যে কোন বিজয়ই আনন্দের। বিজয় মানে হাসি-খুশি উচ্ছলতা। আমাদের জীবনে বিজয়ের নানা দিক রয়েছে। কেউ খেলায় জিতে বিজয়ের আনন্দ লাভ করে, কেউ বা ব্যবসায় সাফল্য পেয়ে অর্থনৈতিক বিজয় অর্জন করে থাকে। ছাত্ররা পরীায় ভাল ফল করে বিজয়ের সীমাহীন স্বাদ লাভ করে এবং আনন্দ পায়। আবার কেউ কেউ যুদ্ধে-লড়াইয়ে প্রতিপকে হারিয়ে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করে। এভাবে মানুষ অনেকভাবেই বিজয় পেয়ে খুশি হয়। তবে জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় বিজয় হলো স্বাধীনতা অর্জন। এ বিজয় আমাদের অহঙ্কার, আমাদের অনেক বড় গর্বের বিষয়। কারণ, এক নদী রক্ত ঢেলে আমরা মহান স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। দীর্ঘ নয় মাসের প্রত্য সংগ্রাম ও যুদ্ধের পর এসেছে আমাদের কাঙ্তি বিজয়ের দিন। সেটা 1971 সালের কথা। দিনটি ছিল 16 ডিসেম্বর। এটি ছিল মহান গৌরবের সোনালি সোপানের এক বিরাট অধ্যায়। দিনটি ছিল এ দেশের ল-কোটি মানুষের অপার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন।
একাত্তরে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। এ ইতিহাস এ দেশের ছাত্র, শিক, কৃষক, শ্রমিক ও নারী-পুরুষসহ অগণিত মানুষের অকাতরে রক্ত ঝরার ইতিহাস। আমাদের এ ভূখণ্ড একদিন স্বাধীন ছিল। 1757 সালে পলাশীর আম্রকাননে বেইমান মীরজাফরের কুচক্রে পড়ে আমাদের স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। তারপর দু'শ বছর আমরা ব্রিটিশ বেনিয়ার পরাধীনতার শেকল পরেছিলাম। 1947 সালে আবার আমরা গোলামির নাগপাশ থেকে মুক্ত হলাম। সেটি ছিল 1947 সালের 14 আগস্ট। তখন পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ করল এ এলাকার মানুষ। আবার পেল নতুন এক বিজয়ের স্বাদ। আজকের এ বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানের অন্য প্রদেশের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। ব্রিটিশের কলোনি থেকে মুক্তি পেয়ে এ দেশের মানুষ অনেক আশা-প্রত্যাশার স্বপ্ন দেখেছিল। মানুষ ভেবেছিল তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য থেকে এবার মুক্ত হতে পারবে। তারা ফিরে পাবে সুখ ও সমৃদ্ধি। শিা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ জীবনের প্রতিটি েেত্র উন্নতি লাভ করে মানুষ মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে সম হবে। অথচ তাদের সেই স্বপ্ন কিছুদিন যেতে না যেতেই যেন ভেঙ্গে পড়লো। তারা দেখতে পেল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের অধিকার নিয়ে টালবাহানা করছে। ক্রমেই বৈষম্য ও ভেদাভেদের এক প্রাচীর তৈরি করল পাক শাসকশ্রেণী। ফলে আমাদের এ এলাকার মানুষ সর্বেেত্র পিছিয়ে পড়তে থাকল। আমাদের ন্যায্য দাবিকেও তারা মানতে চাইল না। শাসন মতায় আমরা অবহেলিত হলাম। সেনাবাহিনীতে আমাদের মর্যাদাপূর্ণ স্থান দেয়া হলো না। শিা-দীা ও চাকরির েেত্র আমরা পিছিয়ে পড়তে থাকলাম। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রসত্দ হতে লাগল। আমরা ভাষার েেত্রও চরম বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হলাম। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। আমাদের বাংলা ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করল পাক সরকার। সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের ভাষা উর্দুকে আমাদের জাতীয় ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। 1948 সালের কথা। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ 1948 সালে পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ভাষার ব্যাপারে এক বিতর্কের জন্ম দিলেন। তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে এ দেশের মানুষের মনে প্রচণ্ড আঘাত হানলেন। বৈষম্য ও জাতিভেদের শুরুটা হলো এখান থেকেই। উদর্ুকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ভাষা করার এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে ফুসে উঠলো পূর্ববাংলার জনগণ। প্রতিবাদ শুরু হলো সর্বত্র। ক্রমেই ছাত্র-জনতার রোষ বাড়তে লাগল। ভাষার দাবি ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ নিল। পাক শাসকশ্রেণী বাংলা ভাষার দাবিকে অগ্রাহ্য করতে গিয়ে জুলুম ও অত্যাচারের পথ বেছে নিল। ফলে 1952 সালের 21 ফেব্রুয়ারি ঢাকার বুকে পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরল। এই বর্বর পাক হামলার রেশ ধরে আন্দোলন নতুন ধারার পথ ধরল। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ববাংলার মানুষের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে লাগল। এ দেশের মানুষের মধ্যে জন্ম নিল স্বাধীনতার মনোভাব। এভাবে রাজনৈতিক পরিণতির দিকে অগ্রসর হলো দেশ। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ নিজস্ব মানচিত্র রচনায় পাগলপারা হয়ে উঠল। ফলে ইতিহাসের ধারাক্রমে এলো 1971 সাল।
পাক শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠল এ দেশের ল-কোটি মানুষ। মিছিলে মিছিলে কেঁপে উঠল গোটা দেশ। স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ল। এতে পাক সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ল। তাই নিরম্নপায় হয়ে তারা বেছে নিল নির্যাতনের পথ।
বহু রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে 1971 সালের 16 ডিসেম্বর আমরা মুক্তির স্বাদ পেলাম। নতুন দেশ, নতুন পতাকা নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। বাংলার আলো-বাতাসে সিক্ত হয়ে নতুন জীবন, নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রাম আবার শুরু হলো।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



