পাহাড়ের কাছে এলে মনে হয়
একাকী দাঁড়িয়ে থাকি
পাড় ভাঙা শেষে নদী যেন বলে
নৌকা ডুবিটা বাকি!
নদী না পাহাড় কার কাছে আছে
মুগ্ধতা ভরপুর?
মাঝখান থেকে হাতছানি দেয়
মুগ্ধ অচিনপুর
স্মৃতি না স্বপ্ন কোনদিকে যাব?
দুটোই সমান দূর!
_ভালোবাসতে গেলে এই এক সমস্যা। যে কোনো একদিকে আপনাকে যেতেই হবে। কবি আবুল হাসানের ভাষায় মানুষ যদিও বিরহকামী তবে তার মিলনই মৌলিক। ভালোবাসার শুরুতে মিলনটা স্বপ্ন। আর ছ্যাকামাইসিন কিংবা বিরহের ব্যাপারটা দীর্ঘশ্বাসজনিত স্মৃতি। কথায় আছে নো রিস্ক নো গেইন। যে কোনো একদিকে যাবার রিস্ক আপনাকে নিতেই হবে। কিনটনের মতো যিনি এই রিস্ক নিতে পারেন তিনি বাগদাদে বোমাও ফেলতে পারেন। হেলেন আর মনিকার মধ্যে পার্থক্য এই যে, হেলেনের জন্য ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল কিন্তু মনিকার জন্য বাগদাদ আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র। তবে জর্জ ডবি্লউ বুশের সমস্যা হলো তার কোনো মনিকা নেই। তাকে কি মাঝখান থেকে হাতছানি দিয়েছিল 'মুগ্ধ অচিনপুর' হিসেবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইরাক?
কি জানি বাপু। কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতার বইয়ের নাম আছে 'ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব!' যদি তাই হয় ইরাকিদের ফতুর হওয়া দেখে যে কারো মনে হতে পারে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে মেধাহীন প্রেসিডেন্ট বুশের চেয়ে বড় কোনো প্রেমিক নেই পৃথিবীতে।
লাড্ডু ও বাকরখানি : প্রেমের খাদ্য ঃ
পুরনো ঢাকায় আমার এক প্রেমিক বন্ধু থাকেন। এ পর্যন্তএক ডজন প্রেম করেছেন। তার ভাষায় তার সবগুলো প্রেম ছিল বড় প্রেম। বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। সুতরাং তার মিলন বা বিয়ে হয়নি। আসল ঘটনা হচ্ছে তার প্রেম কাহিনী জানাজানি হয়ে যাওয়াতে তাকে কেউ বিশ্বাস করে না। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছি এই বলে যে, বন্ধু আপনার তের নম্বর প্রেমটা হোক ছোট প্রেম। আসা করি সেটা আনলাকি হবে এবং আপনি বিয়ে করতে পারবেন। যাই হোক, আমার সেই বন্ধু একযুগ ধরে সকালের নাস্তা করেন বাকরখানি ও লাড্ডু দিয়ে। তার মতে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খানের পালকপুত্র আগাবাকের (যার নাম অনুসারে বাকেরগঞ্জ নামটা হয়েছে) ও খনি বেগমের প্রেমের কোনো তুলনা হতে পারে না। খনি বেগমের জন্য আগা বাকের উজীরপুত্রকে যুদ্ধে পরাজিত করেছে, বাঘের সঙ্গে লড়েছে। তারপরও সে খনি বেগমের মৃতু্যকে এড়াতে পারেনি। বাকেরগঞ্জের কোনো এক নদী তীরে খনি বেগমের সমাধি তৈরি করে আজীবন তার জপ করেছে মি. বাকের। সুতরাং প্রেমের খাদ্য হিসেবে বাকরখানি খাবারটার নাম নাকি তাদের নাম থেকেই এসেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে বেরসিক বাকেরগঞ্জ বা বরিশালবাসীর এই খাবারের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কোনো তুলনা থাকতে পারে না। আর নাড্ডু হচ্ছে দিল্কি্নকা লাড্ডুর উত্তরসূরি। না খেয়ে পস্তানোর চেয়ে খেয়ে পস্তানোই ভালো।
হাল আমলের ভেজাল বিরোধী আন্দোলনের নায়ক ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা। যদি লাড্ডু ও বাকর খনিকে প্রেমের নির্ভেজাল খাদ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেন, তাহলে দারুণ ভালো হয়। আমার সেই পুরনো ঢাকার বন্ধুটি কালেভদ্রে বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট খান। তার মতে ব্যানসন অ্যান্ড হেজেস নামটিও এসেছে একটি জনপ্রিয় প্রেম কাহিনী থেকে। আমি সেই বন্ধুটিকে বলি, প্রেম কাহিনী থেকে কোনো সিগারেটের নাম নেয়া হলে কিংবা দেবদাস নামে কোনো মদ থাকলেই সেটা খেতে হবে নাকি? দেবদাস কিন্তু কম যুবকের জীবন নষ্ট করেনি!
ভালোবাসা বনাম উৎপাদন ঃ
তাজমহল দেখে আজ যারা সম্রাট শাহজাহানকে মহান প্রেমিক ভাবেন, তাদের বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি প্রায় মধ্যবয়স্ক সম্রাট এক কিশোরী মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে বসতে বাধ্য করেছিলেন। 1612 সালে সম্রাট শাহজাহান 13-14 বছরের কিশোরী আরজুমান্দ বানুকে বিয়ে করেন। পরবতর্ী 17 বছরে এই আরজুমান্দ বানু মাত্র 14টি সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়েই 1629 সালে মারা যান আরজুমান্দ বানু যিনি ইতিহাসে মমতাজ মহল নামেই বেশি পরিচিত।
সম্রাট শাহজাহান একালে জন্মালে হয়তো ফতোয়া দিতেন যে, পরিবার পরিকল্পনা হারাম। অথবা তিনি জনশক্তি উৎপাদন মন্ত্রীও হতে পারতেন। এই মহান প্রেমিক সম্রাট তার আপন বোনের প্রেমিককে গরম পানিতে চুবিয়ে মেরেছিলেন!
হায় ভালোবাসা মরে যায়, উৎপাদন কমে না।
পরকীয়া ঃ
ভালোবাসতে যেন চিরকালই নারী ও পুরুষ পরস্পর বিরোধী প। গন্ধম খাওয়ার জন্য আজো হাওয়াকে এককভাবে দায়ী করা হয়। টয় নগরী ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় হেলেনকে। তারই ধারাবাহিকতায় আজো বলা হয় নারী নাকি এমন চিজ যা ঈশ্বরও বোঝেন না। এর অন্তর্গত কারণ বোধ করি এই যে এসব রচনা করেছেন পুরুষরাই।
তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেম কাহিনী যেমন লাইনী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা, সোনালি-ত্রিস্তান, রোমিও-জুলিয়েট, হেলেন-প্যারিস, অরফিউস-ইউরিদাইস, রাধা-কৃষ্ণ, কিওপেট্রা-এন্থনি এসবের কাহিনী পুরোমাত্রায় বিয়োগান্তক। বিচ্ছেদ বা বিরহেই মানুষ আসলে বেশি ভালোবাসে। জনপ্রিয় প্রায় সব চলচ্চিত্র, নাটক, উপন্যাস, গল্প, মহাকাব্য বা গান কিন্তু বিরহনির্ভর। যদিও কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন- মানুষ যদিও বিরহকামী, তবে তার মিলনই মৌলিক! বিরহ জনপ্রিয় হোক তি নেই, গল্প কাহিনীতে টিকে থাকুক ক্ষতি নেই, বিরহের ভয়ে প্রেম-ভালোবাসা কী বাদ থাকবে? কখনো না। নির্মলেন্দুগুণ তো তাই বলেই দিয়েছেন 'আমি কি ডরাই সখি ভালোবাসা ভিখিরি বিরহে?'
তবে আশ্চর্যের ব্যাপারটা অন্যখানে। খ্রিস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ইসলাম ধর্মে উল্ল্নেখ থাকা ইউসুফ-জুলেখার ঘটনা হিন্দু মিথ থেকে নেয়া রাধা-কৃষেষ্ণর ঘটনা আর গ্রিক মিথ থেকে পাওয়া হেলেন প্যারিস কিংবা কিওপেট্রা-এন্থনির প্রেম কাহিনীগুলো কিন্তু পরকীয়া প্রেমের কাহিনী। তাহলে কি পরকীয়া প্রেমের স্ট্বাদটাই আলাদা?
বাসনা পূর্ণ হবে সাধনেঃ
প্রথম দেখায় যে কাউকে ভালো লাগতেই পারে। ফুল, পাখি, নদী বা চাঁদ ভালো লাগার মতো। ফুল ভালো লাগে তাই বলে আমরা হয়তো প্রতিদিন ফুল কিনি না। ভালো লাগা বা আরাধ্য মানুষকে অনুভূতি দিয়ে ধারণ করতে গিয়েই শুরু হয় ভালোবাসার প্রথম পর্ব। এর সঙ্গে সাধনা ও শরীর যুক্ত হলে তাকে প্রেম বলা যায়। কেউ কেউ পতিতার কাছে যায়। সেখানে প্রেম থাকে না একবিন্দু, থাকে নিখাদ জৈবিকতা। তবে সবচেয়ে পবিত্র প্রেমের নাম দেশপ্রেম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষ চাঁদকে সাক্ষী রেখে প্রেম কিংবা বিয়েও করে ফেলতে পারে। চাঁদকে কিন্তু ছোঁয়া যায় না। কেউ কেউ নদীর জল ছুঁয়ে কথা দেয়। জল কিন্তু জলের জায়গায় থাকে না। বয়ে চলে! আজকাল ডিজুস প্রেমে সাধনার ব্যাপারটা নেই বললে চলে। প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রস্তুত করা, যুগোপযোগী কিংবা স্মার্টভাবে গড়ে তোলা, প্রেমিকার সবকিছুতে শেয়ারিং এ সবকিছু কমে আসছে। বাড়ি বদল, সিমকার্ড বদল, পোশাক বদলের মতো আজকাল তাই খুব সহজেই বদলে ফেলা যায় প্রেমিক বা প্রেমিকাকে। যাই হোক লাইলী-মজনু থেকে একটি ঘটনার উল্ল্নেখ করা যায়। মজনু একদিন খুঁজতে বেরিয়েছে লাইলীকে। সে ছুটছে আর লাইলী লাইলী জপ করছে। এক মসজিদের সামনে দিয়ে মজনু যাচ্ছিল। মসজিদে চলছিল জিকির। হঠাৎ এক লোক মসজিদ থেকে বেরিয়ে ডাকতে লাগল মজনু, মজনু। মজনুর কানে সে ডাক পেঁৗছাল না। ওই লোক তার পথ আগলে দাঁড়ালে মজনু থামতে বাধ্য হলো। ওই লোক বলল তুমি কেমন যুবক হে? লাইলীর নাম জপতে জপতে যাচ্ছ অথচ কোনোদিকে খেয়ালই নেই। মজনুর উত্তর ছিল_তুমি তো আল্লাহর ধ্যান করছিলে। আমার লাইলী লাইলী রব তোমার কানে ঢুকল কী করে?
নেই কেন আসল প্রেমিক?
এদেশে এখন 'বীরাঙ্গনা' শব্দটি উচ্চারণ করলে অনেক নারী নেত্রীই রুষ্ট হন। তারা বলেন, 71-এর নির্যাতিত নারী। সেই নারীরা এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন? এদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়ক আছে, স্মৃতিস্তম্ভ আছে, বিমানবন্দর, নিদেনপ েক্ষ মিলনায়তন আছে। মুক্তিযোদ্ধারা নেতা-মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। হতে পেরেছে রাজাকাররাও। কিন্তু 71-এর নির্যাতিত নারীদের খবর কী? কয়জন তারা নাম-পরিচয় গোপন করে বেঁচে আছেন? কতটা কষ্ট নিয়ে তারা তাদের সন্তান বা যুদ্ধ শিশুদের দেশ-বিদেশে পাঠিয়েছেন? লেখালেখি কিংবা এনজিওয়ের ধান্দাবাজি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব আর কোথায় আছে?
সেইসব নির্যাতিত মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেন যেন মনে হয়, এদেশে শহীদ আছেন, বীর আছেন, প্রেমিক কয়জন আছেন আমি জানি না।