বিয়ে
মো: হেলাল হোসেন
কেয়া উচ্চ শিক্ষিত স্বনামধন্য পরিবারের মেয়ে সে এবার অর্নাস পাশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাধে সে অনেক স্মার্ট, সে কারো কথায় কান দেয় না ,তার মন যখন যেটা চায়, সে সেটা করে। বাসা থেকে তার বিয়ের কথা হচ্ছে। তার অবশ্য নিজের তেমন পছন্দ নেই কারণ সে তার যোগ্য কাউকে মনে করে না , আর এর জন্য সে এত দিনেও একটা প্রেম করতে পারেনি। অনেক ছেলে তার প্রেমে পড়েছে, সেও পাত্তা দিত কিন্তু ছেলে গুলো কয়েক দিন পর কেটে পড়তো স্বাভাব দেখে, সে চায় সকলকে তার মত চালাতে, যে তার কথা শোনে না সে তার ধার দিয়ে চলে না।আর এর জন্য তার প্রেম আর টেকসই হয়নি। এটা নিয়ে তার কোন আফছোস নেই ,সে নিজের অহংকার নিয়ে ভালোই আছে। তার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে সরকারি কলেজের প্রভাষক, নতুন চাকুরি পেয়েছে। শহরে তার কোন বাড়ি নেই । মেসে থাকে, বিয়ে ঠিক হলে একটি বাসা ভাড়া নিবে।গ্রামে তার মা এবং একটি ছোট বোন আছে, বাবা মারা গিয়েছে অনেক আগে।কেয়ার বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মনে করেন জীবনে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত তিনি নেননি ,আর বাকী জীবনে নিবেন না। তার মেয়ে যেহেতু অংককারী এবং জেদী তার জন্য সহজ সরল একটি পাত্র দরকার। আর এই জাহিদ হল সেই উপযুক্ত পাত্র। জাহিদ যেদিন প্রথম কেয়াকে দেখতে এলো সে দিন কেয়ার বাবা জাহিদের সাথে প্রায় ৪ ঘন্টা আলাপ করেছিলো ,জাহিদের সাথে আসা তার কলিগ ২ ঘন্টা পরেই চলে গিয়েছিল। এর পর রাত হয়ে গেল তাই জাহিদকে বিয়ের আগেই তার হবু শ্বশুর বাড়িতে রাত কাটাতে হল। জাহিদ লেখা পড়ায় ফাঁকি দেয়নি কোন দিন, তাই তার জ্ঞান সীমা হীন, সে এখনো প্রতি সপ্তাহে দুটি করে বই পড়ে শেষ করে । তাই জগতের বেশির ভাগ বিষয়ে সে অবগত । যদিও আধুনিককতা তাকে এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। সে ঠেলা ঢুলা জামা কাপড় পরে । তাকে দেখতে শিক্ষক এর মত লাগে সব সময়। কেয়া তাকে এক পলক দেখেই না করে দিয়েছে ,সে বলেছে এমন গেঁওয়া এবং আনস্মার্ট ছেলেকে সে বিয়ে করবে না ,শহরে তার বাড়ি নাই গাড়ি নাই তার সাথে বিয়ে করে সে সুখী হতে পারবে না। কেয়া এই কথা তার বাবাকে বলতে সাহস পাচ্ছে না তাই মা কে বলে দিয়েছে তার মা তাকে বুঝিয়েছে তোর বাবার সাথে যখন আমার বিয়ে হয় তখন তার কিছু ছিল না শুধু চাকুরি ছাড়া এর পর আজ দেখ আমাদের সব হয়েছে, তোরও হবে । মানুষ এক দিনে বড় হয় না তার কোন ঝামেলা নেই বোনটা বিয়ে দিলে থাকে শুধু মা সে আর বা কত দিন বাঁচবে। তুই রাজি হয়ে যা মা। কোন মানুষকে একদিনে ভালো লাগে না, তার সাথে চলতে ফিরতে দেখবি ভালো লাগবে । তুই এক কাজ কর সামনের শুক্রুবার ওর সাথে বের হ। সারাদিন একসাথে ঘুরবি দেখবি এভাবে ওকে ভালো লেগে যাবে। কেয়া কোন অবস্থায় রাজি না ,তার পরও তাকে যেতে হবে। শুক্রবার তারা বের হল কেয়া চাইছিল ভালো কোন রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করতে অথবা একটি প্রাইভেট কারে করে লং ড্রাইভে যেতে যেতে কথা বলতে, কিন্তু জাহিদ রাজি হল না । সে বলল তোমরা শহরের লোক হলেও শহরের অনেক কিছু তোমরা দেখনি। চল রিকসায় করে ঘুরবো আর পার্কে বসে বাদাম খাবো। কেয়া সবসময় গাড়িতে চলাফেরা করে তাই রিকসায় তার তেমন চড়া হয় না। রিকসায় চড়তে একেবারে খারাপ লাগছে না, তাবে পাশে একটি অচেনা লোক বসে আছে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে এটা তার খুব একটা ভালো লাগছে না। কিন্তু লোকটা যে অনেক কিছু জানে এটা সে বুজতে পারছে । কেয়া জবাব দিচ্ছে না তাই জাহিদ রিকসাওয়ালার সাথে কথা বলছে । তারা পার্কে চলে এসেছে জাহিদ বাদাম কিনে এনেছে সে বিট লবন দিয়ে বাদাম খাচ্ছে, মনে হচ্ছে কোন সে অমৃত খাচ্ছে কিন্তু কেয়ার পার্কে বসে এভাবে বাদাম খেতে ইচ্ছে করছে না। এর মাঝে একটি ছোট ছেলে ছুটে এসে জাহিদের গলা জড়িয়ে ধরলো, ছেলেটি বলল স্যার আপনাকে অনেকদিন দেখিনি, জাহিদ বলল মাত্র তিন দিন দেখনি সেটা কি অনেক দিন হল? স্যার আমি পড়ালেখা শুরু করেছি আর আপনার দেওয়া জামাটা সবসময় পরিনা ওটা শুধু স্কুলে যাওয়ার সময় পরি, জাহিদ ছেলেটিকে দশটি টাকা দিয়ে বলল তুমি যাও এখন আমি ব্যস্ত আছি। কেয়ার এ সব ভালো লাগছে না, সে সহজে মেনে নিতে পারছে না , জাহিদ সেটা বুঝে তাকে অন্য যায়গায় নিয়ে গেল। জাহিদ বলল বিয়ের পর আপনাকে চাকুরি করতে হবে কেয়া কথা শুনে অবাক হল , সে মনে মনে ভাবছে বিয়ের আগেই এসব কথা না জানি বিয়ের পরে আরো কি বলে ।সারা বিকেল ঘুরে তারা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরে কেয়া জানিয়ে দিল জাহিদকে বিয়ে করার মত কোন কারণ সে খুঁজে পায়নি । ছেলেটি সাধারণ তার এই অতি সাধারণ চলাফেরা তার ভালো লাগে না।কেয়ার মা কেয়ার বাবা কে বলল আমরা আরো কিছু ছেলেতো দেখতে পারি, এই ছেলে তো হাতে আছেই তাহলে সমস্যা কি? কেয়ার বাবা বুঝলেন তার মেয়ে জাহিদকে পছন্দ করেনি কি আর করা ,তিনি অন্য ছেলে দেখতে থাকলেন । নতুন ছেলে পাওয়া গেছে ব্যবসা করে , ছেলের বাবা পুরাতন ব্যবসায়ী । ছেলে এখন সেই ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছে। ছেলের নাম সালমান চৌধূরি বিদেশ থেকে পড়া লেখা করে এসেছে। সালমানের সাথে কেয়া দামী গাড়িতে বের হল। সালমান তাকে ফাইভ ষ্টার হোটেলে নিয়ে গেল সেখানে তারা বেশ সময় কাটালো , সালমান সামান্য ডিং করে। আসার সময় সালমান কেয়ার হাত ধরলো কেয়া সাড়া না দেওয়ায় সে আর বেশি দূর এগুলো না। কেয়া এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না কাকে বিয়ে করবে । জাহিদ কেয়ার জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছে। অনিচ্ছা সহিত সে চিঠি নিল ,ভাবলো পড়বে না, না নিলে মা রাগ করবে তাই নিল। রাতে কেয়া ঘুমানোর আগে ভাবলো দেখি না এক বার কি লিখেছে চিঠিতে, এই বলে সে চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে থাকলো
কেয়া, কেমন আছেন আপনি ?
চিঠিতে নামের আগে কোন একটি শব্দ ব্যবহার করা উচিত কিন্তু আমি করিনি কারণ আপনি এখনো আমার তেমন কেউ নন। আমি জানি আপনি আমাকে নিয়ে ঝামেলায় আছেন ,কারণ আপনার পরিবার চাইছে আমার সাথে আপিনার বিয়ে হোক আর আপনি সেটা চাইছেন না। এটা আমার কোন মেয়েকে লেখা প্রথম চিঠি। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন দেখেছি আমার এক চাচাতো ভাই প্রেমের কারণে মারা যায়। আমার চাচাতো ভাই ছিল বেকার আর সে আমাদের গ্রামের একটি মেয়ের সাথে প্রেম করতো সেই মেয়ের বাবা আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দেয়নি, কারণ আমার ভাই বেকার ছিল , সেই মেয়েকে অন্য এক চাকুরিজীবীর সাথে বিয়ে দেয় এই কষ্টে আমার ভাই বিষপান করে মারা যায় ঐ মেয়েটাও এই খবর শুনে গলায় দঁড়ি দিয়ে মারা যায়। সেই থেকে আমি পণ করি জীবনে প্রেম করবো না, আর যদি করি তো বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে করবো। তাই এই জীবনে প্রেম করিনি যার জন্য বন্ধুদের কাছে অনেক কথা শুনেছি। যাক ওসব কথা ।বই আমার জীবনের পরম বন্ধু আমি দিনের বেশিরভাগ সময় বই পড়ি তাই নিজেকে কখনো একা মনে করি না। আমার আফছোস মেয়েদের এই অভ্যাস নেই তারা জীবন যুদ্ধ করতে জানে না তারা সমরেশ মজুমদারের সাত কাহন পড়েনি তারা দীপাবলীর জীবনযুদ্ধ জানে না তারা হুমায়ুন আহমেদের হিমু,শুভ্র,মিসির আলীর কথা জানে না।তারা হুময়য়ুন আহমেদের নাটকগুলো দেখেনি, যাক চিঠিটাকে আমি বিরক্তিকর করে তুলছি। ওসব বাদ আপনাকে শেষ কিছু কথা বলি সেদিন পার্কে যখন ছেলেটি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল আপনি সেটা ভালো ভাবে নেননি , তাহলে শুনুন ঐ ছেলের কথা, আমি একদিন পার্কে বসে বই পড়ছি এমন সময় ঐ ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমি ওকে ডেকে বলি কাঁদছো কেন?সে বলে ভাত চাইছিলাম তাই মা মেরেছে । আমি ওকে হোটেলে ভাত খাওয়ায়, ছেলেটি সকালে শুধু একটি রুটি খেয়েছে আর তখন বাজে বিকাল ৪ টা । এরপর ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যায় ,ওর মায়ের বয়স বেশি না, আমি ছেলেটির মাকে বলি তাদের সমস্যা কি? ওর মা বলে আমি প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম আমার বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি ওর বাপ একবছর আগে আর একটি বিয়ে করে চলে গেছে ঐ মহিলার কোলে ছোট আর একটি মেয়ে আমি হতবাক হলাম তারা সুখের জন্য বিয়ে করেছিল আর সুখ তাদের কপালে জুটলো না ,আমি ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করি আর মহিলাকে অফিস ও বাসা বাড়িতে কাজের কথা বলি ঐ মলিলা ছোট বাচ্ছাকে ছেলের কাছে রেখে বাইরে কাজ করে । আপনি আমাকে যতখানি সহজ সরল ভাবেন আমি তেমন নই ,আমি মানুষ হবার চেষ্টা করি, ভান করা আমার স্বভাব না। আমি মানুষকে খুশি করতে কোন অভিনয় করতে পারি না। আমি বলেছিলাম আপনাকে চাকুরি করতে হবে ,আপনি মনে হয় বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি ,আমি আসলে জীবনের বাস্তবে বিশ্বাসী , মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকে না ধরেনিন আমার সাথে আপনার বিয়ে হল, এর কিছুদিন পর একটি বাচ্চা হবার পর আমি মারা গেলাম তখন আপনার কি হবে? আর বাচ্ছার কি হবে? আপনি্ উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন এখন বসে থাকা মানে রাষ্ট্রের উপর বোঝা হয়ে থাকা।চাকুরি করলে কারো উপর আপনার নির্ভরশীল হতে হবে না । আমি আপনাকে সমরেশ মজুমদারের বৃষ্টিতে ভেজার বয়সের কুহিলীর মত করে চাইনি। আমার স্বপ্ন ছিল আমি আমার বউকে খুব ভালোবাসবো ,কলেজ থেকে ফিরে বিকেলে বউকে নিয়ে ছাদে যাবো তার চুল আছড়ে দিব চুলে তেল মেখে দিব ,চাদনী রাতে তাকে নিয়ে সারা রাত ছাদে বসে জোছনার আলো মাখবো গায়ে। চাকুরি শেষ হলে গ্রমের বাড়ি চলে যাবো সেখানে বড় একটি দোতলা বাড়ি করবো বাড়ির মধ্যে ফলের ও ফুলের বাগান থাকবে, সান বাধানো পুকুর থাকবে। পুকুর ধারে একটি টিনের ঘর থাকবে বৃষ্টির দিনে আমরা টিনের চালের নিচে বসে চা হাতে বৃষ্টি উপভোগ করবো , পুকুরে দুজন জলকেলি খেলবো ,যাক ওসব কথা, এসব কথা জানি আপনার ভালো লাগবে না।শহুরে মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছা আমার ছিল না কিন্তু কেন যে আপনার সাথে দেখা হল ? আপনার সাথে রিকসায় ঘুরেছি পার্কে বসেছি এটা মনে পড়লে খারাপ লাগছে ,কারণ আমি যাকে বিয়ে করবো সে এসব শুনলে সারাজীবন আমাকে এটা বলে রাগাবে, আমি সামনের সপ্তাহে গ্রামে যাচ্ছি বিয়ে তো করতে হবে তাই আর কি, আপনি ভালো থাকবেন এই দোয়া করি।
কেয়া চিঠিটা একরাতে দশবার পড়লো, সে কখনো এভাবে ভাবেনি সে লক্ষ করলো জাহিদ তার হাত ধরেনি তার দিকে চেয়ে থাকিনি কিন্তু সালমান তার হাত ধরেছে চোখ দিয়ে তাকে গিলে খেয়েছে। কেয়া বাস্তবিক জীবনে ফিরে এলো সকালে সে তার মাকে বলল জাহিদের সাথে তার বিয়ে ঠিক করতে সে রাজি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২১