হারুন-অর রশিদ সরকার
বাংলায় তখন সবেমাত্র মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে সময়কার ঘটনা। দিলিস্নর সুলতান তখন গিয়াস উদ্দীন বলবন। তাঁর মাত্র দু' পুত্র। বড় ছেলের নাম মোহাম্মদ খান, তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। পিতার কাছাকাছি থেকে দায়িত্ব পালন করেন। ছোট ছেলে বুগরা খান। ইনি বাংলার গভর্নর। নদ-নদী আর জঙ্গলবেষ্টিত বাংলায়ই তিনি থাকেন। একদিন এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ করে মোঙ্গলদের সাথে এক সংঘর্ষে মোহাম্মদ মারা গেলেন। সুলতান খুব কষ্ট পেলেন তার জ্যেষ্ঠ ছেলের অকাল মৃতু্যতে। শোকে-দুঃখে তিনিও সয্যাশায়ী হলেন। শেষে ছোট ছেলে বুগরা খানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে তিনি পরপারে চলে গেলেন।
কিন্তু কী আশ্চর্য! দিলিস্নর সুলতান হওয়ার অমন লোভনীয় অফার বুগরা খান গ্রহণই করলেন না। তিনি বাংলার গভর্নর ছিলেন, তাই থাকলেন! কোথায় বিশাল ভারতের সুলতানের পদ আর কোথায় বাংলার মত মাত্র একটা প্রদেশের প্রশাসক। কেন তিনি অমন করলেন? বিস্ময়ে হতবাক দিলিস্নর মন্ত্রী-আমলারা।
ভালোবাসা। আসলে বাংলার ভালোবাসায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখানকার সবুজ শ্যামলিয়ার উদার জমিন, দিগনত্দ বিসত্দীর্ণ শর্ষে ৰেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর জলাশয়ে শাপলা শালুক তাকে আটকে রেখেছিল। তিনি সিদ্ধানত্দ নিলেন যতদিন বাঁচেন এই বাংলার সেবা করেই যাবেন। এখান থেকে যাবেন না।
তাহলে দিলিস্নর মসনদে কে বসবে?
সভাসদরা মতামত দিলেন, 'আপনি যখন চাইছেন না, তাহলে আপনার বড় শাহজাদা কায়কোবাদকে দেন। উনি তার দাদার কাছে থেকেই বড় হয়েছেন। শিখেছেনও অনেক কিছু।
বুগরা খান মত দিলেন। ছেলে হল দিলিস্নর সুলতান আর তিনি বাংলার শাসক। পুত্রের অধীনে প্রাদেশিক শাসক মাত্র। পিতা কিন্তু এতে আরো খুশি। তিনি বললেন, 'নিচ চোখে পুত্রকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখতে পাওয়া বাবার জন্য খুবই আনন্দের বিষয়'।
তিনি স্বসত্দির সাথে বাংলার শাসন কাজে মনোযোগ দিলেন। এখানে তিনি অনেকটা স্বাধীনভাবেই দেশ চালাতে লাগলেন। নিজের রাজকীয় নামও গ্রহণ করলেন 'নাসির উদ্দীন মাহমুদ'। দিনগুলো তার ভালই কাটছিল।
একদিন খুব খারাপ একটা খবর এল। ছেলে কায়কোবাদ সিংহাসনে বসে অঢেল ৰমতা হাতে পেয়ে যাচ্ছে তাই কাজ করছেন। রাজকার্য বাদ দিয়ে অকারণে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়া, মদ্যপান আর নারীদের সাথে বল্গাহীনভাবে সময় কাটানো ইত্যাদি অভিযোগ বাবার কানে। পিতা খুব মনুণ্ন হলেন এই সংবাদে। আসলে কায়কোবাদ তখন ছেলে মানুষ। বয়স মাত্র আঠার বছর। যে দাদার কড়া শাসনে মানুষ হয়েছেন, তিনিও এখন কবরে। বাবা বাংলা দেশে। এর ওপর আবার হয়েছেন দাদার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পদ আর সাম্রাজ্যের মালিক। তার ওপর কে খবরদারি করবে?
কায়কোবাদের মাথাটাই বিগড়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, ওনার মাথাটা আসলে খারাপ করে দিয়েছিল একদল মন্ত্রী বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী। যাতে যুবক কায়কোবাদকে ভোগ-বিলাসে মত্ত রেখে নিজেদের আখের গোছানো যায়।
বাংলাদেশে বসে বাবা নাসির উদ্দিন বুগরা খান এসব শুনে খুব মর্মাহত হলেন। তিনি একের পর এক আবেগপূর্ণ ভাষায় চিঠি লিখলেন ছেলের কাছে- দিলিস্নর সুলতানের কাছে।
-'একজন মুসলিম যুবক হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য'।
-'একজন বাদশাহ হিসেবে তার করণীয়।'
-'দিলিস্নর সুলতান হিসেবে তার জীবনযাপন কেমন হওয়া উচিত' ইত্যাদি উপদেশ দিলেন!
অনেক চেষ্টা করলেন পুত্রকে ফেরাতে। কোন চেষ্টাতেই কাজ হল না। বুগরা খান দেখলেন তার পুত্রকে পথভ্রষ্ট করে একটা গোষ্ঠী যেভাবে অবৈধ স্বার্থ আদায় করছে তাতে দিলিস্নর মসনদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তার ছেলে তো সর্বনাশ ডেকে আনছে! এর একটা বিহিত করা দরকার। তিনি সিদ্ধানত্দ নিলেন দিলিস্ন যাবেন। সেনাবাহিনী সাজাতে লাগলেন তিনি। ওদিকে দিলিস্নর আমলারা এটাকে পিতা-পুত্রের বিষয় ভাবলেন না। তারা কায়কোবাদকে বোঝালেন, 'বাংলার গভর্নর দিলিস্ন অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করবে- এটা মেনে নেয়া যায় না। আপনার বাবা, তাতে কি? তিনি তো দিলিস্নর সুলতানের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন' ইত্যাদি বুঝিয়ে কায়কোবাদকেও যুদ্ধের জন্য তৈরি করলেন। তাদের পরামর্শে শেষ পর্যনত্দ কায়কোবাদ বিশাল এক বাহিনী নিয়ে পিতাকে বাধা দেয়ার জন্য অগ্রসর হলেন।
সরযু নদীর দুই তীরে দুই বাহিনী শিবির স্থাপন করলো। নদীর ওপারে দিলিস্নর সুলতান কায়কোবাদ আর এপারে তারই পিতা বাংলার সুলতান নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে অপেৰমাণ। কিন্তু কেউই আক্রমণের নির্দেশ প্রদান করছেন না।
আসলে কে কার বিরম্নদ্ধে আক্রমণ করবে- এটাই হল সমস্যা। পিতা কি আর পুত্রের বিরম্নদ্ধে আক্রমণ করার হুকুম দিতে পারেন? কিংবা পুত্র কি পারে পিতার বিরম্নদ্ধে হুকুম দিতে?
উভয়েই চাচ্ছিলেন, একত্রে বসে আলাপ আলোচনা করতে। কিন্তু বাদ সাধল কিছু নিয়ম-কানুন। যাকে বলে 'প্রটোকল'। দিলিস্নর সুলতানের পদ যেহেতু বড়, সেজন্য বাংলার সুলতানকে বলা হচ্ছিল তাকে দাঁড়িয়ে সালাম করতে হবে। আরও অনেক আনুষ্ঠানিকতা যা পিতা হিসেবে পালন করা অপমানকর।
বাংলার সুলতানের পৰ থেকে আমলারা বলছিলেন, 'এটা কি করে সম্ভব? তিনি যে পিতা, কি করে সনত্দানের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকবেন'!
আর ওদিকে দিলিস্নর আমলারা বলছিলেন, 'হোক পিতা-পুত্র এটা দিলিস্নর সুলতানের প্রাপ্য সম্মান। এটা দিতে হবে'। আসলে দিলিস্নর আমলারা চাচ্ছিলেন এভাবে আলোচনার পরিবেশ ভেঙে যাক, পিতা পুত্র যেন একত্র হতে না পারে। এই দর কষাকষির ভেতরে একদিন বুগরা খানের ছোট ছেলে হুট করে এক কাণ্ড করে বসল। ওর নাম খসরম্ন। যেমন সাহসী তেমনি বুদ্ধিমান। সে নদী পার হয়ে গেল ওপারে বড় ভাইয়ের শিবিরের দিকে। কেউ আটকালে অমনি বলে বসলো,
'আমি দিলিস্নর সুলতানের ছোট ভাই আমাকে ওনার কাছে যেতে দাও'।
কায়কোবাদের কাছে গেল সেই খবর।
'এক বালক আপনার সাথে দেখা করতে চায়। নাম খসরম্ন, আপনার নাকি ছোট ভাই'।
সুলতান সাথে সাথে খসরম্নকে আসার অনুমতি দিলেন। ছোট ভাইটিকে পেয়ে তার সে কি আনন্দ! তার ভাইটি কত সুন্দর আর বেশ বড় হয়েছে। দুই ভাই মিলে অনেক গল্প আর আনন্দ হল। কায়কোবাদ তার চার মাসের শিশুপুত্রকে দেখালেন ছোট ভাইকে। খসরম্ন শেষে বড় ভাইকে ধরে বসল, 'ভাইয়া, বাবুকে আমি নিয়ে যাব। আব্বু আম্মুকে দেখাবো। ওরা খুব খুশি হবেন।'
কায়কোবাদ কোনই আপত্তি করলেন না। কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে দিয়ে শিশুপুত্রকে পাঠালেন নদীর এপারে। খসরম্নর বুদ্ধিতে সমস্যাটি সমাধান হওয়ার পথ খুলে গেল।
বুগরা খান তো নাতিকে পেয়ে মহাখুশি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি শিশুটিকে নিয়ে খেলায় মত্ত হয়ে গেলেন। নাতিকে দেখে তার মনে হল ছেলের কথা। কায়কোবাদের সঙ্গেও তিনি এভাবেই খেলতেন। আহা ছেলেটাকে কতদিন দেখা হয় না! আর তখনই তার ছেলের মুখটা দেখতে ইচ্ছে হল। সব নিয়মকানুন ডিঙ্গিয়ে তিনি ছুটলেন ছেলের দিকে। রাজকীয় মানসম্মানের নিয়ম কানুনের প্রতি তার কোন ভ্রূৰেপই থাকল না। নৌকা তীরে ভেড়ারও তর সয় না। বুগরা খান লাফ দিয়ে কূলে উঠতে গিয়ে নদীতে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন।
আর ওদিকে কায়কোবাদ যখন শুনলেন বাবা স্বয়ং আসছেন। তিনি তার আমলাদের বেঁধে দেয়া এসব প্রটোকল ভুলেই গেলেন। 'বাবা, বাবা' বলে দ্রম্নত সিংহাসন থেকে নামতে গিয়ে তিনিও প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। খালিপায়ে ছুটে এসে পিতার পায়ে পড়ে গেলেন। পিতা সনত্দানকে তুলে নিলেন বুকে। ভালবাসার টানের কাছে পরাজিত হল আভিজাত্য আর দরবারি নিয়ম কানুনের বিড়ম্বনা।
কায়কোবাদ বাবাকে অনুরোধ করলেন, আব্বা, 'অনুগ্রহ করে বসুন'।
কিন্তু পিতা তার স্নেহময় সনত্দানের মর্যাদার কথা, দিলিস্নর সুলতানের পদটির মর্যাদার কথা সহসাই মনে আনলেন। বললেন, 'তা হয় না বাবা। তুমি বস'।
বলে প্রায় জোর করেই ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন এবং দরবারি নিয়ম মত পুত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুৰণ। অল্পৰণ পরে কায়কোবাদ সিংহাসন ছেড়ে দাঁড়ালেন। উভয়ে দীর্ঘৰণ আলাপ আলোচনা করলেন। পিতা তার পুত্রকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিলেন, পুত্র তার অতীত ভুল স্বীকার করলো। ভাল পরিবেশে আলোচনা শেষ হল। দরবারের অভিজাত ব্যক্তিরা পিতা-পুত্র উভয়ের গায়ে ফুলের পাপড়ি আর স্বর্ণ ও রৌপ মুদ্রা ছিটিয়ে দিলেন ঐতিহাসিক এই স্মরণীয় মুহূর্তটিতে। পরে আরো কয়েক দিন সরযু নদীর উভয় তীরে আনন্দের বন্যা হয়ে গেল। শেষে উভয় সুলতান তাদের শিবির তুলে নিয়ে ফিরে গেলেন নিজ নিজ দেশে।
বাংলা ও ভারতের ইতিহাসের এই বিরল স্মরণীয় ঘটনাটিতে উপস্থিত ছিলেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। এদের একজন হলেন কবি আমীর খসরম্ন। তিনি এই ঘটনাকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'কিরান উস সাদাইন' বা 'দুই তারার মিলন'।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



