হ্যাঁ- বিবেকের কথা বলছি। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে আজ সত্যের মতো নিখোঁজ, ন্যায়ের মতো অদৃশ্য। কুয়াশার সকালগুলো দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত পেড়িয়ে ভোরের তীর ছুঁয়ে যায় বারবার। তবুও বিবেকের সোয়াচান পাখির ঘুম ভাঙ্গেনা। হেরেমের আদর- সোহাগ, বিলাসী আশ্রয়ে অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। বধির সুশীল- হালুয়া রুটির কামড়া কামড়িতে ব্যস্ত। আর প্রশ্ন ফাঁসের প্রসবিত জিপিএ ফাইভ তারুণ্য- আঙুলের তলায় সপে দিয়েছে ভবিষ্যৎ- মায়াবী মোহের জালে...। এমনই এক বিরুদ্ধ সময়ে গণতন্ত্রের চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধারের আশায় ৩০শে ডিসেম্বরের ভোট নামক ভানুমতির খেল দেখলাম।
রাবিতে পড়ার সময় হলে -" তোমাকে অস্বীকার করা মানে, আমার জন্মকে অস্বীকার করা।" এমনই স্লোগান সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর বিশাল ছবিসহ পোস্টার এঁটেছিলাম- পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে। একদিন সন্ধ্যার পর পাঁচ- সাত জনের শিবির ক্যাডার এসে আমাকেই নিজ হাতে সে পোস্টার ছিড়ে ফেলতে বলল। আমি কিছুতেই রাজী হচ্ছিলাম না। দরকার হলে আপনারা ছিঁড়েন, তবু আমি পারবো না। এক সময় তাদের একজন আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, " ছিঁড়বি, নাকি তরে নিয়া- কিয়ামত কিয়ামত খেলবো?' বিশ্বাস করেন, আমি একটুও ভয় পাইনি। ৯৬-এ, আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতায় এলে, সে সময় বিএনপি থেকে নির্বাচিত এমপি আলাউদ্দিন আওয়ামিলিগে যোগ দিয়ে পানি সম্পদ প্রতি মন্ত্রি বনে গেলেন। রাজশাহীর ছাত্র সমাজ ঘোষণা দিলো তাকে রাজশাহীতে প্রতিহত করা হবে। সে দলে আমিও নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যখন আলাউদ্দিনের গাড়ী পার হচ্ছিল, সে গাড়ির সামনে যে কয়েকজন ছাত্র বুক চিতিয়ে শুয়ে পড়েছিল- আমিও তাদের একজন ছিলাম। বিশ্বাস করেন, একটুকুও বুক কাঁপেনী সেদিন। ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় এসে অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে শুরুতেই নিজ দলের যে ক'জন প্রতিবাদির কণ্ঠ ক্রসফায়ারে তালিকাবদ্ধ করেছিল- সে দলে আমিও ছিলাম। বিশ্বাস করেন, সে খবর শুনে এতটুকুও ভয় পাই নি। নিজ স্ত্রী না ফেরার দেশে ফেরার প্রস্ততি পর্বে যেদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লুসি যেদিন ছলছল চোখে দুই সন্তানকে আমার হাতে সপে দিয়ে বলছিল- ওদের দেখে রেখো ..। সেদিনও ভয় পাইনি। ৩০ শে ডিসেম্বর এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে দেখি এলাকারই কয়েকজন যুবক বসে আছে- বুথে। আমি ব্যালট হাতে গোপন কক্ষের দিকে এগতেই তারা আমার পথ আগলে দাঁড়ালো। তারা আমার হাতে থাকা ব্যালট পেপার চাইলে আমি না বলায় আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। কিল- ঘুষি- লাথি ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ব্যালট ছিড়ে ফেলে বাড়ীর দিকে দে দৌড়। বাড়ী যেতেই অসময়ে এতিম হয়া আমার ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়ে এগিয়ে এসে বলল- " বাবা, তোমাকে বারবার ভোট দিতে বারন করলাম- তবু এলে, এখন আবার ঝামেলা পাকিয়ে আমাদের কি তুমি বিপদে ফেলতে চাও ...? মেয়ের কথা শুনে আমিতো থ, এমন সময় প্রতিবেশি একজন এসে বললো- " লিটন ভাই, পুলিশ আসছে তোমাকে ধরতে- তাড়াতাড়ি পালাও....। কোন মতে জান নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে ঢাকা ফিরে এলাম। বুকে হাত দিয়ে বলছি- এই প্রথম জীবনে ভয় পেলাম।
কাকে বলবো এই বেদনা- দুঃখের কথা। আমাদের বন্ধকী বিবেক মরে ভুত হয়েছে। আমরা এখন বিবেক- প্রতিবন্ধি। তাই মজলুমের আর্ত চিৎকার, আহাজারি কান্নায় এখন আর সেই বিবেকের সোয়াচান পাখির অনির্দিষ্ট ঘুম ভাঙ্গেনা- ভাঙবে কি কখনও ...???
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:২২