somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ : অন্য মূল্যায়ন

১৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




তাঁর জন্মশতবর্ষে এসে উত্তরসূরিদের এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা এককভাবে আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। কারণ তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর। অথচ কবিতার খাঁটি শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। এর কারণ হয়তো এই, কবিরা তাদের পাঠ, দেখা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল তাদের কবিতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেন। ক্বদাচিৎ গদ্যচর্চা করলেও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের মধ্যে কবিতার মতো সমান বা তীব্র সাধনা খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর। কিংবা কবির গদ্য হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তার সেই অবশেষ, যা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না বলে গদ্যের আশ্রয় নেন। অথবা সেগুলো হয়তো উপলরক্ষের লেখা।
কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসুর শিল্পচর্চার অপরাপর মাধ্যমও যে সমান তীব্র এর প্রকৃষ্ট প্রামাণ্য তার প্রবন্ধ ও অনুবাদসকল। তিনি তার কবিতার সমান তাড়না নিয়েই অসামান্য সব গদ্য লিখেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর বহু অনুবাদ করেছেন।
আমরা যখন তার অনুবাদে বোদলেয়ারের বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তিগুচ্ছ পাঠ করি :
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে... ঐ উঁচুতে...
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
অথবা,
আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,
যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।

কিংবা হ্যেল্ডার্লিন থেকে :
তবে এসো, মধুর, কোমল সুপ্তি! হৃদয়ের অভিলাষ
অত্যধিক, অসম্ভব। কিন্তু শেষে, হে যৌবন, অস্থির, স্বপ্নিল,
তুমিও হারাবে তাপ, আর ধীরে বার্ধক্য আমাকে
দেবে শান্তি, সান্ত্বনা, বিরাম।

কিংবা রিলকে থেকে :
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শূন্য থেকে ঝ`রে প`ড়ে যায়,
যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ`লো অনেক বাগান;
এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।
এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,
নত্রশৃঙ্খল ছিঁড়ে-- নিঃসঙ্গতায়।

আমরাও ঝ`রে যাই। এই হাত-- তাও পড়ে ঝ`রে।
দ্যাখো অন্য সকলেরে : সকলেই এর অংশীদার।


কিংবা পাস্তারনাক থেকে :
তোমার কঠিন পণ ভালোবাসি আমি,
আমার ভূমিকার অভিনয়ে আছি সম্মত।
কিন্তু এবার এক ভিন্ন পালা শুরু হ`লো;
এই একবারের মতো দাও আমাকে নিষ্কৃতি।

কিন্তু অঙ্কগুলির পারম্পর্য অনড়
আর পথের শেষ আমাকে মুক্তি দেবে না;
নিঃসঙ্গ আমি; সব ডুবে গেলো ধর্মান্ধের শঠতায়।
মাঠ পেরোনোর মতো সহজ নয় বেঁচে থাকা।

তখন এইসব অসামান্য ও সপ্রাণ পঙ্ক্তিগুচ্ছ আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন, প্লাবিত, মুগ্ধ করে যে, মনে হয় কোথায় অনুবাদ, কোথায় বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রিলকে বা পাস্তারনাক-- এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুরই এক অন্তর্গত প্রগাঢ় স্বর। এর কারণ সম্ভবত একটাই, বুদ্ধদেব অনুবাদেও তার কবির চৈতন্যকেই বহাল রেখেছেন। নিজের কবিতার জন্য তিনি যে অপত্য স্নেহ লালন করেন, অন্য ভাষার, সুদূরের, অন্য সময়ের কবির কবিতার প্রতিও একই মমত্ব পোষণ করেন। আর এটা বড় পষ্টভাবেই অনুভব করা যায় তার করা অনুবাদ বইগুলির ভূমিকাসকল পাঠ করলে (যেমন : কালিদাস, বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন, রিলকে)। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি, বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক। এ প্রসঙ্গে তার নিজেরই এক ধরনের স্বীকারোক্তি রয়েছে কোনো এক গদ্যে, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন দিনের পর দিন কবিতা লিখতে পারতেন না, তখন, তার স্বভাবজাত সৃষ্টিতাড়না, অনুসন্ধান ও পাঠস্বভাবহেতু, ভিনভাষী কবিদের কবিতার রস আস্বাদন করতেন এবং কখনো-সখনো অনুবাদ করতেন। এগুলোও অনেকটা তার নিজস্ব কাব্যবন্ধ্যাকালেরই সৃষ্টি, কিন্তু এগুলোর উৎস আর অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বহুমাত্রিক উপাদান নয়, বরং তার পূর্বজ ভিনভাষী কবিদেরই সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো একচক্ষু অধ্যাপক-সমালোচক মনে করেন, তার নিজের কবিতাও নাকি অনেকাংশে এসব কবিতারই অবশেষমাত্র। তবে এমত ধারণার নেপথ্যে বুদ্ধদেব নিজেও খানিকটা দায়ী। কারণ, তিনি অনুবাদেও এত বেশি নিখুঁত, সযত্ন, সহৃদয় আর বাঙালি যে, যদি ওইসব কবির নিজদেশী উপাদান, চরিত্র ও পুরাণকে তিনি যথাযথ ব্যবহার না করতেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকেও তার নিজের কবিতা বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনো পর্যন্ত পশ্চিমকেই উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবি, তাই আমাদের অজান্তেই বুদ্ধদেবকে ছোট করে দেখি। তার সৃষ্টিশীলতা, নিষ্ঠা ও সততার কথা আমাদের মনেই থাকে না। অথচ তিনি তার প্রতিটি অনুবাদ-বইয়ে যেভাবে ভূমিকা ও টীকাভাষ্য দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য যে ধরনের মেধা ও শ্রম তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায় তাকে কী অসাধ্যসাধন করতে হয়েছে। তবে প্রভাবের কথা বলতে হলে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি ঋণ কেবল পশ্চিম থেকেই নেননি, তার মতো সর্বভূক শিল্পসাধক আধুনিক-প্রাচীন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবখান থেকেই তার অন্তর্জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই ইউরোপ থেকে তার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু এই কূপমণ্ডুক জাতির ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা তা হলো তিনি নিজেকেই কেবল ঋদ্ধ করেননি, নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য সেগুলো আমৃত্যু দু হাতে অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এবং নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রগাঢ় শিক্ষক। কারণ বুদ্ধদেব বসুর ব্যাপারটা এমন নয় যে, তিনি মাস্টারির দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের মিশন গ্রহণ করেছিলেন (যদিও তিনি পেশাগতভাবেও জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক! বরং বলা উচিত, ভারতবর্ষে একাডেমিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছে তারই নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে)।
আসলে তার এই শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। `প্রাকৃতিক' এই অর্থে যে, প্রকৃতির যে সূত্রে তিনি কবি, সে অর্থেই তিনি কবিতারও শিক্ষক। এ দায়িত্ব তাকে কেউ অর্পণ করেনি, কিংবা তিনি যে শিক্ষকতা করছেন এই মাস্টারি-মনোভাব নিয়েও তিনি কবিতার শিক্ষকতা করতে নামেননি। বরং বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তার যে স্বভাবজাত স্নান ও ডুব দেওয়া এবং সেখান থেকে তার যে নিবিড় আহরণ, এবং পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষের জন্য সহৃদয়হৃদয়সংবাদী করে উপস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটিই তাকে পরিণত করেছে এক গভীরতর শিক্ষকে।

কবিতা যে কেবল ভাব দিয়ে রচিত হয় না, একটি কবিতার কবিতা হয়ে উঠার জন্য যে অনেকগুলো অভাব মেটাতে হয়, এ কথাটি এই একুশ শতকে এসেও অনেকে বুঝতে চান না। আবার কবিতার জন্য যে শিক্ষা ও দীক্ষা প্রয়োজন এটিও কবি ও পাঠক উভয়েই বিস্মৃত হয়ে পড়েন। শিল্পকলার অপরাপর মাধ্যম যেমন : সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির, কবিতার স্কুল আমাদের দেশে ছিল না কোনোকালে। কিন্তু স্কুল থাক বা না থাক, না থাক প্রশিক্ষণশালা, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আছে, যার মধ্যে অতীত ও আগামীর অপূর্ব মিলন ঘটেছে, যিনি শুধু শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার এক গভীর সমুদ্র ছিলেন না, বরং স্বজাতির জন্য খুব সহজ করে সেসব উপস্থাপনও করে গেছেন, সেখানে কোনো স্কুলের দরকারও তো হয় না। সেগুলো একটু কষ্ট করে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করলেই তো হয়ে যায়। এর বাইরে প্রাচীন-নতুন অপরাপর জ্ঞান-চিন্তা-তত্ত্ব তো আছেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো সে অজ্ঞানতার আঁধার গেল না। আশ্চর্য ব্যাপারটা হলো, এই আক্ষেপ প্রায় সত্তর বছর আগে (১৯৩৮ সালে) বুদ্ধদেব বসু তার এক লেখায় যেভাবে করেছেন, আজও প্রায় একই ভাষায় আমাদেরও আক্ষেপটা করতে হয় (দ্রষ্টব্য : `লেখার ইস্কুল', কালের পুতুল)। এবং এর ফল এই যে, বুদ্ধদেব বসুর মতো দ্রষ্টা-শিক্ষকের কাছে আমাদের ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলে।
এর মানে এই নয় যে, আমরা বুদ্ধদেব বসুদের পর আর এগোইনি। বরং বাংলা কবিতা আরো বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই যে অগ্রগতি (যদিও তা প্রশ্নাতীত নয়, এবং আমাদের কবিতা, বিশেষত তিরিশ ও এর পরবর্তী মূলধারার কবিতায় পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে যে বিতর্ক, তার কথা মনে রেখেও), তার নেপথ্যে যদি কাউকে যথাযথ শিক্ষকের অভিধা দিতে হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই দিতে হবে বুদ্ধদেব বসুকে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যেমন নতুন সম্ভাবনায়, চিন্তায়, ভাষায় আরো উত্তুঙ্গতায় পৌঁছে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছেন, আর সেই দরোজায় তার সমসাময়িক ও উত্তরকালের কবি-সমালোচক-পাঠকের অবাধ প্রবেশ করার জন্য যিনি সবচে বেশি জীবনপাত করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেড় দশক আগে উচ্চারিত বাংলা কবিতার নীরব সাধক পঞ্চাশের দশকের কবি আজীজুল হকের একটি মৌখিক উক্তি : তিরিশের কবিতা যে আজকের বাংলা কবিতার মূলধারা, তা যতটা সে সময়ের কবিদের কবিতার জন্য, ততটাই এর সপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি-গদ্যকারদের নিরন্তর গদ্যরচনার জন্য।
আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, যখন এমনকি রবীন্দ্রনাথও ঠিক তাঁর প্রতিভা বুঝে উঠতে পারেননি, বরং তার কবিতা সম্পর্কে দায়সারাভাবে বললেন `তোমার কবিতায় তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে', `শব্দ নিয়ে এত জবরদস্তি করো কেন বুঝিনে', তখন তরুণ বুদ্ধদেব বসুই প্রাথমিক জীবনানন্দকে গভীরভাবে আবিষ্কার করলেন এবং জীবনানন্দের বহু সাহিত্যশত্রুর বিরুদ্ধে প্রায় একাকী কলম চালিয়ে তাকে সাহিত্য-অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। `প্রাথমিক জীবনানন্দ', কারণ, বুদ্ধদেব বসু, পরিণত জীবনানন্দ দাশকে কখনো কখনো ভুল পাঠ করেছেন, বিশেষত, বুদ্ধদেব ধূসর পাণ্ডুলিপি-বনলতা সেন পরবর্তী জীবনানন্দর ওপর অজ্ঞাত কারণে খুব নাখোশ হয়েছিলেন এবং জীবনানন্দকে রীতিমতো আক্রমণ করে লিখেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে আবার তিনি তার আস্থা ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষণিক এই ভ্রান্তির কারণে তার অবদান খাটো হয়ে যায় না, কেননা, জীবনানন্দ দাশের জন্য তার যে একক শ্রম, তা এখনো অনেক জীবনানন্দ-গবেষকের চেয়েও বেশি এবং জীবনানন্দর কবিতার ক্ষেত্রে তার অনেক বিশ্লেষণ চিরন্তনতার মাত্রা পেয়ে গেছে।
একইভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার বহুমাত্রিক ও আবিষ্কারধর্মী নানা মূল্যায়ন অনেক ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব। তিনি যে বললেন,
`বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হ`য়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে-মাংসে মিশে আছেন; তাঁর কাছে ঋণী হবার জন্য এমনকি তাঁকে অধ্যয়নেরও আর প্রয়োজন নেই তেমন, সেই ঋণ স্বতঃসিদ্ধ ব`লেই ধরা যেতে পারে-- শুধু আজকের দিনের নয়, যুগে-যুগে বাংলা ভাষার যে-কোনো লেখকেরই পক্ষে। আর যেখানে প্রত্যভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘ`টে যাবে, সেখানেও, সুখের বিষয়, সম্মোহনের আশঙ্কা আর নেই; রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হ`য়ে, বিচিত্র হ`য়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে।'
[`রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক`, সাহিত্যচর্চা]
এই উক্তির মধ্যে ভক্তির চেয়ে পাঠ বেশি, আবেগের চেয়ে দূরদৃষ্টি বেশি। বুদ্ধদেব ১৯৫২ সালে এই উক্তি করার পর আরো পঞ্চান্ন বছর কেটে গেছে। এখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই আমাদের রক্তের গভীরের জিনিস হয়ে উঠেছেন, তাকে ছাড়া আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর চলে না, যেমন করে বাতাস অদৃশ্য হলেও তাকে আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়।

বুদ্ধদেবের ভাষার এমন এক মাধুর্য আছে, আছে এমন এক পেলবতা আর অক্ষরবৃত্তিক গতি, এর মোহ কাটানো বড় মুশকিল। যদিও অনেক সমালোচক তার ভাষার কমনীয়তা ও রমণীয়তা নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু তারা বোধহয় এই কথাটি ভুলে যান যে, এই ভাষার গুণেই তিনি আমাদের প্রতি শিক্ষকতাটি প্রকৃষ্টভাবে করতে পেরেছেন। কারণ, ভাষার এই গুণটি তার না থাকলে আমাদের বঞ্চনার পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়া কমত না এবং তার ভাষার স্বাদই আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যা ছাড়া ওই বিষয়গুলোতে হয়তো আমাদের আগ্রহই জন্মাতো না।
খটখটে পাণ্ডিত্য জিনিসটি হয়তো বুদ্ধদেব বসুর ধাতে কখনোই সইত না। তাই বিষয় যত কঠিনই হোক, বোঝা ও অনুভব করার গুণে সেগুলো তার ভাষায় বাংলাদেশের জল-হাওয়া-মাটির মতোই সহজ ও সজল হয়ে প্রকাশিত হতো, এই মাটির সন্তান হওয়ার কারণে স্বভাবেও আসলে তিনি ছিলেন এমনটিই। এর একটি চমৎকার উদাহরণ, ১৯৫২ সালে রচিত তার একটি বিশ্লেষণী ও আত্মউপলব্ধিমূলক গদ্য `হেমন্ত' (সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা : রবীন্দ্রনাথ)। লেখাটিতে আমরা দেখি, বাংলার একটি অবহেলিত ঋতু বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন বাংলার ঋতুগুলোরই সজীব ইতিহাস। পাশাপাশি ঋতুটিকে ঘিরে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যর প্রকৃতি-সমাজ-সাহিত্যের এক তুলনামূলক বয়ানও হাজির করেন তার অনবদ্য ভাষায় এবং ক্রমাগত নিজেকে খন্ডন করতে করতে তিনি পৌঁছতে চান এই সত্যে যে, হেমন্ত নিয়ে তিনি এতকাল যে মনোভাব পোষণ করেছেন, তা ছিল একপেশে ও খন্ডিত। এই মধ্যবয়সে এসে তিনি এর সত্যিকার রূপ সন্দর্শন করলেন।
অন্যদিকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইউরোকেন্দ্রিকতা ও তিরিশি বিতর্কের অন্যতম অভিযুক্ত নায়ক বুদ্ধদেব বসু। তাকে আক্রমণ করা সহজ, কেননা এই তাত্ত্বিক লড়াইয়ের জন্য নানাভাবে তিনিই সবচেয়ে বেশি উপাদান আমাদের যোগান দিয়ে গেছেন। তাদের পাঁচ নায়কের মধ্যে, তিনিই সাহিত্যের সব শাখায় ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। ফলে তাকে সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব বসুরা যে আধুনিকতা বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন, তা ইউরোপীয় আধুনিকতা। তার যে সময় ও নগরচেতনা তারও কেন্দ্রে আছে ইউরোকেন্দ্রিকতা। রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে যাওয়ার নামে তারা দ্বারস্থ হয়েছেন পশ্চিমের কাছে এবং সেখানকার বহু উপাদান অবলীলায় বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন এই ভূগোলের মাটি-মানুষ-শেকড় ও ঐতিহ্যের কথা ভুলে গিয়ে। ফলে তিরিশ ও এর পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতা, হয়ে উঠেছে, বাংলা ভাষায় রচিত ইউরোপীয় কবিতা। অভিযোগ সঠিক হলেও এ উক্তি যেরকম মোটা দাগে উচ্চারিত হয়, ব্যাপারটা এত স্থূলভাবে দেখার মধ্যে একটু সমস্যা আছে। এই দায় কতটা তাদের, পরবর্তীকালের কবিরাই বা এ থেকে উত্তরণের জন্য কী করেছেন এবং এই সময়ের কবিতাই বা কতটা মোহমুক্ত ও শেকড়সংলগ্ন হতে পেরেছে, এসবেরও প্রকৃত বিচার করা কর্তব্য।
কিন্তু এই তত্ত্বজটিল প্রসঙ্গটি অন্যত্র আলোচনার জন্য তুলে রেখে এবং ইতিহাসের এই দায় থেকে তাদের মুক্তি না দিয়েও বুদ্ধদেব বসুর সপক্ষে কিছু সাধু কথা উচ্চারণ করা বাস্তবসঙ্গত ও ন্যায়োচিত।
বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে উপনিবেশিত হওয়া অনেকটা নিয়তির মতো, যে নিয়তির আগ্রাসনে একদিন ইউরোপই ইউরোপের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল (যেমন : জার্মানদের মধ্য থেকে ইংরেজদের পত্তন, ফরাসি জাতির ইংল্যান্ড আগ্রাসন, ইংল্যান্ডের আয়ারল্যান্ড দখল। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিন্তা ও ভাষাগত আধিপত্য। আপাতত তোলা থাক অন্য মহাদেশে তাদের দখল-হত্যা-লুণ্ঠন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক আধিপত্যর কথা।)। কিন্তু এতো সব নেতি উপাদানের পরও ইউরোপ থেকে তিনি যে শৈল্পিক-মানবিক গুণগুলো আত্মীকৃত করেছেন, সেগুলোর মূল্য না দিলেও বড় ধরনের অবিচার করা হবে। বুদ্ধদেব বসু অন্ধ ইউরোপপন্থি ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের মাত্রাজ্ঞান তার কী মাত্রার ছিল, তার জন্য তার মেঘদূত বইটির ভূমিকাই উৎকৃষ্ট সাী। পরন্তু শিল্পের স্বয়ম্ভুতা, যুক্তির বোধ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের যে তুলাদণ্ড তার প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেজন্য ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রতি তার আগ্রহকে আমরা বরং খানিকটা শ্রদ্ধা জানাতে পারি। কারণ, প্রত্যক্ষ উপনিবেশ লোপ পেলেও আমাদের মনোজগৎ এখনো পশ্চিমা উপনিবেশের দখলে। আজও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের যথেষ্ট কম ও নিজস্ব জ্ঞান-ঐতিহ্য-সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের চেতনবোধও পশ্চিম থেকেই আমদানিকৃত। যথেষ্ট পরিমাণ ইংরেজি জানা এবং ততটাই কম মাতৃভাষা জানা আমাদের শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যর উচ্চ মানদণ্ড। অন্য ভাষার সাহিত্য ইংরেজি অনুবাদে পেলে আমরা যতটা উল্লসিত হই, সরাসরি বাংলায় অনুবাদ হলেও আমরা ততটা উৎসাহী হই না। পশ্চিমের ডিগ্রি এখনো মহার্ঘ্য ও পূজনীয় বস্তু। তাদের বহুমুখী আধিপত্য এখন বরং উপনিবেশ আমলের চেয়ে বহু গুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু বরং উপনিবেশকালের মানুষ হয়েও এতটা গদগদ ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের একটা নিজস্ব প্রক্রিয়া তার ছিল, যা পক্ষান্তরে স্বদেশ ও ভাষার পক্ষে অনেক অনুকূল ছিল। এ দিক থেকেও তিনি পরোক্ষভাবে আমাদের একজন অন্তর্গত শিক্ষক। অন্যদিকে উদারতা বুদ্ধদেব বসুর একটি বড় গুণ। যেটা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি শিল্পগত ক্ষেত্রেও। কারণ তিনি যেভাবে তার পূর্বসূরি বা সমসাময়িক কবিদেরই নয়, বরং উত্তরসূরি কবিদেরও ক্ষান্তিহীনভাবে মূল্যায়ন আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন, এটা এখনকার দিনে খুব বিরল ঘটনা। বরং এখনো আমরা অনেক বেশি আত্মপর। মূল্যায়ন তো পরের কথা, সমকালীন সতীর্থদের পাঠ করতেও আমাদের অনেক অনীহা। এক্ষেত্রেও তিনি আমাদের জরুরি শিক্ষক।
রবীন্দ্রনাথের পর শিল্পের নানা মাধ্যমে এত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ যেমন খুব কম লেখক করতে পেরেছেন, তেমনি নিরন্তর আত্মপাঠ-আত্মমূল্যায়ন-আত্মচেতনার মধ্য দিয়ে আমৃত্যু নবীন ও প্রবহমান থাকার ক্ষমতাও খুব কম লেখকেরই ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তীদের মধ্যে এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার বৈধ অধিকার রাখেন। অন্যদিকে, শুধু বাংলা কবিতার বিস্তার, বিকাশ ও বিশ্লেষণে তার যে সাধনা ও অবদান, এর জন্যই তিনি আমাদের চিরপূজনীয় হতে পারেন।
কিন্তু আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতার কারণেই হোক আর অজ্ঞানতা বা অমনোযোগের কারণেই হোক, তিনি আজও অনেকটাই অবহেলিতই রয়ে গেলেন। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরে এখন আমাদের সামনে এক সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে তাকে ফিরে দেখার, মূল্যায়ন করার ও শ্রদ্ধা জানাবার। আর তা করা দরকার শাদা চোখে ও বাস্তবতার নিরিখে। কেবল ভক্তি বা বিরোধিতা দিয়ে বিচার করতে গেলে তা হবে আমাদের আত্মপ্রতারণারই আরেক প্রকাশ।


১৯টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×