মহিউদ্দিন আকবর
পৃথিবীতে এমন কোন শিশু নেই যে, তারা পানিকে মাম না বলেছে। মায়ের ভাষা তার যা-ই হোক না কেন, ব্যাপারটা এমনই তাজ্জব যে, শিশুরা পানিকে মাম বলবেই বলবে। সে হোক বাঙালি, আরবি, ইংরেজ অথবা স্কটিস। এই মাম বলার ব্যাপারটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কিন্তু কম ভাবেননি। কিন্তু এই মাম বলার রহস্য কেউই আবিষ্কার করতে পারেননি। এ এক এমনই মধুর শব্দ যে, সোনামণিদের মুখে বোল ফুটতেই ওদের মিষ্টি মুখের আবদার শোনা যায়-মাম। মাম দাও। মাম কাবো।
আমাদের সোনামণি সাবিহাও পানিকে বলে মাম। ওর বড় ভাইবোনও ছোট্ট বেলায় মাম বলতো। তাই সাবিহা যখন মাম কাবো বলে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, সে কি চাচ্ছে। কিন্তু ও যখন আমার লেখালেখির রুম থেকে বেরিয়ে এসে ওর আম্মুকে বললো- আম্মু, মাম চিস। মাম চিস। আমি মাম চিস।
ওর কথা শুনে আমি যখন অবাক হয়ে ভাবছি, সাবিহা কি খেতে চাচ্ছে- অমনি ওর আম্মু হায় হায় করে প্রায় দৌড়ে ছুটে গেলো আমার ক।ে আর মাত্র দশ সেকেন্ডের ভেতর ছুটে এসে শোবার ঘর থেকে ছোট্ট কাঁথা নিয়ে ছুটলো আবার আমার ক।ে সেখান থেকে মিনিট দু'য়েক পরে মুখ মলিন করে এসে বললো, এই যে কবি সাহেব, শুনছেন? ব্যাপার বেশি ভালো না। আপনার আলীশান গদিওয়ালা চেয়ারে প্রশ্রাব করে সাবিহা পুরোটা ফোম চুবো চুবো করে ফেলেছে। হঠাৎ করে আবার গিয়ে লিখতে বসবেন না যেন, তাহলে গতর ধুয়ে অযু করে তবেই নামাজ পড়তে হবে।
সাহিবার আম্মুর কথা শুনে তো আমি তাজ্জব! সাবিহা তাহলে হিসুকে মাম চিস বলতে শিখেছে! কিন্তু এমন আজব ভাষাটা ওকে শেখালেন কোন পণ্ডিত?
সাবিহার আম্মু জানালো- শেখাবে কোন পণ্ডিত, ওতো নিজে নিজেই মাম চিস বলতে লেগেছে। ওকি কম পণ্ডিত!
এতণে আমার মাথায় পুরো ব্যাপারটা ধরলো। বাংলা ব্যাকরণের সন্ধি বিচ্ছেদ করে দেখলাম- সর্বনাশ! আমার সোনার মানিক সাবুসুবু মানে সাবিহা তো আসলেই মহাপণ্ডিত! 'মাম' মানে পানি আর 'চিস' মানে হিসু। অর্থাৎ মাম+হিসু= মামহিসু; যা কিনা সাবুসুবুর ব্যাকরণে হয়ে গেছে মাম+হিসু = মামচিস! তার মানে হিসুটা তো মাম বা পানির মতোই! অতএব, সে যে মামচিস অর্থাৎ পানির মতো হিসু করে এসেছে, তা কি আর অস্বীকার করা যায়!
তবে সাবিহা মনির ব্যাকরণের কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
ওযে রীতিমত ভাষাবিদ! যেমন ওর ডিকশনারিতে আছে সুন্দত, তিম, লার লার, কাটকাট, সিপসিপ, ককেট, কাকা, কবম, হত, চিচিন, ভাপ, তাচ, কায় কায়, তয়তা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার তবে বলো দেখি, এতোগুলো নতুন- শুধু নতুন কেন, বলা যায় আনকমন শব্দ যার ডিকশনারিতে- অর্থাৎ যে কি না এতোগুলো আনকমন শব্দের আবিষ্কারক সে কি যেমন তেমন পণ্ডিত! আরে, সে তো মহাপণ্ডিত!
কথাটা যে মানতেই হবে।
সেদিন সাবিহা নাস্তার টেবিলে দুধের পেয়ালা আর রুটি দেখে তো ভীষণ হৈ চৈ শুরু করে দিলো। সে দুধ রুটি খাবে না। তার চাই তিম। সাবিহা কেঁদে কেঁদে বলতে শুরু করলো তুত কাবো না। তিম কাবো। তিম লার লার কাট কাট কাবো।
আমি তো বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। বড় মেয়ে মৌরিন বললো, এবার ঠ্যালা সামলাও আব্বু। সাবুকে ডিম এনে দাও। ডিম ফেটিয়ে ভেজে দিলে পরে চাকু দিয়ে কেটে কেটে পিস পিস করে সাবুমণি খাবে।
মৌরিনের কথা শুনে একটা ঢোক গিলে পরে বুঝলাম যে, সাবুসুবু ডিম ভাজা কেটে কেটে খাবে। আর সে কথাই সে তার নিজস্ব অভিধানের ভাষা খাটিয়ে বাক্য রচনা করেছে- তিম কাবো, লার লার কাট কাট কাবো।
এই তো গেলো খাবার আবদার। একদিন চুপচাপ কিছু কাটর্ুন অাঁকছি অমনি সাবুসুবু মানে সাবিহা এসে বললো, আব্বু কাকা, কাকা তাও। কাকা।
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, নিশ্চয়ই আমার কোন বন্ধু এসেছে। তাই দ্রুত কাজ রেখে, ঝটপট শার্ট গায়ে এঁটে, চুলগুলোতে চিরুনী চালিয়ে ড্রইং রুমে গেলাম। কিন্তু কোথায় আমার বন্ধু-স্বজন? কলাপসিবল গেটে তো দাঁড়িয়ে হরকিসিমের বেলুনওয়ালা! অই বেটাকে দেখেই হয়তো সাবিহা কাকা মানে চাচা ভেবেছে। তাই ড্রইং রুম থেকে নিজের রুমে ফিরে এলাম। ওদিকে সাবিহা তো ধুম কান্না জুড়ে দিয়েছে। চিৎকার করে বলছে, কাকা তাও। কাকা। নেব। কাকা তাও। কাকা । কাকা.......
ওর কান্না শুনে পাশের রুম থেকে মৌরিন বেরিয়ে এসে তো আমার উপরে মার খাপ্পা! বলে কিনা- কি হলো আব্বু মাত্র দু'টাকা হলেই তো একটা বেলুন কেনা যায়। দাও না দু'টো টাকা। দেখছো না কাকা কাকা বলে কেমন চিল্লাচ্ছে?
লে হালুয়া! আমি ভাবলাম কি, আর সাবিহা বলছে কি! অগত্যা কলাপসিবল গেট পেরিয়ে দু'টাকায় এক লাল বেলুন এনে সাবিহার হাতে দিতেই তবে ঠাণ্ডা। ওনার কাকা যে আসলে টংকা মানে টাকা- তা শিখে নিতে আর দেরি হলো না।
সাবিহার এ কাণ্ড শুনে আমার আব্বা বললেন- বুঝলে না টাকা এমনই এক জিনিস যে, জন্ম নিয়েই ওটাকে সবাই চেনে। জানো তো টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে থাকে!
আরেকদিন ভাত খেতে বসে সাবিহা তাচ তাচ বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। অফিস থেকে ফিরে কান্নাকাটি শুনে আমার মেজাজটা গেলো বিগড়ে। সাবিহার আম্মুকে বললাম- কি শুরু করেছো মেয়েকে খাওয়াতে বসে! তাজ, তাজ, কি চাচ্ছে দিচ্ছো না কেন?
সাবিহার আম্মু উল্টো আমাকে নিলো এক চোট আর কি!
বললো- রাখো তোমার আল্লাদি মেয়ের মর্জির কথা! ভাত খাবে না শুধু তাচ তাচ করে মাছ খেয়ে পেট ভরবে, এতো মাছ আমি পাবো কোথায়? এরই মধ্যে তিন টুকরো পাংগাস মাছ সে খেয়ে সেরেছে। আর তাচ খাওয়াতে পারবো না। এখন শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাওয়াবো।
বয়ান শুনে আমি বোকার মতো বললাম, ওযে তাচ বলছে, তা কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভাবলাম তাচ তাচ বলে কোন খেলনা-টেলনা বোধ হয় চাচ্ছে। আর তুমি ওকে সেটা দিচ্ছো না বলে কাঁদছে।
যা হোক আমি কাপড়-চোপড় ছেড়ে, খাওয়া-দাওয়া সেরে, যেই না লিখতে বসেছি- অমনি সাবিহা এসে বললো : কবম তাও। কবম।
আমি বললাম : কলম দিয়ে কি করবে! তুমি কি লিখতে জানো?
সাবিহা ওর হাতের তালু মেলে ধরে বললো : কবম তাও, পুল।
লেখালেখি রেখে ওর সাথে সময় নষ্ট করতে মন চাইলো না। তাই ওর হাতে একটা লাল কালির কলম দিয়ে নিজের কাজে ডুব দিলাম। কিছুণ পর সাবিহা আমাকে কলমটা ফেরত দিয়ে ওর দু'হাতের তালু টানটান করে মেলে ধরে আনন্দ প্রকাশ করে বলতে থাকলো : এই আব্বু পুল, পুল। সুন্দত। পুল।
তাকিয়ে দেখি কলম দিয়ে দু'হাতের তালুতে হিবিজিবি দাগিয়ে লালে লাল করে ফেলেছে। আর তাকেই বলছে সুন্দত পুল। মানে সুন্দর ফুল। আমিও সাবুকে উৎসাহ দেবার জন্যে বললাম : বা-বা সুন্দর। তুমি সুন্দর ফুল এঁকেছো। এখন আম্মু যাও।
কিন্তু আম্মু যাও বলে ওকে তাড়াতে চাইলেই কি আর পারা যায়? অমনি আবদার করে বসলো : সিপ সিপ কাবো। সিপসিপ দাও। সিপ কাবো।
কি আর করা ছেলে তৌফিককে ডেকে বললাম : কি ঝামেলা হলো দেখো তো! এই নাও দশ টাকা। সাবুকে একটা চিপ্স কিনে এনে দাও।
আমার কথা শুনে দু'পা দাপিয়ে সাবিহা প্রতিবাদ করে ওঠে : চিপ কাবো না। চিপ কাবো না। সিপসিপ তাও। সিপসিপ কাবো।
কি অবাক কাণ্ড! এ আবার কি জিনিস? সিপসিপ!
সাবিহার নয়া আবদার নিয়ে আমরা যখন গবেষণা করছি, ততণে সাবিহার ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙ্গে গেছে। ও রীতিমত কান্না জুড়ে দিয়েছে। ওর কান্না শুনে ওর মা খানিকটা বিরক্ত হয়ে ছুটে এসে বললো : বাপ-পুতে মিলে মেয়েটাকে শুধু শুধু কাঁদাচ্ছো কেন? তোমার ড্রয়ার থেকে একটা সি-ভিট টেবলেট সাবুর হাতে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
যাক্ বাবা! সাবু তাহলে সি-ভিটকে বানিয়েছে সিপসিপ! আমার ড্রয়ারটা খুলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে ড্রয়ারের কাছে এনে বললাম : কই, সিপপিস কোথায়?
ড্রয়ারের ভেতর চার-পাঁচ রকমের ওষুধের ভেতর থেকে সাবুমণি ঠিকই সি-ভিটের স্ট্রিপটা তুলে নিয়ে আনন্দে বলে উঠলো : পাইচি, পাইচি, সিপসিপ কাবো।
বুঝতে পারলাম দু'বছরের পিচ্চি সাবুসুবুটা পেকেছে ভালোই!
বিকেল বেলা ওর বড় মামা আবু নাছের এলো পকেট ভর্তি চকলেট নিয়ে। তাই পেয়ে তো সাবু খুশিতেই আত্মহারা। দু'হাত ভরে চকলেট নিয়ে নাচতে নাচতে আমাকে জানালো : মামা ককেট। ককেট। হু হু ককেট।
আমি বুঝেও না বুঝার মতো করে বললাম : কে এনেছে?
সাবুসুবু নাচতে নাচতেই ওর মামাকে দেখিয়ে বললো : মামা। মামা আনতে। মামা ককেট।
একদিন বাঁধাই খানা থেকে ঘরে নতুন বই এসেছে। আমি সেগুলো গুনে দেখছি যে ঠিক আছে কিনা। আমার সাথে সাথে সাবুসুবু মানে সাবিহাও বই গুনতে লেগে গেলো এক, দুই, পাঁচ, তিন, নয়, সাত, বারো, তিন, চার......
এভাবেই ওর বই গোনা শেষ। আমিও আমার গণনা শেষ করে সবে তুলে রাখছি। অমনি সাবু জানতে চায় : তয়তা?
বুঝলাম তয়তা মানে কয়টা? তাই বললাম : পাঁচশ' পঞ্চাশটা।
আমার জবাবে সাবু গেলো েেপ। গলা চড়িয়ে বলতে লাগলো তয়তা? বই তয়তা? তয়তা?
বুঝতে পারলাম পাঁচশ' পঞ্চাশ সংখ্যাটা ওর বোধগম্য হয়নি। তাই বললাম : নয়টা। ব্যাস, সাবুর পছন্দ হলো জবাবটা। তাই দু'হাতের দশ আঙ্গুল দেখিয়ে বললো : নয় তা।
রাতে তো আমাকে ছাড়া ঘুমোতেই চায় না। দু'পা বিছিয়ে পায়ের ওপর বালিশ রেখে তবেই তাকে ঘুম পাড়াতে হবে।
সাবু এ ঘুমের নাম দিয়েছে পা ঘুম। সাবিহার বড় ফারিহাকেও একইভাবে ঘুম পাড়াতে হবে। কিন্তু সাবুকে পাঘুমের জন্যে নিলেই সে ঘুমিয়ে যায় না। শুরু হয় তার 'কায় কায়'। অর্থাৎ চুলকায়। তাই পা দোলাতে দোলাতে যখন ওর পিঠ চুলকে দেই তখন সে আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে, এক সময় টুপ করে ঘুমিয়ে যায়।
একদিন গরমে অস্থির হয়ে বড় মেয়ে মৌরিনকে বললাম একটু বেশি করে চিনি দিয়ে শরবত করে দিতে। লেবুর রসও বেশি দিতে বললাম। মৌরিন লেগে গেলো শরবত বানাতে। কিন্তু ততণে সাবিহা ওর মায়ের কাপড় টানতে টানতে নিয়ে এসেছে। আর এসেই আবদার জুড়ে দিলো- আম্মু চিচিন ভাপ তাও। চিচিন ভাপ কাবো। চিচিন ভাপ তাও। আম্মু..........
আমি ভাবলাম সাবুও বোধ হয় শরবত খেতে চায়। তাই মৌরিনকে বললাম : সাবুসুবুকেও একটু শরবত দাও।
মৌরিন বললো : ওর এখন চিনি দিয়ে ভাত খেতে শখ লেগেছে। এখন শরবত দিলেও খাবে না। আর শরবত চাইলে তো চিচিন মামই চাইতো।
এবার বুঝলাম সার কথা। চিচিন মানে চিনি আর ভাপ মানে ভাত। অর্থাৎ চিচিন+ভাপ = চিচিন ভাপ। এর অর্থ চিনিতে মাখানো ভাত। সাবিহার ব্যাকরণের ভাষায় এ সন্ধিটিও মন্দ নয়।
দেখলাম ওর আম্মু অল্পকিছু শাদা ভাত একটু বেশি করে চিনি দিয়ে মেখে দিতেই বেশ আপন মনে খেতে শুরু করেছে। আড় চোখে ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম : এই তোমার মেয়ের চিচিন ভাপ!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



