ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে এধরনের প্রতিবাদ আগে কখনো হয়নি । এই প্রতিবাদ নিয়ে দুটি ধারনা এ মুহুর্তে প্রচলিত আছে । প্রথমটি হলো আমেরিকা ইউরোপ ও ইসরাইলের প্ররোচনায় কিছু ইরানী এই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে । এটি ইরানের কট্টরপন্থীদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবার চক্রান্ত । দ্বিতীয় যে ধারনা প্রচলিত সেটা হলো , ইরানের জনগনই কট্টরপন্থীদের শাসনে অতিষ্ট হয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে পড়েছে । বেশ কয়েকজন ইরানী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে । তারপরও প্রতিবাদ বন্ধ হয়নি । আমি আহমেদিনেজাদ বা মুসাভী কারো পক্ষেই নই । ইরানের জনগনই ঠিক করবে তারা আহমেদিনেজাদ বা মুসাভী কাকে বেছে নেবে ।
কিন্তু আমি যে জিনিসটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই , সেটি হলো , ইরানের তথাকথিত ইসলামী শাসনব্যবস্থার নানা ত্রুটি আজকে আমাদের সামনে চলে এসেছে ।
এক: ইরানের মোল্লারা ইসলামী নিয়মকানুন কড়াভাবে পালন করেন, ইরানীদের উপরও জোর করে ইসলামী নিয়মকানুন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ।
অথচ, সাধারন ইরানীরা এই কট্টরপন্থা পালন করতে না পেরে ইরানের বাইরে গিয়ে দুবাই, কাতার, সিঙ্গাপুর, জাপান, লন্ডন, কানাডা, প্রভৃতি দেশে গিয়ে তুলনামুলক স্বাধীন জীবন যাপন করছে । এসব দেশে বসবাসরত ইরানী মহিলাদের জীবনযাপন পদ্ধতি দেখলে অবাক হতে হবে । কর্মক্ষেত্রে আমার সাথে কিছু ইরানীর পরিচয় আছে, যারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় , কিন্তু ধর্মীয় কড়াকড়ির কারনে ফিরতে পারছে না । তারা এবার মুসাভীকে ভোট দিয়েছে । প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইরানের বাইরে বসবাসরত ইরানীরা ইরানের নির্বাচনে ভোট দিতে পারে ।
দুই : ইরান তেল, গ্যাসসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ । দেশের আয়তন, লোকসংখ্যা, মানবসম্পদ প্রভৃতির বিচার করলে ইরান কোন অংশেই সৌদিআরব, দুবাই, কাতার সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর চাইতে কোন অংশেই কম নয় । কিন্তু ইরান এই দেশগুলোর চাইতে অর্থনৈতিক , বানিজ্যিক সবদিক দিয়ে পিছিয়ে আছে । ইরানের বাইরে বসবাসরত ইরানীরা এতে খুব নাখোশ । তাদের কথা হলো , আমাদের দেশে এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে কেন দেশের বাইরে গিয়ে থাকতে হবে ।
তিন: ইরান কয়েকটি ফিলিস্তিন গেরিলা গ্রুপকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে থাকে । বলা যায় , ইরানের অর্থেই ঐ গ্রুপগুলো টিকে আছে । অধিকাংশ ইরানী জনগন তাদের দেশের অর্থের এই অপচয়ে নাখোশ । কারন ফিলিস্তিনের অধিকাংশ লোক ইরানীদের পছন্দ করেনা , ইরানের চাইতে সৌদিআরব সহ অন্যান্য আরব দেশকেই তাদের বন্ধু মনে করে ।
চার: ইরানে কঠোর ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রচলন করে , মোল্লাগন প্রচার করে, তারা ইসলাম খুব ভালভাবে পালন করছে । কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানরা ইরানের মুসলমানদেরকে মুসলমান বলেই স্বীকার করেনা ।
তাহলে দেখতে পাচ্ছি , ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নামক তথাকথিত কিছু মোল্লাদের প্রনীত নিয়মকানুন ইরানের জনগনের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে ।
আসলে ইরানের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে , যা হলো,
১. রাষ্ট্র কখনো তার নাগরিকদের ধর্ম পালনে জোর করতে পারেনা , এতে কখনো শুভ ফল হয়না । ধর্ম পালন করা বা পালন না করা নাগরিকের নিজস্ব ব্যাপার , রাষ্ট্রের এতে উৎসাহ দেয়া বা বাধা দেয়ার কোন দরকার থাকতে পারেনা ।
২. তথাকথিত ইসলামী সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হলেও রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হবেনা । ইরান, সৌদিআরব সহ কিছু দেশে ইসলামী কট্টরপন্থা পালনে রাষ্ট্রীয় খবরদারি তাদের নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করতে পারেনি । বরং শাসকশ্রেনীর অধিকারকে সুরক্ষিত করেছে । শাসকশ্রেনী তাদের স্বার্থরক্ষায় সবসময় ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে যাচ্ছে ।
৩. গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র , ধর্মতন্ত্র, পুজিবাদ প্রতিটি সমাজব্যবস্থাই সমাজে বসবাসকারীদের স্বার্থরক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে । প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের পার্থক্য আরো ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে । প্রতিটি সমাজব্যবস্থা সবসময়ই কিছু গোষ্টীর স্বার্থরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে ।
যদিও পারফেক্ট সমাজ ব্যবস্থা আমরা কখনোই পাব না । কারন কোন সমাজব্যবস্থাই সমাজে বসবাসকারীদের সমান সুযোগ সুবিধা দিতে পারেনি ও আগামীতেও পারবে না । তাই গনতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্রের ছদ্ধাবরনে যখন শাসকশ্রেনী তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় আমাদের উপরে নানা ধরনের নিয়মকানুন চাপিয়ে দিতে চাইবে , তখন আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে ।