প্রথমে কিছু পরিচিতি মূলক কথা। গুজবের আক্ষরিক ইংরেজি প্রতিশব্দ Rumor/Rumour। ল্যাটিন rumor এর অর্থ noise, gossip। কত আগে থেকে এই গুজব বা রিউমার এর সূত্রপাত তা বলা মুশকিল। ধারণা করা হয় পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস যত পুরাতন। রিউমারের ইতিহাসও তত পুরাতন। অতি প্রাচীন সভ্যতাতেও রিউমার ছড়ানো হতো। তার প্রমাণ গ্রিক পুরাণের দেবী ফিম (Pheme/femme/fama)। ইনি রিউমারের দেবী। আবার তাকে gossip এবং fame এর দেবীও বলা হয়। মূল কথায় যাওয়ার আগে তার ব্যাপারে কিছু লেখা যাক।
ফিম জিউসের বার্তাবাহক। দেবী হলেও তিনি স্বর্গপূরে থাকেন না। তার বসবাস মর্ত্যে। পাহাড়ের মাথায় এক পিতলের তৈরি প্রাসাদে থাকেন। সেখান থেকে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল–ত্রিলোকের সমস্ত পরিকল্পনা শুনতে পান। ছবিতে দেখা যাচ্ছে তার ডানা আছে। এই ডানার প্রতি পালকে চোখ কান ও মুখ থাকে। তাকে একটা অথবা দুটো ট্রাম্পেট বাজাতে দেখা যায়। দুটোর ক্ষেত্রে একটা হলো সত্য বা ভালো খবর বলার জন্য। অন্যটি মিথ্যা বা খারাপ খবর বলার জন্য। তাকে মানুষ এবং দেবতা দুই পক্ষই খুব সমীহ করে চলে। কারণ তার উলটা পালটা খবরে যে কেউ বিপদে পড়তে পারে।
রিউমার কি
১৯৪২ সালে শিকাগোতে আমেরিকার সরকার রিউমার ক্লিনিক তৈরি করে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাজারে নানান রকম রিউমার ছড়ানো হতো। রিউমার ক্লিনিক এগুলো সংগ্রহ করতো। তারপরে প্রতি রবিবার ফলাও করে সপ্তাহের সেরা রিউমার প্রকাশ করে যুক্তি সহকারে প্রমাণ করতো যে এসব আসলে মিথ্যা খবর। এই সময়ের প্রাপ্ত তথ্যগুলো নিয়ে পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে গর্ডন এলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান গবেষণা পত্র 'সাইকোলজি অব রিউমার' প্রকাশ করে। যাকে সোস্যাল সাইকোলজিতে একটি মাইলস্টোন বিবেচনা করা হয়। তাদের মতে, 'গুজব হলো একজনের কাছ থেকে অন্য একজনের কাছে মুখে মুখে ছড়ানো নির্দিষ্ট অথবা ঘটমান কোন বিষয়ের উপর এমন কোন বিশ্বাস, যার সত্যতার কোন প্রমাণ নেই।'
রিউমারের বৈশিষ্ট্য — প্রথমত এটা জনতার মুখে মুখে ছড়ায়। দ্বিতীয়ত, রিউমারে মানুষ অথবা কোন ঘটনা অথবা কোন পরিস্থিতি নিয়ে কিছু তথ্য থাকে। তৃতীয়ত, যেই এলাকায় রুমার ছড়ানো হয়েছে সেখানকার মানুষের আবেগের সাথে এর সম্পর্ক থাকে।
রিউমার কিভাবে ছড়ায়
এলপোর্ট এবং পোস্টম্যান রিউমারের ক্ষেত্রে তিনটি দিককে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন— প্রচার, বিষয়বস্তু এবং এর শ্রোতা। রিউমার শুরুতে এর তার মুখের কথায় ছড়ালেও সোস্যাল এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মাধ্যমে এই প্রচারণা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এরপর রিউমারের বিষয়বস্তুর প্রতি জনতার কতটুকু আগ্রহ আছে তার উপর নির্ভর করে এটা আরো বেশি ছড়ায়। সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই রিউমারগুলো যাদের কাছে এসে পৌছায় তাদের প্রতিক্রিয়া এ ব্যাপারে কেমন। যদি রিউমারের তথ্যগুলো এমন কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত হয় যেটার সাথে তাদের আবেগ জড়িত। আর রিউমারের শ্রোতারা যদি এসব নিয়ে আগে থেকে খুবই দুশ্চিন্তার ভিতরে থাকেন। তাহলে তারা অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হবেন।ফলে রিউমারের প্রচারণা আরো বাড়বে। যেমন, ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণের গুজব। ধর্ম গ্রন্থ বা নবীকে অবমাননার গুজব।
এই সাইকেলের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শেষ ধাপটি। এই ধাপে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে ফ্রয়েডের 'সাইকোএনালাইসিস অব ইমোশন' তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা যায়। আমি এই লেখাতে এ ব্যাপারটি নিয়ে লিখবো না।
এলপোর্টের এক ছাত্র রবার্ট ন্যাপ রিউমারের বিষয় বস্তুর উপর ভিত্তি করে একে কিছু শ্রেণীতে ভাগ করেছেন।
*পাইপ ড্রিম রিউমার—জনগণ যা প্রত্যাশা করে আছে যদি রিউমারটাও তাই হয়। যেমন, বৃষ্টি হলে করোনা থাকবে না। বৃষ্টির পানিতে সব জীবাণু ধুয়ে চলে যাবে। কিংবা গরমের দেশে করোনা হয় না।
*বুগিম্যান রিউমার—জনগণের ভয় বা দুশ্চিন্তার উপর ভিত্তি করে যে রিউমার ছড়ায়। যেমন, করোনায় প্রতিদিন বহু লোক মারা যাচ্ছে। কিন্তু সরকার তথ্য গোপন করছে।
কিংবা চায়নাতে বহু লোক মারা গেছে। তাদের লাশ গুম করে ফেলা হইছে।
*ওয়েজ ড্রাইভিং রিউমার—যে রিউমার জাতির ভিতরে দলাদলি তৈরি করে। যেমন, ডাক্তাররা করোনা রোগী দেখছেন না। বাংলাদেশে কোন চিকিৎসা হচ্ছে না।
কিংবা গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড টেস্ট কিট সরকার ইচ্ছা করে অনুমোদন দিচ্ছে না। কিংবা করোনা আল্লাহর গজব। অথবা করোনা বদ চায়না ইচ্ছা করে ছড়াইছে।
রিউমারের স্থায়িত্বের উপর ভিত্তি করে আবার দুটো ভাগ করা যায়— অর্ডিনারি,ভিশনারি। অর্ডানারি অল্প দিনের ভিতর হারিয়ে যায়। ভিশনারি বহু বছর টিকে থাকে। যেমন, এরিয়া ৫১ এ এলিয়েন নিয়ে গবেষণা হয়। কিংবা রবীন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর প্রেম ছিলো। কিংবা জীবনানন্দ দাশ ট্রামের নীচের ইচ্ছা করে পড়েছিলেন।
রিউমার কেন ছড়ায়
২০০৪ সালে প্রশান্ত বোর্ডিয়া এবং নিকোলাস প্রনজো 'সোস্যাল ইন্টারেকশন অন দা ইন্টারনেট:রিউমার এজ সোস্যাল কগনিশন' এই নামের একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। তাদের ধারণা সমাজের কোন সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণে রিউমার ছড়ায়। একটা রিউমার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চারটা ধাপ অতিক্রম করে,
–প্রথমে রিউমারটা সমাজে পরিচিতি পায়।
–স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ এটা নিয়ে আলোচনা করে। পক্ষে বিপক্ষে নানান মত দিতে থাকে।
–একটা সময়ে পূর্বের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
–তারপর এই বিষয়ে সকল রিউমারের প্রতি জনগণ আগ্রহ হারায়।
রিউমারের সূত্র
R ≈ i × a
R হলো রিউমারের শক্তি। i হলো মানুষের কাছে এর গুরুত্ব। এবং a হলো যে বিষয়ে রিউমার তৈরি হয়েছে সেটি কতটা বিতর্কিত। এটি এলপোর্ট এবং পোস্টম্যানের সূত্র৷ তবে বর্তমানে এর সাথে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা এবং তাদের নিজেদের ভিতর সম্পর্ক বিবেচনা করে একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে হিসেব করা হয়।
সবশেষে,আমরা কিভাবে রিউমারকে ঠেকাতে পারি
সাধারণ মানুষের জন্য খুবই সাধারণ কিছু উপদেশ। সরকার নিয়মিতই এসব বলছে। যা কিছুই শোনা যাক বা দেখা যাক, কোন কিছুই প্রথমেই বিশ্বাস করা যাবে না। এমনকি মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে আসলেও। যে কোন খবরের উৎসের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করে দেখতে হবে। সব কিছু সম্পর্কে একটি সাধারণ সন্দেহ মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ 'কোন কিছুই ধ্রুব সত্য নহে' (একমাত্র আলোর গতিবেগ ছাড়া) এটা মাথায় রাখতে হবে।
সূত্রঃ
Psychology of rumor, Gordon Allport & Leo postman.
wiki
Greekgodsandgoddesses
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২০ রাত ৯:৫৭