[৩]
“আউউউউউচ… মারিস কেন আজিব ।”
“মারবো না তো কি ? আজ তোর একদিন কি আমার এক বছর । ফাজিল, কুত্তা, বান্দর…”
“ফাজিলনি,… কুত্তী… বান্দরনী…” ফিসফিস করে বললাম আমি ।
“কি বললি !”
“এত্তো জোরে চিৎকার করলে তো আমার কান ফুটো হয়ে যাবে রে…”
“তোর কান ফুটো হওয়াই দরকার… আমার এসাইনমেন্ট কোথায় রাখছিস… খুঁজে বার কর এক্ষণ…। না হলে তোর মাথা ফাটাবো…” বলেই আমার কানের কাছে চিৎকার শুরু করলো । এতক্ষণ শুধু চুল ধরে টানছিল, এখন কানের কাছে চিৎকার শুরু করলো লাবনী । আজ দেখি আমার কেয়ামত !
“আচ্ছা তুই ছাড় আমাকে… খুঁজতে দে…”
“হু… ছাড়লাম । ময়লা ময়লা চুল । কতদিন সাবান দিস নাই, কে জানে !”
“তাও তোর থেকে ভালো আছি। শাঁকচুন্নি কোনখানের ।”
“কিইইইইইইইইইইই……”
“না মানে বললাম, আজকের ওয়েদারটা খুব সুন্দর…” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘুষি সহ্য করতে হল । ওরে কপাল ! এই ডাইনির সাথে থেকে থেকে শুধু আয়ু ই কমাই । ঘোড়ার ডিমের এসাইনমেন্ট দেয়, না হলে এই সাক্ষাৎ আজরাইল-কন্যার সাথে মিশতে যায় কে ! আমি আবার আমার রুমে ঢুকে অনেক কষ্টে খুঁজে বার করে লাবণীর হাতে ধরিয়ে দিলাম... কি জানি বলে? ওহ... এসাইনমেন্ট ।
“নে… ধর তোর এসাইনমেন্ট ।”
“হু… আর যদি তোকে কোনোদিন আমার এসাইনমেন্ট দেই, তাহলে আমার নাম লাবণী না ।”
“তোর নাম তো এমনিতেও লাবণী না… তুই মুটকি রানী ।”
সাথে সাথে আমার চুলগুলোর উপর পাকিস্তানি মিলিটারি টাইপ অত্যাচার শুরু হল । কোনোমতে নিজেকে বাঁচাই আমি । আজও আমার কতগুলো চুল ইন্তেকাল করলো কে জানে । লাবনীর সব রাগ যেন আমার চুলের উপরই ! আরও কিছু হুমকি-ধমকি দিয়ে আমাদের হলের বারান্দা থেকে বের হয়ে গেলো । আমি সেদিকে তাকিয়ে সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের পুরো ডিপার্টমেন্টে লাবণীর মত ভালো কোন ছাত্র বা ছাত্রী, কোনটাই নেই । লাবনীর সাথে আমার সেই অদ্ভুতভাবে পরিচয় হবার পর, যত বিরক্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার মধ্যে শুধু একটাই ভালো ব্যাপার পেয়েছি । আর সেটা এই ‘এসাইনমেন্ট’ । আগে অনেক ঝামেলায় পড়তে হত, এটা নিয়ে । এখন লাবনীর থেকে নিয়ে শুধু কপি করি । মন্দ কি । …আমার মাথার চুল আর কানের বারোটা বাজার বিনিময়ে পেতে হয় এই ‘অমূল্য বস্তু’ । তাই মাঝে মাঝে ওর এই সব অত্যাচার সহ্য করতেই হয় । কিচ্ছু করার নাই ।
লাবণী চলে যাবার পর আমার জানের জান, জান পাখি, কুটু পুটু, ডার্লিং গিটারটা হাতে নিলাম । পরীক্ষার জন্য অনেক দিন ধরে আমার এই জান পাখিটার সাথে কথা হয় নাই । অনেকদিন প্র্যাকটিস ছিল না বলে, ভুলভাল বাজাতে লাগলাম । আস্তে আস্তে আবার আয়ত্তে এসে গেল । আমি গিটার বাজাচ্ছিলাম, রিফাতের খাটে বসে । রুমে কেউ নেই । গিটার বাজাতে বাজাতেই খেয়াল করলাম, আমার খাটের পাশে একটা শপিং ব্যাগ রাখা । তাজ্জব ব্যাপার ! পুরো সকালেও দেখলাম না । এখন কিভাবে আসলো ?
মনে করার চেষ্টা করলাম, এর মাঝে কেউ এসেছে কি না । কিন্তু, সারা সকালে কাওকে দেখি নাই । কেউ আমাদের রুমেও আসে নাই । ব্যাগটা হাতে নিলাম । “আড়ঙ” এর । ভেতরে কি আছে, দেখা উচিত হবে কি না, বুঝতে পারলাম না । ভেবে-টেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেখি কি আছে । বলা যায় না, যদি গ্রেনেড-ফেনেড থাকে ?!...ভয়টা এসে গেল মনে । বিড়বিড় করে যা দোয়া-দরূদ জানি, পড়তে লাগলাম । বিসমিল্লাহ বলে, ব্যাগটা খুলেই হা হয়ে গেলাম । পাঞ্জাবী । একেবারেই নতুন । কেউ ভুলে রেখে গেলো নাকি ? অন্যের জিনিস দেখা ঠিক হবে কি না, ভাবতে ভাবতে ব্যাগ থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে দেখতে লাগলাম । সুন্দর । সাদার মাঝে কালো রঙের সুতোর কারুকাজ । তারপর, পাঞ্জাবীর দাম দেখে ঠাণ্ডা মেরে গেলাম একেবারে । ৩,৫০০ টাকা ! এইটা কোন কথা হল ? কুমিল্লার খাদি পাঞ্জাবী কিনেছিলাম একবার নগদ ৩৭৫ টাকা দিয়ে । ঐটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঞ্জাবী । গায়ে দিতেও কি আরাম । আহ । এতো দাম দিয়ে মানুষ যে কোন দুঃখে জামাকাপড় কিনে, বুঝি না । এটা ভাবতে গিয়েই আমার মনে পড়ল, পাঞ্জাবীর মালিক কে, এটা এখনও জানা হয় নাই ।
অর্ককে ফোন দেয়া যায় । আমাদের তিন জনের মধ্যে অর্ক সবার শেষে ঘুম থেকে উঠে । কিন্তু আজ আমি ঘুম থেকে উঠে অর্ককে ও দেখি নাই । ও হয়তো জানতে পারে । কিন্তু অর্ক চালবাজ টাইপের । ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্ন করতে হবে ।
“হ্যালো অর্ক ?”
“ফাগা তুই ! তুই আমারে ফোন দিছিস ? তুই ফোন দিতে জানোস ? কবে শিখলি মামা ? পার্টি দে একটা ।” (সুযোগ পেয়ে কি পচানিটা যে দিলো !)
“ঐ বেটা , ইজ্জত রাখ । দোস্ত, একটা হেল্প লাগবে ।”
“কি হেল্প মামা ? ফোন কেমনে কাটতে হয়, এইটা জানতে চাস ?”
মনে মনে বললাম, হালা তোরে আমি...... মুখে বললাম, “আরে শোন, আড়ঙ এর শো-রুম আছে কোথাও কাছাকাছি ?”
“কোন মাইয়ারে কি গিফট দিবি মামা ? কারে পটাইলি ? কে সেই হতভাগী ? মাইয়ার ফোন নাম্বারটা দে তো ।” আমি আর কি । অর্ক আমার ওস্তাদ । তবে এইবার আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না । হড়বড় করে বলে দিলাম, কিভাবে, কোথায় পাঞ্জাবীটা পেয়েছি । আমার কথা শুনে অর্ক বলল, “দোস্ত, ওয়েট । পাঁচ মিনিট । মনে হয়, রিয়া রেখে গেছে ।”
“রিয়া কি তোর বেড কোনটা জানে না ? আমার বেডের পাশে রাখবে কেন ?”
“আরে বেটা, তাড়াহুড়োতে বোধহয় খেয়াল ছিল না । আমি আসছি ।”
ফোন রেখে দিলাম আমি । সাথে সাথেই আবার ফোন । লাবণীর ।
“এতক্ষণ ধরে ওয়েটিং ! কোন মেয়ের সাথে লাইন মারিস ?”
“আরে না, ধুর । অর্কের সাথে কথা বলছিলাম । আমার খাটের পাশে কে যেন একটা দামী পাঞ্জাবী রেখে গেছে । ও জানে নাকি, সেটা জানতে ফোন করেছিলাম ।”
“ইরফু...”
“হুম...”
“তোর হাইট কত?”
“পাঁচ ফুট সাত-আট হবে...। কেন? ”
“তুই একটা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি সাইজের গাধা । বিরাট গাধা ।”
“আমি আবার কি করলাম !” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ।
“গাধারে, ঐটা আমিই রেখেছি । তোর জন্য । পছন্দ হয়েছে ?”
আমার তোতলানো শুরু হচ্ছে । সাড়ে তিন হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবী, তা ও আমার জন্য !
“আ...আ...আ...”
“অ্যাঁ অ্যাঁ করছিস কেন ? পছন্দ হয় নাই ?”
“আমার জন্য আনলে, আমার হাতে না দিয়ে এইভাবে রেখে গেলি কেন?”
“তোকে কি আমি চিনি না ? ভান করবি, ঢং করবি, তা ও নিবি না ।” মনে মনে ভাবলাম, তাইতো ! হতেও পারে । ভাগ্য ভাল, হাতে হাতে দেয় নাই । না ও নিতে পারতাম । ধুর, নিজেকে এখন লোভী লোভী মনে হচ্ছে ।
“সত্যি করে বলতো, তোর পছন্দ হয় নাই ?”
“কি বলস । পাঞ্জাবী ঠিক আছে , কিন্তু এতো দাম দিয়ে কেন কিনতে গেলি শুধু শুধু...”
“হু... হু কারণ আছে । বিকালে তোর ‘ফজল মামু’র দোকানের সামনে আসবি । গিটার সহ । পাঞ্জাবীটা পরে আসবি । তোর জন্য আরও সারপ্রাইজ আছে । এখন রাখি । মোবাইলে চার্জ নাই , ইলেক্ট্রিসিটিও নাই ।”
আমি এখনও হতভম্ব হয়ে পাঞ্জাবীটার দিকে তাকিয়ে আছি । বড় আপা, বিয়ের সময় (২০০৫ এর দিকে) আমাকে ১৫০০ টাকা দিয়েছিল শার্ট-প্যান্ট কেনার জন্য । আমার জীবনে উপহার বলতে শুধু সেই স্মৃতিটাই ছিল । আর আজকের এটা ।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । কিছু একটা মাথায় আসি-আসি করেও আসছে না । বুঝতে পারছি না । আজকের বিকালেও যদি লাবণীর সাথে থাকতে হয়, তাহলে আজও আমার ‘রমণী প্রদর্শন’ হবে না । রুমে
ঢুকে দরজা বন্ধ করে পাঞ্জাবীটা দেখতে লাগলাম । যত দেখছি, আমার হতভম্ব ভাবটা আরও বাড়ছে ।
(চলবে)