের সিংহাসনে আজ কাকে কোথায় বসাব তা চিন্তা করতেই চুল চেড়া বিশ্লেষণ করা লাগে। শাহবাগে যখন ঘৃণ্য অপরাধের জন্য ফাঁসির দবীতে তরুণরা সোচ্চার হয়েছে তখন কেউ সমর্থন দেবে কি দেবে না, তা নিয়ে জটিলতার কমতি নেই কোথাও। জানিনা এর শেষ পরিণতি রাজনীতির কোন আভিধানিক অর্থে শেষ হবে, তবে বলতে পারি একটা দেশ, একটা জাতি, একটা স্বপ্ন, একটা দাবী, একটা উচ্চারণ আর বেঁচে থাকার একটাই অবলম্বন এমন স্বপ্ন তো আমি দেখি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




