২০৮৮ সালের ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,
এরকমটা মনে করা হচ্ছে যে আপনারা অতীত থেকে কিছু জ্ঞানের কথা শুনতে আগ্রহী হতে পারেন। এবং সেটা আমাদের বিংশ শতাব্দীর কয়েকজনকে বিতরণ করতে হবে। সেক্সপিয়ারের হেমলেটে পলোনিয়াসের এই উপদেশটি কি আপনাদের জানা আছে? "সব কিছুর আগে নিজের কাছে সৎ হও।" অথবা স্বর্গত সাধু জনের এই উপদেশটি, "ঈশ্বরকে ভয় ও প্রশংসা করো। তাঁর বিচারের সময় এসে গেছে?" নিজের কাল থেকে আমি আপনাদের কিংবা যে কোন সময়ের যে কাউকে উদ্দেশ্য করে যে সর্বোত্তম উপদেশটি দিতে পারি, "আমি যা বদলাতে পারি না তা মেনে নেওয়ার মতো স্থিতধী ঈশ্বর যেন আমাকে দেন। যা কিছু বদলাতে পারি তাঁর জন্যে যেন সাহস দেন। এবং এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ করার প্রজ্ঞাটাও যেন উনি দিয়ে দেন।"
অন্যান্যগুলোর মতো আমাদের শতকে এতো বেশি জ্ঞানোপদেশ তৈরি হয়নি। তার কারণ, আমার ধারণা, আমরাই প্রথম মানুষের অবস্থা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়েছি। যেমন এই পৃথিবীতে জনসংখ্যা কত? খাদ্য উৎপাদন কতখানি হচ্ছে? আমরা কত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারছি? কেন আমরা অসুস্থ হই? কেন মারা যাই? আমরা কি পরিমাণে দূষিত করছি মাটি ও বাতাসকে? সেই সাথে ভূপৃষ্ঠকেও -- যার উপর অধিকাংশ জীবনের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে, প্রকৃতি কতটা হিংস্র ও নিষ্ঠুর হতে পারে এবং এইরকম আরো অনেক তথ্য। এত এত খারাপ খবরের মাঝে কে আর জ্ঞান ফলাতে পারে?
আমাকে যে ব্যাপারটি বিবশ করেছে সেটি হলো প্রকৃতি মোটেও "পরিবেশবাদী" নয়। আমাদের কোন সাহায্য ছাড়াই সে তছনছ হয়ে পুনরায় নবরূপে শুরু করতে পারে। প্রাণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর ফলে পরিবেশের যে উন্নতি হবেই সেরকমও না। সে নিজেই বজ্রপাত দিয়ে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। লাভা দিয়ে একরের পর একর চাষযোগ্য জমি ঢেকে দিচ্ছে। সে অতীতে নর্থ পোল থেকে নর্থ আমেরিকা,ইউরোপ ও এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলের উপর দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছিলো। আবারো যে একই কাজ করবে না তা ভাবার কোন কারণ নেই। ঠিক এই মুহূর্তে আফ্রিকার ছোট ছোট জমিকে সে মরুভূমিতে পরিণত করছে। যে কোন সময়ে জলস্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার না হয় মহাকাশ থেকে পাথর মারারও সম্ভাবনা আছে। কেবল চমৎকারভাবে বিবর্তিত প্রজাতিকেই সে নিমিষে নিশ্চিহ্ন করে দেয় নি, সমুদ্র শুকিয়েছে এবং মহাদেশ পর্যন্ত ডুবিয়েছে। মানুষ যদি মনে করে প্রকৃতিই তার বন্ধু, নিশ্চিতভাবে তার আর শত্রুর দরকার নেই।
হ্যাঁ, এটা ঠিক, আজ থেকে একশো বছর পর আপনারা খুব ভালো ভাবে অবহিত এবং আপনাদের নাতিপুতিরা আরো বেশি জানে যে স্থানকাল নির্বিশেষে খাদ্যের বিপরীতে জীবনের সাংখ্যিক বিচারে প্রকৃতি কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে। তো বাড়তি জনসংখ্যার বিষয়ে প্রকৃতি এবং আপনারা কী করলেন? এই ১৯৮৮ সালে আমরা নিজেরাই নব্য হিমস্রোত, উষ্ণ রক্তবাহী এবং অত্যন্ত ধূর্ত, অদম্য, সবকিছু খেয়ে ফেলতে উদ্যত। তার উপর নিজেদেরকে সংখ্যায় ডাবল করে চলছি।
আর একবার ভেবে দেখলাম, আপনারা এবং প্রকৃতি মিলে এত অল্প খাদ্যের বিপরীতে এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য কী ব্যবস্থা নিলেন, আমি না জানলেই মনে হয় ভালো হবে।
কিছু ক্ষ্যাপাটে ধরণের আন্দাজ করার চেষ্টা করি। এমনটা কি সম্ভব আমরা একে অপরের দিকে হাইড্রোজেন বোমা তাক করেছি -- ছুড়ে দেওয়ার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে। যাতে আরো গভীর কোন সমস্যা আমাদের না ভাবায় - প্রকৃতি আর কতটাই বা আমাদের প্রতি নির্মম হতে পারে? দিন শেষে প্রকৃতি তো প্রকৃতিই!
এখন আমরা যেহেতু স্পষ্ট করে নিজেদের বিপর্যয়ের কথা আলোচনা করতে পারি। আমার আশা আপনারা অকাট মূর্খ অতি আশাবাদী নেতাদের নির্বাচন করা বাদ দিয়েছেন। এরা একসময় কাজে আসতো। যখন মানুষ দুনিয়াদারি সম্পর্কে কিছুই বুঝতো না--বিগত সাত মিলিয়ন বছর বা ঐরকম সময় ধরে। আমার যুগে এরা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথায় বসে সর্বনাশ করে ছেড়েছে।
এই মুহূর্তে আমাদের এমন নেতার দরকার নেই যারা লাগাতার কাজের মাধ্যমে প্রকৃতির উপর চূড়ান্ত বিজয়ের কথা বলেন -- যেমনটা আমরা এখন করছি। বরং সেরকম নেতা দরকার যিনি সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রকৃতির কাছে অনমনীয় কিন্তু যৌক্তিক এই সমর্পণ-শর্তগুলোর কথা বলবেন:
১.জনসংখ্যা হ্রাস করুন ও স্থিত রাখুন।
২.পানি,বাতাস ও জমি দূষিত করা বন্ধ করুন।
৩.যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি বন্ধ করুন এবং বাস্তব সমস্যা নিয়ে কাজ করুন।
৪.শিশুদের শেখান কি করে কোন গ্রহকে ধ্বংস না করে তাকে আবাদ করা যায়। নিজেরাও এই সুযোগে শিখে নেন।
৫.ট্রিলিয়ন ডলার দিলে বিজ্ঞান যে কোন কিছু ঠিক করে দিতে পারে। এই ভাবনা বাদ দিন।
৬.আপনারা যতই ধ্বংসাত্বক এবং উড়নচণ্ডী হোন না কেন। আপনাদের নাতিপুতিরা ভালো থাকবে। কারণ তারা চাইলেই স্পেসশিপে করে অন্য কোন সুন্দর গ্রহে চলে যেতে পারবে। এইসব বাজে এবং বেকুবি চিন্তাও বাদ দিন।
৭.ইত্যাদি।
আমি কি শতবছর পরের জীবন নিয়ে একটু বেশিই হতাশাবাদীদের মতো আচরণ করছি? সম্ভবত আমি নেতাদের বক্তৃতা লেখকদের চেয়ে বিজ্ঞানীদের সাথে একটু বেশিই সময় কাটিয়ে ফেলেছি। আমার ধারণা হয়তো ২০৮৮ সালে বাউন্ডুলে উদ্বাস্তু মানুষরাও ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে না কি রকেটে উড়ে বেড়াবে। কারো আর স্কুল কিংবা কাজের জন্য বাড়ি থেকে বের হতে হবে না। টিভি দেখাও বন্ধ করতে হবে না। তারা সারাদিন বসে বসে কমলার রস খাবে আর কম্পিউটারের সুইচ টিপবে। মহাকাশচারীদের মতো।
চিয়ার্স
কার্ট ভনেগাট
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত।
চিঠিসূত্র
---
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক পদে যোগ দিয়েছিলেন তরুণ ভনেগাট। ফ্রান্সে যুদ্ধবন্দী হিসেবে জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে জার্মান ঘাটিতে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের এয়ার বোম্বিং এ ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীতে লেখালেখি শুরু করেন। লিখেছেন ক্যাট'স ক্রেডল, ওয়েলকাম টু মাংকি হাউস, স্লটারহাউজ ফাইভের মতো বই। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের কারণে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিলো। তাঁকে বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন হিসেবে ধরা হয়।
---
উইকিতে_Kurt_Vonnegut
ভনেগাটের লাইব্রেরি
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২১ রাত ১২:৪৭