ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী, প্রসিদ্ধ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত। কমল দাশগুপ্ত শুধু বাংলা গানের সুরস্রষ্টা নন, তার সুরের নিবিড় পরিচর্যা পেয়েছে হিন্দি, উর্দু, মারাঠিসহ বেশ কয়েকটি ভাষার গান। তিনি ইসলামী গান সুরারোপ করেও সমান খ্যাতি পেয়েছেন। তার সুরে রওশন আরা বেগমের গাওয়া 'হে প্রিয় নবী রাসূল', 'হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে তুমি শুনিতে কি পাও' গান দুটি উল্লেখযোগ্য। প্রথিতযশা এ সঙ্গীতজ্ঞ আধুনিক গানসহ আট হাজারেরও বেশি গানের সুর করেছিলেন। তালিকা থেকে বাদ যায়নি আধুনিক, নজরুলসঙ্গীত, গীত, গজল, ভজন, কাওয়ালিসহ সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা। ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে গ্রামোফোন ডিস্কে তাঁর সুরে গাওয়া বহু গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। গানগুলোর গীতিকার ছিলেন প্রণব রায় এবং কণ্ঠশিল্পী ছিলেন যুথিকা রায়। তার সুর করা সাঁঝের তারকা আমি, আমি ভোরের যুথিকা প্রভৃতি গান আজও সমাদৃত। তাঁর কয়েকটি রাগাশ্রিত, কীর্তনাঙ্গ এবং ছন্দ-প্রধান গানও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত ১৯১২ সালের আজকের দিনে যশোরের কালিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ১০২তম জন্মবার্ষিকী। জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ক্ষণজন্মা এই সঙ্গীত কাণ্ডারিকে।
সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দাগ্রামে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত এবং বড় ভাইয়ের নাম সুবল দাশগুপ্ত। ৪৭ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কামাল উদ্দীন আহমদ নাম গ্রহণ করেন। নাম পরিবর্তন করলেও তিনি কমল দাশগুপ্ত নামেই অধিক পরিচিতি পান। কমল দাশগুপ্তের শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতায়। ১৯২৮ সালে তিনি ক্যালকাটা অ্যাকাডেমি থেকে ম্যাট্রিক এবং পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিকম পাস করেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করায় বিদেশি ভাষার ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহু জনপ্রিয় গানে তিনি সুর দিয়েছেন। ১৯৩৪ সাল থেকে স্বাধীনভাবে কাজী নজরুল ইসলামের গানের সুরারোপ করতে থাকেন। প্রায় তিনশো নজরুলগীতির সুর রচয়িতা ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। উত্তর ভারতের মীরার ভজনে সুরের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণা করে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৩ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব মিউজিক ডিগ্রি লাভ করেন। কমল দাশগুপ্তের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় অগ্রজ অধ্যাপক বিমল দাশগুপ্তের কাছে। পরে দিলীপ কুমার রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ প্রমুখের কাছে তিনি সঙ্গীতশিক্ষা করেন। তিনি বহু আধুনিক বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ঠুমরি এবং ছায়াছবির সঙ্গীতে কণ্ঠদান ও সুরারোপ করেছেন। সুরের রাজ্যে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তার সুরের ভিত্তি ছিল রাগ, এর সাথে বাংলা গানের নানা ধারাকে ভেঙে একত্রে মিশিয়ে দিয়েছেন।
২৩ বছর বয়সে হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গীত-পরিচালক ও সুরকার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন কামল দাশগুপ্ত। কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানীতেও কর্ম সম্পাদন করেন। এছাড়াও তিনি রেডিও অডিশন বোর্ডের প্রধান ছিলেন এবং রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। কমল দাশগুপ্ত ছিলেন প্রথম বাঙ্গালী যিনি উর্দু ভাষায় কাওয়ালি গান পরিবেশন করেন। এইচএমভিতে এক মাসে তিপ্পান্নটি গান রেকর্ড করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রেকর্ডসংখ্যক গানে সুর করার জন্য ১৯৫৮ সালে এইচএমভিতে তাঁর সিলভার জুবিলি অনুষ্ঠিত হয়। কমল দাশগুপ্তের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি শিল্পীর মন পড়তে পারতেন। শিল্পীর গায়কী অনুযায়ী গানের সুর করতেন। গান রেকর্ডিংয়ের আগে তিনি শিল্পীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন। তাই শুধু শিল্পী, সুরকার বা সঙ্গীত নয়, কমল দাশগুপ্তের জাদুকরী কর্মকাণ্ডের সমান অংশীদার ছিল মানসিক প্রসারতা। তিনি নিজে শিল্পীর কাছে যেতেন, চিনতেন, তারপর একসঙ্গে কাজ করতেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার মৌলিক অবদান স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং স্টাফ নোটেশন পদ্ধতির স্বরলিপি স্থাপন। উল্লেখ্য, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের মার্চিং সং ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’-এর সুর তারই দেয়া। এছাড়াও হায়দরাবাদের নিজামের সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ গান তিনি রেকর্ড করেছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেও কমল দাশগুপ্ত প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তার সুর দেয়া ও গাওয়া ‘তুফান মেল’, ‘শ্যামলের প্রেম’, ‘এই কি গো শেষ দান’ চলচ্চিত্রের এই গানগুলো এককালে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। অনেক হিন্দি ছায়াছবিতেও তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তিনি প্রায় ৮০টি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমেরিকার ‘ওয়ার প্রপাগান্ডা’ ছবির নেপথ্য সঙ্গীতেও তিনি কাজ করেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তার শেষ ছবি ‘বধূবরণ’। এই মহৎ শিল্পীর অবদান ও তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী’ তাঁকে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত করেন। এক বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। অর্থের প্রতি কোন মোহই ছিলনা তাঁর। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও দুঃখীজনের বন্ধু। ১৯৪৩ সালে সারা ভারতবর্ষ যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত তখন কলকাতায় তুখা নাঙ্গা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন কমল দাশগুপ্ত। নিজ খরচে নঙ্গরখানা খুলে প্রতি দিন একশত করে লোক খাওয়াতেন তিনি। তাঁর এই মহৎ প্রচেষ্টা প্রায় মাসব্যাপী অব্যাহত ছিল। এ দেশের সন্তান কমল দাশগুপ্ত এক বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে ১৯৬৭ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে দেশের মাটিতে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর সে প্রত্যাশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নিদারুণ হতাশা ও দুঃখ দৈন্যর মধ্য দিয়েই এ সময়কার (ঢাকার) দিনগুলি অতিবাহিত হয়েছে কমল দাশগুপ্তের। জীবিকার অন্বেষণে অর্থের প্রয়োজনে ঢাকার হাতিরপুলে ‘পথিকার’ নামে একটি ছোট স্টেশনারী দোকান খুলেছিলেন তিনি।
সঙ্গীত জগতের এক বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। কিন্তু এদেশে অনাদরে অবহেলায় এই প্রতিভাধর পুরুষের জীবনে মৃত্যু ঘটে মৃত্যুর বহু পূর্বেই। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই প্রায় অযত্নে-অবহেলায় ও বিনা চিকিৎসায় ঢাকার পি, জি হাসপাতালে চিরমৃত্যু হয় তার। মৃত্যুৃর পরে ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৫৫ সালে ৪৭ বছর বয়সে ধর্মান্তরিত হয়ে বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম নজরুল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ফরিদপুর জেলার খান বাহাদুর ইসমাইল হোসেনের কন্যা ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত। তাঁদের সংসারে তিন সন্তান - তাহসিন, হামীন ও শাফীন রয়েছে। আজ কমল দাশগুপ্তের ১০২তম জন্মবার্ষিকী। সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তের জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৫৫