জীবনে অনেক বার ছোট বড় বা্ইক এক্সিডেন্টের শিকার হয়েছি। সবগুলোই হয়েছে অপর পক্ষের উদাসীন গাড়ী চালানোর জেরে। থাক সেসব কথা। শেষ যে এক্সিডেন্ট করালাম, সেটা নিয়ে কিছুটা লিখি। কারন আমার ভুলে যাওয়া রোগ আছে। তারওপর মনের গোপন সত্যটা শোনানোর মতো কেউ নেই। লিখে যদি কিছুটা হালকা হই!
০৬ তারিখ বাসায় ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে সকাল ৯টার মত। এত স্পিডে বাইক আমি চালাইনি। ১৫২কিমি রাস্তা পাড়ি দিলাম ২ ঘন্টা ১৫মিনিটে। এসে অফিসও ধরলাম। এতো তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফেরার কারন হল, মায়াবীর সাথে দেখা করা। অনেক বার ফোন
ম্যাসেজ দেবার পর, রিপ্লাই পেলাম, আজ দেখা হবে না।
পরের দিন ০৭ তারিখ দেখা করার সুযোগ হল। মায়াবীর অফিসে গেলাম। কাজের ফাকে ফাকে সে আমার সাথে কথা বলছে। অকারনেই হাসছে। এক সময় চা নাস্তা আসল। আমি দুবার চায়ে চুমুক দিয়ে দেখি সে আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। এদিকে পিয়ন আর দু এক জন আসা যাওয়ার ভেতরেই আছে। তাই আমাদের সব কথাবার্তা ফরমাল আর অফিস ভিত্তিক। মায়াবী ওর কাপে একচুমুক দিয়ে রেখে আমার দিকে তাকাল। বুঝলাম, আমার চার কাপ টা সে নিতে চাচ্ছে।
আমি এক ফাকে কাপটা চেন্জ করে ফেললাম। দুজন দুজনের চুমুক দেয়া চা শেষ করলাম হাসিমুখে, গল্পে গল্পে। আধাঘন্টা পর আমাকে চলে যেতে বলল। আমি একটা ছবি নিতে চাইলাম। সে রাজি হল না।
মন খারাপ করে বেরিয়ে আসলাম। আমি মায়াবীর ওপর কখনও কােনো ব্যাপারে জোর করিনা। জোর করলে বা আরও এক দুবার বললেই ছবি তুলতে দিত। আমরা এক অপরকে ভালবাসি গত ২৪ বছর হল।
বাইক চালাতে চালাতে মনটা খুব খুশি খুশি লাগছিল। আবার পরক্ষনেই খারাপ লাগছিল। এভাবে আর কতদিন। একটা সোস্যাল পেপার, ম্যারিজ সার্টিফিকেট নেই বলে, দুজনের হাজারও কষ্ট, না পাবার বেদনা।
অফিস শেষে অন্যান্য কাজ করে বাসায় ফিরলাম। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আর ভাল লাগছিল না। মায়াবীকে খুব মিস করছিলাম। সব কিছু ওলট পালট লাগছিল।
রাত ১০টার পর আবারও বাইক নিয়ে বের হলাম। ঘন্টা খানেক পুরো শহর চক্কর দিয়ে, হাই ওয়েতে একটা জিনিস আনতে গেলাম। ভাবলাম জিনিসটা যেহেতু আগে ভাগে পেয়ে গেছি, বাইকে পেট্রল তুলে বাইপাস হয়ে বাসায় ফিরব।
ট্যাঙ্ক ভর্তি তেল, ফাকা হাইওয়ে, শীতের কুয়াশা, ঠান্ডা বাতাস। সব মিলিয়ে অন্যরকম ফিল হচ্ছিল। মনটা ভাল না হয়ে আরও খারাপ হল। আমার মায়াবীকে ভীষণ মিস করছিলাম। আজ একটা ছবি তুলতে দিল না... আরও অনেক অনেক কিছু ভাবছিলাম আর বাইক চালাচ্ছিলাম।
বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল। ভালবাসার মানুষটাকে ঘিরে কষ্টগুলো বুকের ভেতরে দলা পেকে যাচ্ছিল। হেলমেট খুলে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। এ জীবন শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে হল। এত কষ্ট মেনে নেয়া যায় না। সীমারও একটা সীমা থাকে। হিসাব মেলে না। ওকে এ জীবনে আর পাওয়া সম্ভব না।
এমন অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে কুয়াশার ভেতর সামনে কিছু একটা দেখলাম যেটা আপজিট সাইট থেকে আসছিল। ২টা হেডলাইট দেখে ভাবছিলাম পিকআপ ভ্যান বোধায়। যাইহোক স্পিড আরও বাড়িয়ে দিলাম। যা হয় হোক। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে ইচ্ছে হল না। ধাক্কা লাগার আগেই চোখে অন্ধকার দেখলাম।
যখন চোখ মেললাম তখন হসপিটালের ইমারজেন্সি ইউনিটে নেয়া হচ্ছে। আমি স্ট্রেচারে শুয়ে আছি। অনেক হট্টগোল, ছাদের ঝোলানো লাইট একটার পর একটা পার হচ্ছে। পুরো শরীরে অসম্ভব ব্যথা। আমার পুরো শরীর চটচটে কিছুতে ভেজা। বুঝলাম, রক্তে ভেসে গেছে। কেউ একজন কানের কাছে এসে বলল, আপনি এক্সিডেন্ট করছেন। তেমন গুরুতর না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আবার জ্ঞান হারালাম। (যখন এই লেখাটা লিখছি, আমার দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। লেখাবে যারা পড়বে তাদের এই ফিলটা হবে না। আর একজনের হবে, সে হল আমার মায়াবী)।
আবার জ্ঞান ফিরলে বুঝলাম আমি অপারেশান থিয়েটারে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম এটা ভেবে যে, এ যাত্রায় তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। আমি যেহেতু শুনতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি, ভাবতে পাচ্ছি, আমি টিকে থাকব, আমাকে টিকে থাকতেই হবে। আমার মায়াবীর কাছে ফিরত্ই হবে। আমি জানি, আমার মৃত্যু মানে আর একটা মৃত্যু সামনে।
এসব ভাবতে ভাবতেই ডক্টর ড্রেসিং শুরু করেছিল। আমার নাক দিয়ে ব্লাড আসছিল। বাম হাত আর বাম পা ৪ জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। এনাসথেসিয়া হয়ত তখনও কাজ শুরু করেনি। প্রচন্ড ব্যথায় আবারও জ্ঞান হারাই্।
কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখলাম, আমার গা ঠান্ডা হয়ে গেছে, পুরো শরীর কাপাকাপি শুরু হয়েছে। ডক্টরকে বললাম, আমাকে ব্লাড দেবার ব্যবস্থা করেন ইমিডিয়েট। কার্ডিয়াক এরেস্ট হলে বাঁচাতে পারবেন না।
আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছিল। কেউ একজন ব্লাড নিয়ে ছোটাছুটি করছিল। আমি বুক ভরে শ্বাস টানছিলাম। কিন্তু তবুও যেন দম আটকে যাচ্ছিল। বুকটা অনেক ভারি লাগছিল।
এর ভেতরেই একটা নারি কন্ঠ আমাকে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে? ভয় পেয়োনা... সব ব্যবস্থা করা হয়েছে...
আমি ঝাপসা চোখে তাকালাম। মনে হল মায়াবী এসেছে। বললাম, তুমি আসছো? তোমাকে কে জানালো? চিন্তা করোনা...
নারী কন্ঠটা শুধু বলল, বাবা আমাকে চিনছো? আমি তোমার খালা। ... খালা আরও কিছু বলেছিল... মনে নেই... হসপিটাল অথারিটি এক্সেস থাকায় তিনি ওটি তে ঢুকতে পেরেছিলেন।
এক্সিডেন্টের ৫ দিন পর ১২ তারিখ মায়াবীর সাথে কথা হল। ঘটনার রাতেই খবর পেয়েছিল। অথচ কোন ফোন দেয়নি, হসপিটালে দেখতে আসেনি। ঐদিন ওকে শুধু বললাম, দোয়া করো। তোমার সাথে আমার ঘর সংসার হবে বলেই, আল্লাহ আমাকে নিজ হাতে বাঁচিয়েছে। উপরের বোল্ড করা কথা গুলোও বললাম।
আরও বলছিলাম, তুমি কখনও বুঝবানা, মনের কষ্ট দেহের কষ্টের চেয়ে অনেক গভীর। দেহের কষ্ট সহ্য করা যায়, মনের কষ্ট সহ্য করা যায় না। একটা মানুষ কতটা হতাশ হলে সুইসাইড করতে যায়, তুমি বুঝবানা, তোমাকে বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই...
মায়াবী শুধু বলল: সেটাই... সব কষ্ট শুধু তোমারই হয় ! আগে সুষ্হ্য হও, তারপর সব বোঝাবো...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




